রায়ে সর্বোচ্চ আদালতকে ‘জনগণের মুখোমুখি দাঁড় করানো হয়েছে’

ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহা যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন তার ‘৯০ ভাগই অপ্রাসঙ্গিক’ অভিযোগ করে পুরো রায়টিই বাতিলের দাবি এসেছে রাজধানীতে অনুষ্ঠিত এক আলোচনা সভা থেকে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 August 2017, 08:48 PM
Updated : 19 August 2017, 08:54 PM

এই রায়ের মাধ্যমে জাতিকে শুধু বিভক্তই করা হয়নি, দেশের সর্বোচ্চ আদালতকেও ‘জনগণের মুখোমুখি’ দাঁড় করানো হয়েছে বলেও অভিযোগ করেছেন আলোচকরা।

শনিবার ধানমন্ডির ডব্লিউভিএ মিলনায়তনে ‘বঙ্গবন্ধু ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’  শীর্ষক আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, ঘাতক নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা ও সাবেক বিচারপতি শামসুল হুদা, বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক, সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ ও নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবিরসহ কয়েকজন।

মন্ত্রী মোজাম্মেল হক বলেন, “বঙ্গবন্ধু জনগণের ম্যান্ডেট নিয়ে নেতা হয়েছিলেন, গায়ের জোরে না। আমাদের প্রধান বিচারপতি যদি এ ইতিহাস দেখতে না পান, তাহলে বিনয়ের সঙ্গে জিজ্ঞেস করি- স্বাধীনতার সময় বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কে ছিলেন?

“আপনার প্রভু আইয়ুব খান? আপনার প্রভু ইয়াহিয়া খান? টিক্কা খান, না জিয়াউর রহমান না মোস্তাক? দ্বিতীয় বা তৃতীয় নেতা আর কে কে ছিলেন- দেশবাসী তা জানতে চায়। এই প্রশ্নের জবাব দিতেই হবে।”

বিচারপতি জয়নুল আবেদিনের বিরুদ্ধে দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্ত বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে দাবি করে তিনি বলেন, “আজ সংসদকে নিয়ে কটাক্ষ করেন, আরে আপনিতো চোরেরে ঠ্যাক দেন। চোরের আশ্রয়দাতা ও প্রশ্রয়দাতা। আপনি শপথ ভঙ্গ করেছেন।”

প্রধান বিচারপতি পদে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছেন মন্তব্য করে মোজাম্মেল বলেন, “তিনি (প্রধান বিচরপতি) এই চেয়ারে বসে বলেছেন, ‘আমি দিনের বেলায় শান্তি কমিটির হয়ে কাজ করতাম, তবে রাতে মুক্তিযোদ্ধাদের হয়ে কাজ করেছি। ডাবল স্ট্যান্ডার্ড। আপনার জীবনটা শুরু করেছেন মুনাফেকি করে। এটা আপনার ভাষ্য। আপনার মুনাফেকি চরিত্র কি এখনও বজায় রেখেছেন?

“প্রধান বিচারপতির চেয়ারে বসে এখনও কি মুনাফেকি করে যাচ্ছেন? তাই যদি হয়, তবে একজন মুনাফেকের প্রধান বিচারপতির আসনে বসার কোনো অধিকার থাকে না বলে আমরা মনে করি।”

ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় পড়া শুরু করেছেন জানিয়ে নির্মূল কমিটির উপদেষ্টা ও সাবেক বিচারপতি শামসুল হুদা বলেন, “জিয়াউর রহমানের কথায় আমরা দেশ স্বাধীন করিনি। বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বেই মুক্তিযুদ্ধে গিয়েছি, দেশ স্বাধীন করেছি।”

ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ে কারও ‘একক নেতৃত্বে’ দেশ স্বাধীন হয়নি এমন পর্যবেক্ষণের বিষয়ে সাবেক এই বিচারপতি বলেন, “তিনি (প্রধান বিচারপতি) হয়ত ইতিহাস জানেন না। কাজেই একথা বলার সাহস তিনি পেয়েছেন।”

এই রায়ের মাধ্যমে প্রধান বিচারপতি দেশকে বিভক্তির দিকে নিয়ে যাচ্ছেন অভিযোগ করে তিনি বলেন, “অবাঞ্ছিত বক্তব্য এক্সপাঞ্জ করলেই হবে না, সম্পূর্ণ রায়টাই রিভিউ আকারে আনতে হবে।”

প্রধান বিচারপতিকে উদ্দেশ্য করে তিনি বলেন, “অনেক পলিটিক্স করেছেন, আপনার রায় নিয়ে পড়াশুনা শুরু করেছি। এই কোড অব কন্ডাক্ট আজকের না। এটি মোডিফাইড করেছেন ভালো কথা, সেখানে বলা আছে, কোনো রাজনৈতিক ব্যক্তির সঙ্গে কথা বলতে পারেন না।

“তাহলে কোন কোড অব কন্ডাক্টে আপনি ওবায়দুল কাদেরের সঙ্গে কথা বলেছেন? তাহলে তো আপনি ফখরুলের সঙ্গেও কথা বলতে পারেন। সাকার সঙ্গেও কথা বলে থাকতে পারেন। জুডিশিয়ারির এই চেয়ারটিকে আর কলঙ্কিত করবেন না।”

কমিটির আরেক উপদেষ্টা সুপ্রিম কোর্টের সাবেক বিচারপতি শামসুদ্দিন চৌধুরী মানিক বলেন, “এই দেশ স্বাধীন হয়েছে একজনের নেতৃত্বে। যার জন্ম না হলে বিচারক তো দূরের কথা, আইনজীবীও হতে পারতেন না।”

প্রধান বিচারপতি রায়ে যে পর্যবেক্ষণ দিয়েছেন তার ‘৯০ ভাগই অপ্রাসঙ্গিক’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “এই রায়কে আমি পুঁথি ছাড়া আর কিছু বলতে পারছি না। এ রায় দেখে আমার বারবারই মনে হয়েছে, এটা কি কোনো আইনজ্ঞের লেখা? নাকি এমন কোন ব্যক্তির লেখা- যিনি আইনজ্ঞ নন, কিন্তু ইংরেজিতে খুব ভালো। এই প্রশ্নটি কিন্তু এসে গেছে।”

এ ধরনের পর্যবেক্ষণ দিয়ে প্রধান বিচারপতি সুপ্রিম কোর্ট ও জনগণকে মুখোমুখি দাঁড় করিয়েছেন বলেও অভিযোগ করেন বিচারপতি মানিক।

প্রধান বিচারপতি রায়ে ‘মিথ্যাচার’ করেছেন অভিযোগ করে তিনি বলেন, “সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক সাহেবের মতে- তিনি (প্রধান বিচারপতি) অসদাচরণ করেছেন, শপথ ভঙ্গ করেছেন।

“পাকিস্তানের গোয়েন্দা সংস্থা আইএসআইয়ের শক্তিতে তিনি শপথ ভঙ্গ করেছেন। এই কথাটি গত সপ্তাহে একটি পত্রিকাতেও এসেছে। একটি দেশবিরোধী অসাংবিধানিক শক্তিকে ক্ষমতায় আনার জন্যই তিনি কাজ করছেন। যেহেতু তিনি এ কাজ করেছেন, সেহেতু তিনি শপথ ভঙ্গ করেছেন।”

প্রধান বিচারপতি বর্তমান সরকারকে উৎখাতে ষড়যন্ত্র করছেন বলেও অভিযোগ করেন বিচারপতি মানিক।

“আমি বলব, প্রধান বিচারপতির একটা এজেন্ডা আছে, বর্তমান সরকারকে উৎখাত করে একটি অপশক্তিকে ক্ষমতায় বসানো। আমরা শঙ্কিত, এই প্রধান বিচারপতি আরও পাঁচ মাস আছেন। এই পাঁচ মাসে তার থলে থেকে আর কী কী বের হবে তা নিয়ে আমরা শঙ্কিত, অনেকেই শঙ্কিত।”

সূচনা বক্তব্যে নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে হাই কোর্টে রিট মামলা চলছে।

“কিন্তু প্রধান বিচারপতিসহ সুপ্রিম কোর্টের জাজরা ৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে মন্তব্য করে হাই কোর্টকে প্রভাবিত করছেন।৭০ অনুচ্ছেদ নিয়ে হাই কোর্টের রায়ে যদি আমি সংক্ষুব্ধ হই, আপিলের জন্য তাহলে আমি কোথায় যাব? আপিলের পথ বন্ধ করে দিলেন।”

সুপ্রিম কোর্টের রায়ে আইনের শাসনের ‘লঙ্ঘন দেখা যাচ্ছে’ অভিযোগ করে তিনি বলেন, “আমাদের দাঁড়াবার জায়গা তারা রাখছেন না। ফলে একটি-দুটি শব্দ এক্সপাঞ্জ করলে হবে না, পুরো রায়টাই এখানে বাতিল করার বিষয় রয়েছে।

“কারণ এই রায় দিয়ে আপনি (প্রধান বিচারপতি) প্রজাতন্ত্রকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। প্রজাতন্ত্রের মালিকানাকে চ্যালেঞ্জ করেছেন। আমাদের সেবক হয়ে এটা আপনারা পারেন না।”

আলোচনায় সভাপতিত্ব করেন সাবেক আইনমন্ত্রী শফিক আহমেদ।

৭০ অনুচ্ছেদের দোহাই দিয়ে যে পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়েছে তা ‘সঠিক নয়’ মন্তব্য করে তিনি বলেন, “বিচারকদের অসদাচরণ প্রমাণ করতেও আইনের দরকার আছে। এ বিষয়েও আইন করতে হবে।

“এই রায়ে বিনা কারণে রাষ্ট্রের একটি অঙ্গ সম্পর্কে আলোচনা করা হয়েছে। যদিও এটি বিচারের অংশ ছিল না। রাষ্ট্রের তিনটি অঙ্গের কাজ কী তা সংবিধানে স্পষ্ট করে বলা আছে।”

রায়ে এমন কোনো পর্যবেক্ষণ দেওয়া উচিত না যা রাষ্ট্রের অন্য অঙ্গকে এফেক্ট করে- বলেন শফিক আহমেদ।

অন্যদের মধ্যে নির্মূল কমিটির সহ-সভাপতি শহীদ জায়া শ্যামলী নাসরিন চৌধুরী ও ফেরদৌসী প্রিয়ভাষিণী আলোচনায় অংশ নেন।