পাসপোর্টে পুলিশ ভেরিফিকেশন বাদ দিন: টিআইবি

নতুন পাসপোর্ট করার ক্ষেত্রে বিদ্যমান পুলিশ ভেরিফিকেশন পদ্ধতির কারণে সেবাগ্রহিতাদের হয়রানি ও দুর্নীতির চিত্র তুলে ধরে ব্রিটিশ আমল থেকে চলে আসা ওই ব্যবস্থা বাতিলের সুপারিশ করেছে দুর্নীতি নিয়ে কাজ করা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল, বাংলাদেশ (টিআইবি)।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 August 2017, 09:16 AM
Updated : 21 August 2017, 07:33 PM

টিআইবি বলছে, নতুন পাসপোর্টের আবেদনকারীদের তিন চতুর্থাংশকেই পুলিশ ভেরিফিকেশনের সময় অনিয়ম ও হয়রানির শিকার হয়ে ‘ঘুষ বা নিয়ম বহির্ভূত টাকা’ দিতে হয়।

সোমবার ধানমণ্ডির মাইডাস সেন্টারে টিআইবির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে প্রকাশিত ‘পাসপোর্ট সেবায় সুশাসন: চ্যালেঞ্জ ও করনীয়’ শীর্ষক গবেষণা প্রতিবেদনে এ তথ্য তুলে ধরা হয়।

টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ইফতেখারুজ্জমান বলেন, “গবেষণা প্রতিবেদনে আমরা দেখিয়েছি, পুলিশ ভেরিফিকেশনে হয়রানি হচ্ছে; এটার কোনো দরকারই নেই।”

এর বদলে সকল নাগরিকের জন্য ‘বায়োমেট্রিক ডাটা ব্যাংক’ এবং ‘অপরাধী তথ্য ভাণ্ডার’ তৈরি করে তার সঙ্গে পাসপোর্ট অফিস ও ইমিগ্রেশন চেকপোস্টের সংযোগ স্থাপন করার সুপারিশ করেন তিনি। 

সংবাদ সম্মেলনে গবেষণা প্রতিবেদনের সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করেন টিআইবির রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি বিভাগের প্রোগ্রাম ম্যানেজার শাহনূর রহমান।

তিনি বলেন, পাসপোর্ট করাতে গিয়ে সবচেয়ে বেশি হয়রানির শিকার হতে হয় পুলিশের বিশেষ শাখায় (এসবি), তাদের ছাড়পত্রের (ভেরিফিকেশন) জন্য।

টিআইবির জরিপে অংশগ্রহণকরীরা বলেছেন, পুলিশের ওই দপ্তর ‘অযথা’ আবেদনপত্রে ত্রুটি খুঁজে বের করার চেষ্টা করে। জঙ্গি কার্যক্রম বা অন্য রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ততার সন্দেহের কথা বলে ভয় দেখায়। বাড়িতে না গিয়ে চায়ের দোকান বা থানায় ডেকে পাঠায়। ঘুষ দাবি করে এবং ক্ষেত্রবিশেষে তা বিকাশের মাধ্যমে পাঠাতে বলে।

সংবাদ সম্মেলনে জানানো হয়, দেশের ৬৭টি পাসপোর্ট অফিসের মধ্যে বিভাগ অনুপাতে দৈবচয়নের ভিত্তিতে ২৬টি পাসপোর্ট অফিস নির্বাচন করে প্রতি অফিসে পাঁচ কর্মদিবস করে জরিপ চালায় টিআইবি। ২০১৬ সালের সেপ্টেম্বর থেকে চলতি বছর মে পর্যন্ত এই জরিপ চলে।

দৈবচয়ন ভিত্তিতে নির্বাচিত মোট এক হাজার ৪৫৩ জন সেবাগ্রহীতার কাছ থেকে নির্ধারিত প্রশ্নের ভিত্তিতে তথ্য সংগ্রহ করা হয় এ গবেষণার কাজে। 

>> জরিপে অংশগ্রহণকারীদের ৫৫ দশমিক ২ শতাংশ পাসপোর্ট সংশ্লিষ্ট কাজে অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার হওয়ার কথা বলেছেন।

>> এর মধ্যে ৪৫ দশমিক ৩ শতাংশ ঘুষ বা নিয়ম বহির্ভূত অর্থ দিতে বাধ্য হওয়ার কথা জানিয়েছেন। আর ২৭ শতাংশ শতাংশ উত্তারদাতা অযথা সময়ক্ষেপণের শিকার হওয়ার এবং ২ দশমিক ২ শতাংশ পাসপোর্টগ্রহীতা সংশ্লিষ্টদের দায়িত্ব পালনে অবহেলার কথা বলেছেন।

>> জরিপের তথ্য অনুযায়ী, সবচেয়ে বেশি দুর্নীতি ও অনিয়ম হয় পুলিশ ভেরিফিকশনের ক্ষেত্রে। ৭৬ দশমিক ২ শতাংশ উত্তরদাতা এ কাজের জন্য অনিয়ম ও হয়ারনির শিকার হওয়ার কথা বলেছেন।

>> ৭৫ দশমিক ৩ শতাংশ উত্তরদাতা বলেছেন, পুলিশ ভেরিফিকেশনের জন্য তাদের ঘুষ বা নিয়ম বহির্ভূত টাকা দিতে হয়েছে। ঘুষের গড় পারিমাণ ৭৯৭ টাকা। আর পাসপোর্ট অফিসে ঘুষের গড় পরিমাণ দুই হাজার ২২১ টাকা।

>> তবে টিআইবির তথ্য অনুযায়ী পাসপোর্ট অফিসে দুর্নীতি আগের তুলনায় কমেছে। ২০১৫ সালে টিআইবির জাতীয় খানা জরিপে ৭৭ দশমিক ৭ শতাংশ উত্তরদাতা পাসপোর্ট করাতে গিয়ে অনিয়ম ও দুর্নীতির শিকার হওয়ার কথা বলেছিলেন। ঘুষ বা নিয়ম বহির্ভূত অর্থ দেওয়ার কথা বলেছিলেন ৭৬ দশমিক ১ শতাংশ উত্তরদাতা।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, ২০১৫ সালের খানা জরিপে যেসব বিষয়ে সুপারিশ করা হয়েছিল, সেগুলোর ব্যাপারে কর্তৃপক্ষ ইতিবাচক পদক্ষেপ নেওয়ায় কিছু ক্ষেত্রে দুর্নীতি কমেছে। তবে সেবার মান এখনও প্রত্যাশিত পর্যায়ে পৌঁছায়নি।

পুলিশ ভেরিফিকেশন বাতিলের পক্ষে যুক্তি দিয়ে টিআইবির ট্রাস্টি বোর্ডের চেয়ারপারসন সুলতানা কামাল সংবাদ সম্মেলনে বলেন, “সেই ঔপনিবেশিক আমল থেকে এই ভেরিফিকেশনের বিষয়টি চলে আসছে। আগে কোনো কিছু করতে হলেই বলা হত- পুলিশের কাছে থেকে ক্যারেক্টার সার্টিফিকেট লাগবে। সেখানে লেখা থাকত- ‘ওই ব্যক্তি কোনো রাষ্ট্রবিরোধী কাজে জড়িত নয়’। এখন এই গণতান্ত্রিক সময়েও জনগণের প্রতি রাষ্ট্রের যে অবিশ্বাস সেটা রয়ে গেছে।”

তিনি বলেন, “জনগণের প্রতিনিধি বলে যারা নিজেদের দাবি করেন, তারা জনগণকে বিশ্বাস করেন না। অপরাধী কে সেটা পুলিশ জানে। যখন ধরা পড়ে তখন দেখা যায় সে দশ বছর ধরে অপরাধী। তার মানে পুলিশ জানত, কিন্তু দেখত না। যখনই সাধারণ মানুষের বিষয় আসে, তখন দেখা যায় পুলিশ খুব তৎপর।”

‘দালালের কাছে বেশি যায় সিলেটের মানুষ’

টিআইবির হিসাব অনুযায়ী, সিলেটে বিভাগের পাসপোর্ট সেবাগ্রহীতারা দালালের কাছে বেশি যায়। আর সবচয়ে কম যায় রাজশাহী বিভাগের সেবা গ্রহীতারা। সিলেটের ৭০ ভাগ মানুষ পাসপোর্টের জন্য দালালের শরণাপন্ন হয়, আর রাজশাহীর হয় ২০ ভাগ মানুষ।

ইফতেখারুজ্জমান বলেন, “এর কোনো বৈজ্ঞানিক কারণ আমাদের জানা নেই। তবে হতে পারে ঐতিহাসিকভাবে সিলেটের মানুষ বিদেশে যায় বেশি। এটাও কারণ হতে পারে।”

টিআইবির তথ্য অনুযায়ী, পাসপোর্টের জন্য আবেদনকারীদের ৪১ দশমিক ৭ শতাংশ দালাল বা অন্যের সহযোগিতা নিয়েছেন। তাদের মধ্যে ৮০ শতাংশই কাজটি করিয়েছেন দালালের মাধ্যমে।

এর কারণ হিসেবে ভোগান্তি ও ঝামেলা এড়ানো, নিয়ম না জানা, সময়ের আগে পারপোর্ট পাওয়ার আগ্রহ, পুলিশি হয়রানি এড়ানো এবং সময়ের অভাবের কথা বলেছেন উত্তরদাতারা।

প্রতিবেদনে বলা হয়, দালালদের একাংশ এসবি পুলিশ ও পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের একাংশের সঙ্গে যোগাযোগ রাখে। দালালরা পাসপোর্টপ্রার্থীদের কাছ থেকে যে অর্থ নেয়, তার একটি অংশ এসবি পুলিশ ও পাসপোর্ট অফিসের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দেয়। দালালরা বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের ছত্রছায়ায় দৌরাত্ম বজায় রাখে।

ইফতেখারুজ্জামান বলেন, “দালালদের কাছে যাওয়াটা একটা সংস্কৃতি হয়ে গেছে। দালালরা এককভাবে সুবিধা নিতে পারে না; কর্মকর্তা-কর্মচারীরাও জড়িত। এক্ষেত্রে যেসব অসাধু কর্মচারী দালালদের সাথে জড়িত তাদের শাস্তির আওতায় আনতে হবে।”

এছাড়া পাসপোর্টের আবেদনপত্রে সত্যায়ন ও প্রত্যয়নের বিধানও বাতিল করার সুপারিশ করেছে টিআইবি।

সেইসঙ্গে পাসপোর্টের মেয়াদ পাঁচ বছরের বদলে দশ বছর করা, পাসপোর্টের আবেদনপত্র সহজবোধ্য করা, অনলাইনে আবেদনের পদ্ধতি আরও সহজ করা এবং ফি জমা দেওয়ার ক্ষেত্রে মোবাইল ব্যাংকিংয়ের সুযোগ দেওয়া এবং পাসপোর্ট অফিসগুলোতে জনবল বৃদ্ধির সুপারিশ করা হয়েছে প্রতিবেদনে।