বিএনপিসহ দুই-তৃতীয়াংশ দলের বর্জনের মধ্যে অনুষ্ঠিত ২০১৪ সালের নির্বাচন পর্যবেক্ষণ ইইউ না করলেও একাদশ সংসদ নির্বাচনের ক্ষেত্রে তেমনটা হচ্ছে না বলে মনে করছেন তিনি।
ঢাকা ছাড়ার আগে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বাংলাদেশের পরবর্তী নির্বাচন, সন্ত্রাস দমন কার্যক্রমসহ নানা বিষয়ে কথা বলেন মায়াদোন।
বাংলাদেশের বর্তমান ‘রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা’ বিবেচনায় নিয়ে মায়াদোন বলেন, “এবার পরিস্থিতি ভিন্ন হবে। সব রাজনৈতিক দল নির্বাচনে অংশ নেবে। আমি আশাবাদী যে এটা ঘটবে।
“(অতীত থেকে) শিক্ষাও হয়েছে…, আমি দৃঢ়ভাবে বিশ্বাস করি যে, এটিই সব রাজনৈতিক দলকে আগামী নির্বাচনে নিয়ে আসবে।”
দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পর্যবেক্ষক না পাঠানোর পাশাপাশি ইউরোপের ২৮ দেশের এই জোট ২০১৫ সালে নির্বাচন কমিশনের বিভিন্ন প্রকল্পে অর্থায়নও বন্ধ করে দেয়; যদিও এ সময়ে উন্নয়ন সহযোগিতা খাতে সার্বিক বরাদ্দ বেড়েছে।
চলতি বছর নতুন নির্বাচন কমিশন গঠিত হওয়ার পর প্রধান নির্বাচন কমিশনারের (সিইসি) সঙ্গে দেখা করে সিইসির সহযোগিতামূলক যে কোনো প্রস্তাব বিবেচনার কথা বলেছিলেন রাষ্ট্রদূত মায়াদোন।
সাক্ষাৎকারে তিনি প্রস্তাব পেলে বিবেচনার আশ্বাস দিয়ে বলেন, “এখন পর্যন্ত সহযোগিতার কোনো অনুরোধ আমি পাইনি। নির্বাচন এগিয়ে আসায় এ ধরনের প্রস্তাব হয়ত আমরা পেতে পারি; আমরা যা যা করতে পারি সেই অনুযায়ী প্রস্তাব বিবেচনার ক্ষেত্রে স্বচ্ছ থাকব… ভালো ফলাফলের জন্য যত শিগগিরই প্রস্তাব আসে ততই ভালো।”
মায়াদোন বলেন, “ইইউর নির্বাচন পর্যবেক্ষক পাঠানোর সম্ভাবনা সহযোগিতার একটি নির্দিষ্ট ক্ষেত্র হতে পারে।
“পর্যবেক্ষণ শুধু ভোটের দিনই যে হয়, তা না। এটা নির্বাচনের দুই মাস এমনকি তিন মাস থেকেও শুরু হতে পারে। তাই এটা (নির্বাচন পর্যবেক্ষণ) খুব বড়, তাৎপর্যপূর্ণ ও কার্যকর একটি উদ্যোগ।”
ঢাকার সঙ্গে ফেব্রুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে কূটনীতিক আলোচনার সময় নির্বাচন কমিশনকে সহযোগিতার প্রস্তাব দেওয়া হয়। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাতেও সেই প্রস্তাবে বার্তা পৌঁছে দেন মায়াদোন।
তিনি বলেন, “আলোচনায় অংশ নেওয়া সব সরকারি প্রতিনিধিরা (সহযোগিতার) সম্ভাবনাকে স্বাগত জানিয়েছেন, তাই আমি আশাবাদী যে, এটা (নির্বাচন পর্যবেক্ষণ) এবার ঘটবে।”
২০১৪ সালের অক্টোবরে ইইউ দূতাবাসের ঢাকা মিশনের যোগ দেওয়া মায়াদোন গত বছর জুলাইয়ে গুলশানের কূটনীতিকপাড়ায় নজিরবিহীন জঙ্গি হামলা দেখেছেন, যাতে ১৭ বিদেশিসহ ২২ জন নিহত হয়।
হামলার পর ঢাকায় কূটনীতিকদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা ঢেলে সাজানোর পরামর্শ দিয়েছিলেন এই কূটনীতিক।
এতে ইতিবাচক সাড়া দিয়ে সরকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করলেও এখনও বাংলাদেশে অনেক দেশ তার নাগরিকদের উপর ‘ট্রাভেল অ্যালার্ট’ বহাল রেখেছে। অনেক দেশ শুধুমাত্র চাকরিজীবী বয়স্করা ঢাকায় অবস্থান করবে ঘোষণা দিয়ে তাদের ঢাকা মিশনকে একরকম কর্মীশূন্য করে দেয়।
এ ধরনের ‘ট্রাভেল অ্যালার্ট’ বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ও ব্যবসার ক্ষতি করেছে বলছেন ব্যবসায়ীরা।
বিদেশিদের সুরক্ষা নিশ্চিতে ‘যথাযথ পদক্ষেপ’ নেওয়ার ক্ষেত্রে সরকারের প্রচেষ্টাকে সাধুবাদ জানিয়ে রাষ্ট্রদূত মায়াদুন বলেন, “আমরা দেখছি আস্থা ফিরেছে। কিন্তু সবাইকে অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।
“এটা এখন বৈশ্বিক বিষয়। স্পেন ও ফিনল্যান্ডে মর্মান্তিক হামলা দেখিয়েছে যে আমাদের এখনও খুব সতর্ক থাকতে হবে। সন্ত্রাসীরা হামলার আগে সতর্কবার্তা পাঠাবে না। তাই আমরা একবার বিস্মিত হয়েছি, দ্বিতীয়বার বিস্মিত হতে পারি না।”
‘ভ্রমণ সতর্কতা’ বজায় রাখাকে এখন ‘খুবই প্রাসঙ্গিক’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “সম্প্রতি আমরা দেখেছি, ১৫ অগাস্ট পুলিশ সন্ত্রাসী হামলা নস্যাৎ করে দিয়েছে। তার মানে কিছু দল বা গোষ্ঠী এ ধরনের উগ্র কর্মকাণ্ড চালানোর উদ্দেশ্যে পরিচালিত হচ্ছে। তাই আমাদের অবশ্যই সতর্ক থাকতে হবে।”
দায়িত্ব পালনের তিন বছরে বাংলাদেশকে কেমন দেখেছেন প্রশ্নে এক ‘জটিল চিত্র’ তুলে ধরেন ইইউর বিদায়ী দূত।
২০১৪ সালের জানুয়ারিতে দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে পর পরিবর্তিত রাজনীতিক পরিস্থিতিতে বাংলাদেশে এসেছিলেন মায়াদুন।
তিনি বলেন, “নির্বাচনের পর উত্তেজনা চলছিল। এর প্রভাবে ২০১৫ সালের প্রথমার্ধে (বিএনপি-জামায়াত জোটের টানা হরতাল-অবরোধে) অনেক প্রাণহানি হয়। তবু্ও একই সময়ে বৈশ্বিক অর্থনৈতিক পরিস্থিতি ছিল খুবই ভালো, রেমিটেন্স এবং রপ্তানিও বাড়ছিল। তৈরি পোশাক খাতে বার্ষিক প্রবৃদ্ধি তখন পর্যন্ত দুই ডিজিটে ছিল।
“তিন বছর পর পুরো বিপরীত অব্স্থা বিরাজ করছে। রাজনৈতিক অবস্থা স্থিতিশীল। কিন্তু অর্থনীতির ক্ষেত্রে, যদিও ইতিবাচক আশাবাদ রয়েছে, রেমিট্যান্স কমছে বলে গণমাধ্যমে খবর। এটাই অর্থনৈতিক বাস্তবতা।”
ইউরোপের বাজারে তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানি প্রবৃদ্ধি না হওয়ার প্রেক্ষাপটে অনেকেই তাদের কাছে উদ্বেগ জানিয়েছে বলে জানান তিনি।
মায়াদোন বলেন, “বাংলাদেশের উত্তরাঞ্চল এখন দুর্যোগময় বন্যায় আক্রান্ত। প্রথমত এটা মানবতার জন্য ট্র্যাজেডি। আমি সহানুভূতি প্রকাশ করছি।
“এটা সম্ভাব্য অর্থনৈতিক (ক্ষতির) ঘটনাও। আমাদের সমন্বিতভাবে এবং অবশ্যই ইইউকেও তার সহযোগিতা বাড়িয়ে এই বন্যা যেন আর্থ-সামাজিক জটিলতা তৈরি করতে না পারে তা নিশ্চিত করতে হবে।”
এসব প্রেক্ষাপট বিবেচনায় বিদায়ী দূত মায়াদোন বলেন, “তাই তিন বছর আগে সব কিছু খুব খারাপ ছিল, আর তিন বছর সব কিছু খুব ভালো- তা বলা যাবে না।
“এটা সব সময় একটা জটিল চিত্র, বহুমুখী কারণ, যা আবার দেশটির এগিয়ে যাওয়ার চিহ্নও। চ্যালেঞ্জ রয়েছে, কিন্তু বাংলাদেশ ঠিক পথেই রয়েছে।”
মানবাধিকার লঙ্ঘন ও মত প্রকাশের স্বাধীনতা সঙ্কুচিত হওয়ার ক্ষেত্রে সব সময় উদ্বেগ জানিয়ে এসেছে ইইউ।
এ বিষয়ে মায়াদোন বলেন, “আমরা আশাবাদী যে, এসব বার্তায় যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়া হবে। অবশ্যই… এক্ষেত্রে সময় লাগবে।”
সমন্বিত অগ্রগতির জন্য পারস্পরিক সহযোগিতার উপর জোর দিয়ে তিনি আশা প্রকাশ করেন, আইনের শাসন, সহিংসতা এবং সুশাসনের মতো বিষয়গুলোতে সরকার নাগরিক সমাজের কাজে সহযোগিতা করবে।