হাসিনাকে হত্যাচেষ্টা: ফায়ারিং স্কোয়াডে ১০ জনের প্রাণদণ্ড

গোপালগঞ্জের কোটালীপাড়ায় শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টার অভিযোগে দায়ের করা মামলায় দশ আসামির সর্বোচ্চ সাজার রায় দিয়েছে আদালত।

আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 August 2017, 05:51 AM
Updated : 20 August 2017, 06:48 PM

ঢাকার ২ নম্বর দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মমতাজ বেগম রোববার এই রায় ঘোষণা করে বলেন, “হাই কোর্টে বিভাগের অনুমোদন সাপেক্ষে মৃত্যু না হওয়া পর্যন্ত নির্ধারিত পদ্ধতিতে গুলি করে দশ আসামির দণ্ড কার্যকর করা হোক।”

সতের বছর আগের ওই ঘটনায় বিশেষ ক্ষমতা আইন ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের দুটি মামলায় আরও সাত আসামিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দিয়েছে আদালত।

মামলায় অভিযোগপত্রভুক্ত ২৫ আসামির মধ্যে হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আবদুল হান্নানের ফাঁসি কার্যকর হয়েছে অন্য একটি মামলায়। এ কারণে তার নাম মামলা থেকে বাদ দেওয়া হয়।

বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলায় আসামিদের বিরুদ্ধে নাশকতা ও গুরুতর অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতার অভিযোগ আনা হয়েছিল, যার সর্বোচ্চ শাস্তি ছিল মৃত্যুদণ্ড।

মুফতি হান্নান বাদে মামলার বাকি ২৪ আসামির মধ্যে ১০ জনের মৃত্যুদণ্ড; একজনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও ১০ হাজার টাকা জরিমানা; তিনজনকে ১৪ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড, ১০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড, অনাদায়ে আরও এক বছরের সশ্রম কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।

অপরাধে সংশ্লিষ্টতা সন্দেহাতীতভাবে প্রমাণিত না হওয়ায় এ মামলার ১০ আসামি আদালতের রায়ে খালাস পেয়েছেন।

শেখ হাসিনাকে কোটালীপাড়ায় হত্যাচেষ্টা মামলার রায় হয়েছে এই আদালতে

বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায় মুফতি হান্নান বাদে আসামি ছিলেন ১৩ জন। তাদের মধ্যে নয় জনকে ২০ বছর করে সশ্রম কারাদণ্ড এবং ২০ হাজার টাকা করে অর্থদণ্ড দেওয়া হয়েছে। খালাস পেয়েছেন চারজন।

দুই মামলায় সব মিলিয়ে আসামি ছিলেন ২৬ জন। তাদের মধ্যে দুই মামলাতেই সাজা হয়েছে ৬ জনের; আটজন খালাস পেয়েছেন।

মুফতি হান্নানের দুই ভাই মো. মহিবুল্লাহ, আনিসুল ইসলাম আনিস মুন্সির ২০ বছর কারাদণ্ড হয়েছে। তার ভগ্নিপতি সারোয়ার হোসেন মিয়ার হয়েছে ১৪ বছর কারাদণ্ড। মহিবুল্লাহ ও আনিস কারাগারে থাকলেও পালিয়ে আছেন সারোয়ার।

কোটালীপাড়ার একটি কলেজের কাছে ২০০০ সালের ২০ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার জনসভামঞ্চের নির্ধারিত স্থান ও হ্যালিপ্যাডে মাটিতে পুঁতে রাখা ৭৬ ও ৮০ কেজি ওজনের দুটি বোমা পাওয়ার পর এই মামলা করে পুলিশ।

রায়ের পর এ মামলায় রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী সৈয়দ শামসুল হক বাদল বলেন, তিনি ‘আংশিক সন্তুষ্ট’। রায়ের কপি পাওয়ার পর আপিলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবেন।

অন্যদিকে আসামিপক্ষের অন্যতম আইনজীবী ফারুক আহম্মেদ বলেন, তার মক্কেলদের ‘টাকা পয়সা নেই’। তারা জেল আপিল করবেন।

দণ্ডাদেশ পাওয়া আসামিরা এই রায়ের ৩০ দিনের মধ্যে হাই কোর্টে আপিল করার সুযোগ পাবেন।

কার কেমন সাজা

আসামি

কোথায় আছে

বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলা

বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলা

ওয়াসিম আক্তার ওরফে তারেক হোসেন ওরফে মারফত আলী

কারাগারে

মৃত্যুদণ্ড

২০ বছর সাজা

রাশেদ ড্রাইভার ওরফে আবুল কালাম ওরফে রাশেদুজ্জামান ওরফে শিপন

কারাগারে

মৃত্যুদণ্ড

২০ বছর সাজা

মাওলানা শওকত ওসমান  ওরফে  শেখ ফরিদ

কারাগারে

মৃত্যুদণ্ড

--

আবু বক্কর ওরফে হাফেজ সেলিম হাওলাদার

কারাগারে

মৃত্যুদণ্ড

--

হাফেজ মো ইয়াহিয়া

কারাগারে

মৃত্যুদণ্ড

--

আব্দুর রউফ ওরফে মুফতি আব্দুর রউফ ওরফে আ. রাজ্জাক ওরফে আবু ওমর

কারাগারে

মৃত্যুদণ্ড

--

ইউসুফ ওরফে মোহসাব মোড়ল

পলাতক

মৃত্যুদণ্ড

২০ বছর সাজা

হাফেজ জাহাঙ্গীর আলম বদর

পলাতক

মৃত্যুদণ্ড

--

মুফতি শফিকুর রহমান

পলাতক

মৃত্যুদণ্ড

--

মুফতি আ. হাই

পলাতক

মৃত্যুদণ্ড

--

মেহেদী  হাসান ওরফে আব্দুল ওয়াদুদ ওরফে গাজী

কারাবন্দি

যাবজ্জীবন

২০ বছর সাজা

আনিসুল ইসলাম আনিস

কারাগারে

১৪ বছর সাজা

২০ বছর সাজা

মহিবুল্লাহ ওরফে মফিজুর রহমান

কারাগারে

১৪ বছর সাজা

২০ বছর সাজা

সারোয়ার হোসেন মিয়া

পলাতক

১৪ বছর সাজা

--

আরিফ হাসান সুমন ওরফে আব্দুর রাজ্জাক

কারাবন্দি

খালাস

--

মাওলানা সাব্বির

কারাবন্দি

খালাস

--

মাহমুদ আজহার

কারাবন্দি

খালাস

২০ বছর সাজা

আবুল হোসেন ওরফে খোকন

কারাবন্দি

খালাস

খালাস

কামাল উদ্দিন সাকের

পলাতক

খালাস

--

মুন্সি ইব্রাহিম

পলাতক

খালাস

খালাস

মো. শাহনেওয়াজ ওরফে আজিজুল হক

পলাতক

খালাস

২০ বছর সাজা

মো. লোকমান

পলাতক

খালাস

খালাস

শেখ মো. এনামুল হক

পলাতক

খালাস

২০ বছর সাজা

মিজানুর রহমান

পলাতক

খালাস

--

হাসমত আলী কাজী

জামিনে

--

খালাস

* মোট আসামি ২৬ জন, তাদের মধ্যে ১২ জন দুই মামলারই আসামি

** দুই মামলাতেই সাজা হয়েছে ৬ জনের, এর মধ্যে তিনজনের মৃত্যুদণ্ডের রায় হয়েছে এক মামলায়

** বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলায় খালাস পেলেও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায় সাজা হয়েছে তিনজনের

বিচারক রায় ঘোষণার পর কাঠগড়ায় দাঁড়ানো দণ্ডিতদের নির্বিকার দেখা যায়। তাদের কোনো আত্মীয়কে এ সময় এজলাসে দেখা যায়নি।

এ মামলার বিচারে ১৭ বছর লাগল কেন জানতে চাইলে রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলি সৈয়দ শামসুল হক বাদল বলেন, “সাক্ষী আনা যায়নি বলে মামলার বিচারে দেরি হয়েছে।”

বিচারে বিলম্বের কারণ বা মামলার বিষয়ে বিশেষ কোনো পর্যবেক্ষণ এ রায়ে আসেনি বলে ট্রাইবুনালের পেশকার ইমরুল ইসলাম জানান।

ফায়ারিং স্কোয়াড

আইনজীবীরা জানান, বাংলাদেশের নিম্ন আদালতে এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মত ফায়ারিং স্কোয়াডে গুলি করে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের রায় এল।

বিশেষ ক্ষমতা আইনের মামলা হওয়ায় এবং ওই আইনে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের সুযোগ থাকায় দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালের বিচারক মমতাজ বেগম এই রায় দিয়েছেন।

ফৌজদারী কার্যবিধির ৩৬৮ ধারায় বলা হয়েছে, আসামির মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে হবে আমৃত্যু ফাঁসিতে ঝুলিয়ে। আর ১৯৭৪ সালের বিশেষ ক্ষমতা আইনের ৩৪ (ক) ধারায় বলা হয়েছে, এ আইনের অধীনে মৃত্যুদণ্ড হলে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে অথবা মৃত্যু পর্যন্ত গুলি চালিয়ে তা কার্যকর করা যাবে।

বাংলাদেশে ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড কার্যকরের কোনো উদাহরণ নেই। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় আসামিদের ফায়ারিং স্কোয়াডে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করতে বলা হলেও হাই কোর্টে তা বহাল থাকেনি।

বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার পর ২০১৫ সালে যুদ্ধাপরাধ মামলার পলাতক আসামি হিসাবে কিশোরগঞ্জের রাজাকার কমান্ডার হাসান আলীকে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে অথবা মৃত্যু পর্যন্ত গুলি চালিয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করার রায় দিয়েছিল আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। এরপর আরও কয়েকটি মামলায় একইভাবে সাজা কার্যকরের রায় এসেছে ট্রাইব্যুনালে, তবে সেগুলোর কোনোটিই এখনও কার্যকর হয়নি।   

কোটালীপাড়ার শেখ লুৎফর রহমান মহাবিদ্যালয়ের সেই মাঠ

ঘটনাক্রম

২০০০ সালের ২০ জুলাই কোটালীপাড়ার শেখ লুৎফর রহমান মহাবিদ্যালয়ের উত্তর পাশে তখনকার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাষণের জন্য মঞ্চ নির্মাণের সময় মাটিতে পুঁতে রাখা ৭৬ কেজি ওজনের বোমা পাওয়া যায়। পরদিন ৮০ কেজি ওজনের আরও একটি বোমা উদ্ধার করা হয় কোটালীপাড়ার হেলিপ্যাড থেকে।

তার এক দিন পর নিজের নির্বাচনী এলাকায় দাদার নামে প্রতিষ্ঠিত ওই কলেজ মাঠে জনসভায় শেখ হাসিনার ভাষণ দেওয়ার কথা ছিল।

ওই ঘটনায় কোটালীপাড়া থানার উপপরিদর্শক নূর হোসেন বাদী হয়ে হত্যাচেষ্টা ও বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে মামলা করেন।

সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার মুন্সি আতিকুর রহমান তদন্ত শেষে ২০০১ সালের ৮ এপ্রিল যে অভিযোগপত্র দেন, তাতে আসামি করা হয় ১৬ জনকে। পরে ২০০৯ সালের ২৯ জুন নতুন করে ৯ জনকে অন্তর্ভুক্ত করে সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়।

গোপালগঞ্জের আদালতে সম্পূরক অভিযোগপত্রটি যখন দেওয়া হয়, ততদিনে ওই আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে ৪১ জনের সাক্ষ্য শেষ হয়ে গিয়েছিল। পরে গুরুত্ব বিবেচনায় দ্রুত নিষ্পত্তির জন্য ২০১০ সালের সেপ্টেম্বরে মামলা দুটি ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনালে পাঠানো হয়।

শেখ হাসিনাকে হত্যাচেষ্টাসহ হরকাতুল জিহাদের ১৩টি নাশকতামূলক ঘটনায় শতাধিক ব্যক্তিকে হত্যার পেছনে মূল ব্যক্তি হিসেবে মুফতি হান্নানকে দায়ী করা হয়।

শেখ হাসিনার নিজের জেলা গোপালগঞ্জেই মুফতি হান্নানের বাড়ি৷ পাকিস্তানের মাদ্রাসায় পড়তে গিয়ে তার জঙ্গিবাদে হাতেখড়ি। আফগানিস্তান সীমান্তে যুদ্ধেও অংশ নিয়েছিলেন তিনি।

২০০৫ সালের ১ অক্টোবর ঢাকার বাড্ডা থেকে গ্রেপ্তার হওয়ার পর থেকে এই জঙ্গি নেতা কারাগারেই ছিলেন। ২০০৪ সালে ব্রিটিশ হাই কমিশনার আনোয়ার চৌধুরীকে হত্যার চেষ্টায় গ্রেনেড হামলার ঘটনায় চলতি বছর ১২ এপ্রিল তার ফাঁসি কার্যকর করা হয়।

বোমাগুলো উদ্ধারের সময় মুফতি হান্নানের মালিকানাধীন গোপালগঞ্জে হেমাঙ্গন আবাসিক এলাকার ভাড়া করা একতলা বাসা থেকে বোমা বানানোর সরঞ্জাম উদ্ধার করা হয়। ওই বিস্ফোরক সরবরাহ করা হয়েছিল হান্নানের সোনার বাংলা সাবানের কারখানা থেকে।