১৩ বছরেও লাঘব হয়নি যে যন্ত্রণা

তের বছর আগের কথা। তারপরও ভুলে যাওয়ার মতো তো নয়ই, বরং শরীরে সেই দিনের ভয়াবহ স্মৃতি বয়ে বেড়াচ্ছেন অনেকেই। গ্রেনেডের স্প্লিন্টারের ব্যথাই ভুলতে দেয় না সেই দুঃসহ স্মৃতি।

কাজী মোবারক হোসেন নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 August 2017, 06:14 PM
Updated : 20 August 2017, 06:55 PM

২০০৪ সালের ২১ অগাস্ট বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে শেখ হাসিনার সমাবেশে ভয়াবহ গ্রেনেড হামলার ১৩ বছর পূর্তিতে আহতদের কয়েকজন জানিয়েছেন তাদের সেই মানসিক আর শারীরিক যন্ত্রণার কথা।

ওইদিন বিকালে আওয়ামী লীগের পূর্বনির্ধারিত সন্ত্রাসবিরোধী শোভাযাত্রার কর্মসূচি ছিল। শেখ হাসিনার বক্তব্যের পরই তা শুরুর কথা ছিল। কিন্তু গ্রেনেড হামলায় স্তব্ধ হয়ে যায় সেই কর্মসূচি।

হামলায় প্রাণ হারান আওয়ামী লীগের মহিলা বিষয়ক সম্পাদক ও প্রয়াত রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ ২৪ জন, আহত হন কয়েকশ মানুষ। সেদিন বেঁচে গেলেও স্থায়ীভাবে শ্রবণশক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হয় বর্তমান প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার।

সেদিনের বিভীষিকাময় কয়েক মুহূর্তের ঘটনা তুলে ধরার পাশাপাশি নিজেদের বর্তমান অবস্থার কথা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন বেঁচে যাওয়া কয়েকজন।

সেদিন অনেকের সঙ্গে আহত হয়েছিলেন যুব মহিলা লীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সদস্য রত্না আক্তার রুবী। আঘাতের যন্ত্রণা থেকে মুক্তি পেতে মাঝে মাঝে চিকিৎসা নিলেও এখন অবস্থা অবনতির দিকে যাচ্ছে বলে জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, “ওই দিনটির কথা মনে হলেই ভাবি আমি বুঝি মৃত্যুর খুব কাছাকাছি থেকে বেঁচে আসছি। স্প্লিন্টারের আঘাতের সাড়ে ১২ বছর পর শরীরে পানি জমায় বঙ্গবন্ধু মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ে সাত মাস ধরে চিকিৎসা নিয়ে চলতি মাসে ছাড়া পেয়েছি। তবে শরীরের অবস্থা খুব ভালো নেই, ভাই স্প্লিন্টারের কষ্টের থেকে মরে যাওয়া ভালো, আর বেঁচে থাকতে চাই না।”

প্রধানমন্ত্রীর অনুদান কয়েকবার পেলেও দলের পক্ষ থেকে কোনো সহায়তা না পাওয়ায় নেতাদের প্রতি ক্ষুব্ধ ক্ষমতাসীন দলের সহযোগী সংগঠনের এই নেতা।

“সাত মাস হাসপাতালে থাকলেও কেউ দেখতে যাননি,” বলেন রুবী।

ওই দিনের ঘটনা বর্ণনা করেন আহত মহিলা আওয়ামী লীগের সাবেক সদস্য ফরিদা আক্তার।

ফাইল ছবি

“নেত্রী যখন মঞ্চ থেকে নেমে আসেন ঠিক ওই সময় হঠাৎ করে শব্দ। তারপর চতুর্দিকে আওয়াজ, কী হচ্ছে কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। দেখি আশপাশে সবাই শুয়ে আছে। এক ভাই আমাকে হাসপাতালে নিয়ে যাচ্ছে এতটুকু বুঝতে পেরেছি। তারপর আর জ্ঞান ছিল না।

“তবে ওই কয়েক সেকেন্ডের দৃশ্য চোখের সামনে ভেসে আসলে গা শিউরে ওঠে। আর এই অনুভবটা হয় যখনই শরীরের ভিতরে অসংখ্য স্প্লিন্টারের ব্যথা অনুভব করি।”

চিকিৎসার কথা জানতে চাইলে বলেন, “অনেকেই উন্নত চিকিৎসা করেছেন। তবে তখন যোগাযোগ না করার কারণে আমি নিজস্বভাবেই চিকিৎসা করেছি।”

কোনো অস্ত্রোপচার ছাড়াই চলছেন জানিয়ে ফরিদা বলেন, “বাচ্চাদের নিয়ে যেমনই আছি, চলতেছি। তবে শরীরের ভেতরের স্প্লিন্টার কম থাকলেও চলাফেরার কারণে মাঝে মধ্যে অসহ্য যন্ত্রণা হয়।”

সেদিন সমাবেশে বক্তব্য শেষে শেখ হাসিনা মঞ্চ থেকে নামার সময় সিঁড়ির পাশেই ছিলেন আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় সদস্য ইকবাল হোসেন অপু। গ্রেনেড বিস্ফোরণে তার দুই পা স্প্লিন্টারে ঝাঁঝরা হয়ে যায়। ডান পায়ের মাংস পেশি, বাঁ হাঁটু ও পায়ের পাতায় এখনো স্প্লিন্টারের ব্যথা অনুভব করেন।

“স্প্লিন্টারের ব্যথা শরীরের সাথে ওতপ্রোতভাবে জড়িয়ে গেছে। সারা বছরই চিকিৎসা নিতে হচ্ছে। স্প্লিন্টারের কারণে শারীরিকভাবে কোনো শান্তি নেই। সবসময় নেতাকর্মীদের সাথে সময় কাটিয়ে ব্যথা ভুলে থাকার চেষ্টা করি।”

সেদিনের ঘটনা এখনো তার মনে গেঁথে রয়েছে; ১৩ বছরে এক মুহূর্তের জন্যও ভোলেননি।

তিনি বলেন, “নেত্রী মঞ্চ থেকে নামছেন। হঠাৎ মুহুর্মুহু শব্দ। আমি পড়ে গেলাম। শরীরের কোথাও আঘাত পেয়েছি কি না বুঝতে পারছি না। উঠে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছি, কিন্তু পারছিলাম না। তবে বুঝতে পারছিলাম, এই বুঝি সবাইকে মেরে ফেলা হচ্ছে।

“২১ অগাস্টের কথা মনে পড়লেই মনে হয় আল্লাহর অশেষ রহমতে আমাদের নেত্রী বেঁচে গেছেন। সাথে অমিও মৃত্যুর খুব কাছাকাছি থেকে ফিরে এসেছি।”

শরীরে প্রায় সাড়ে পাঁচশ স্প্লিন্টারের ব্যথা বয়ে বেড়াচ্ছেন স্বেচ্ছাসেবক লীগের সদস্য লিটন মোল্লা জানালেন, গ্রেনেড হামলার পর থেকেই ভুগছেন হৃদযন্ত্রের সমস্যায়।

“বাম পায়ে সবচেয়ে বেশি ব্যথা অনুভব করি। কোনো কাজ করতে গেলেই বাম পায়ে সমস্যা দেখা দেয়। প্রথমে ঢাকা মেডিকেল, বঙ্গবন্ধু হাসপাতাল হয়ে ট্রমা সেন্টারে চিকিৎসা নিয়েছি। এখন যে অবস্থা চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাওয়া ছাড়া উপায় নাই।”

ভয়াল সেদিনের স্মৃতিচারণ করে ‘২১শে আগস্ট গ্রেনেড হামলা বাংলাদেশ’ নামক সংগঠনের সাধারণ সম্পাদক নাজিম উদ্দিন নাজিম বলেন, “হঠাৎ বিকট একটা শব্দ শোনার পর অনেকেই বুঝতে পারিনি কী হয়েছিল। এরপর কয়েকটা বিকট শব্দ হয়। চারদিকে মানুষ ছোটাছুটি করছিল। আর্তচিৎকারে একটা ভয়াবহ পরিবেশ তৈরি হয়েছিল।”

শুরু থেকে চিকিৎসা চললেও ব্যথা এখনও ছাড়েনি জানিয়ে তিনি বলেন, “মনে হয় যত দিন যাচ্ছে স্প্লিন্টারের ব্যথা বাড়তেছে। ভারত থেকে কয়েকবার চিকিৎসা নেওয়ার পরও শরীরে অসংখ্য স্প্লিন্টার। ভারী কাজ করতে গেলেই ওই দিনের কথা মনে পড়ে।”

বিএনপি-জামায়াত জোট সরকার আমলে চালানো ওই হামলার লক্ষ্য যে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনাই ছিলেন, তা পরে তদন্তে বেরিয়ে আসে।

সে সময় ঘটনার তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করা হয়, যা পরে উন্মোচিত হয়, আসামি হিসাবে এখন বিচারের সম্মুখীন ওই সময়ের তদন্ত কর্মকর্তারাও।

অধিকতর তদন্তের পর এখন মামলার আসামির তালিকায় তখনকার স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবরের সঙ্গে যোগ হয়েছেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার ছেলে তারেক রহমানও।