‘চিত্রকলার ইতিহাস রচনায় মুর্তজা বশীরের শরণ নিতে হবে’

চিত্রকলার বিকাশের ইতিহাস রচনায় মুর্তজা বশীরের শরণাপণ্ন নিতেই হবে বলে মন্তব্য করেছেন ইমেরিটাস অধ্যাপক ড. আনিসুজ্জামান।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 August 2017, 03:20 PM
Updated : 17 August 2017, 03:20 PM

বাংলাদেশের চিত্রকলার অন্যতম পথিকৃৎ শিল্পী মুর্তজা বশীরের ৭৫তম জন্মদিনের আয়োজনে এসে এমনই মন্তব্য করেন তিনি।

চিত্রশিল্পী এবং ভাষা আন্দোলনের সক্রিয় কর্মী মুর্তজা বশীরের জন্ম ১৯৩২ সালের ১৭ অগাস্ট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রমনা এলাকায়।

বৃহস্পতিবার বিকালে এশিয়াটিক সোসাইটিতে আমিনা বশীর মেমোরিয়াল ট্রাস্ট ফান্ড আয়োজন করে আমিনা বশীর স্মৃতি বক্তৃতা। এতে ‘মুর্তজা বশীর: মানুষ ও শিল্পী’ শিরোনামে একক বক্তব্য দেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।

বক্তব্যের শুরুতে তিনি জানান ১৯৫০ সালে মার্কসবাদী বিপ্লবে বিশ্বাসী কমিউনিস্ট পার্টির সদস্য মুর্তজা বশীরের সঙ্গে প্রথম সাক্ষাতের কথা।

আরভিং স্টোনের ‘লাস্ট ফর লাইফ’ ও সমারসেট মমের ‘দ্য মুন অ্যান্ড সিক্স পেন্স’ বই দুটির উদাহরণ দিয়ে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, “বই দুটি যথাক্রমে ভিনস্যান্ট ভ্যান গঘ ও পল গঁগার জীবন অবলম্বনে রচিত। বশীর স্থির করলেন, ওই দুই মহান শিল্পীর মতো তিনিও বোহেমিয়ান জীবনযাপন করবেন। সে জীবন যে শিল্পী হিসেবে প্রতিষ্ঠা লাভের অন্তরায় নয়, তা তিনি ভালো করেই জানতেন।”

ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র ছোট ছেলে মুর্তজা বশীর বাবার প্রতি বেশ ‘ক্ষুব্ধ’ ছিলেন বলেও উল্লেখ করেন বক্তব্যে।

“ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ্র পুত্র বলে তার পরিচয় দিলে তিনি খুবই অসন্তুষ্ট হতেন। বলতেন, আমি নিজের পরিচয়ে পরিচিত হতে চাই।পিতার শাসনও তিনি সহ্য করতে পারতেন না।”

সাহিত্য-সাময়িকী ‘কালি ও কলম’ এ মুর্তজা বশীরের আঁকা ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহর স্কেচগুলো যেকোনো বিচারে অসাধারণ বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

মুর্তজা বশীর ইতালীর ফ্লোরেন্সে আকাদেমিয়া দ্য বেল্লি আর্টিতে এক বছর চিত্রকলা এবং আরেক বছর ফ্রেসকো নিয়ে পড়াশোনা করেন।

‘দেয়াল’, বাসনা’, ‘আবহমান’, ‘যখন বাতাস বয়’, ‘ঢেউ’, ‘ধ্বংস’, ‘বিষ্ফোরণ’, ‘আনোয়ারা’, ‘সালেহা’, ‘দ্য উইংস’, ‘রিভিউ’, ‘শিরোনামহীন’, ‘শহীদ শিরোনাম’, ‘কালেমা তাইয়্যেবা’ ও ‘পাখা’ শিল্পী মুর্তজা বশীরের আঁকা উল্লেখযোগ্য সিরিজ।

তিনি ‘বিমূর্ত বাস্তবতা’ নামে একটি শিল্পধারার প্রবর্তক। এছাড়া তার ফিগারেটিভ কাজে পূর্ব-পশ্চিমের মেলবন্ধন দেখা যায়।

শিল্পী জীবনের গোঁড়ায় মুর্তজা বশীর উডকাট, লিনোকাট আর জলরঙে ছবি আঁকলেও পরে ঝোঁকেন অয়েল পেইন্টিংয়ের দিকে। এচিং, অ্যাকুয়ান্টিক ও লিথোগ্রাফ করেছেন, মোজেক ও ম্যুরাল মাধ্যমে তিনি বেশকিছু কাজ করেছেন।

১৯৬৩ সাল পর্যন্ত মুর্তজা বশীর ‘গুরুত্বপূর্ণ ফিগারেটিভ চিত্রকর’ বলে গণ্য হতেন বলে উল্লেখ করেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।

মুর্তজা বশীরের শিল্পকর্ম নিয়ে তিনি বলেন, “বশীর নানা শিল্পমাধ্যমে ঘুরে ফিরে এসেছেন রৈখিক ড্রয়িংয়ে। তার ড্রইং অত্যন্ত শক্তিশালী। প্রথম দিকে নৌকা ও ঘরবাড়ি, নরনারী, পাখি ও মাছের যেসব ছবি তিনি এঁকেছেন, তাতে রয়েছে ড্রইংয়ের প্রাধান্য।”

শিল্পকর্মের পাশাপাশি মুর্তজা বশীর সাহিত্য ও চলচ্চিত্রেও প্রতিভার স্বাক্ষর রেখেছেন। মুর্তজা বশীরের প্রকাশিত গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে গল্পগ্রন্থ ‘কাচের পাখির গান’, কাব্যগ্রন্থ ‘ত্রসরেণু’, ‘তোমাকেই শুধু’, ‘এসো ফিরে অনুসূয়া’, ‘সাদায় এলিজি’,  উপন্যাস-‘আল্ট্রামেরিন’, ‘মিতার সঙ্গে চার সন্ধ্যা’, নির্বাচিত রচনা- ‘মুর্তজা বশীর :মূর্ত ও বিমূর্ত’, ‘আমার জীবন ও অন্যান্য’, গবেষণাগ্রন্থ ‘মুদ্রা ও শিলালিপির আলোকে বাংলার হাবশী সুলতান ও তৎকালীন সমাজ’ উল্লেখযোগ্য।

অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তার সাহিত্যকর্ম নিয়ে আলোচনায় বলেন, “তার কথাসাহিত্যে বর্ণিত ঘটনা তার জীবনে যেমন ঘটেছে, নাহলে তিনি তা প্রত্যক্ষ করেছেন।তেমনি কবিতায় ব্যক্ত প্রেম যার উদ্দেশ্যে তার একটা বাস্তব ভিত্তি আছে এবং নারী, সমাজ ও দেশ সম্পর্কে অভিব্যক্ত অনুভূতি বশীরের নিজের।

“বশীরের ছোটগল্প পরিণত ও শিল্পিত। এতে কোথাও কোথাও সমাজের প্রতি ব্যক্তির কর্তব্যবোধের বার্তা দিয়েছেন তিনি, যা কিনা তার বামপন্থী চিন্তার ফল। তার কবিতায় সমাজ ও স্বদেশ আছে, কিন্তু তুলনায় প্রবলভাবে আছে তার প্রেমানুভূতি। কবিতায়ও যেখানে তিনি আবেগকে সংহত করতে পেরেছেন, সেখানেই তার সার্থকতা।”

মুর্তজা বশীরকে ‘মুদ্রাবিশারদ’ ও ভারতীয় শিল্পকলার ‘গবেষক’ হিসেবেও উল্লেখ করেন তিনি।

মুর্তজা বশীরের ধর্মচিন্তা নিয়ে বললেন অধ্যাপক আনিসুজ্জামান।

“বশীর এখন ঘোষণা করেন, তিনি ধর্ম মানেন। নাস্তিক্য থেকে আস্তিক্যে রূপান্তর অসাধারণ কোনো ঘটনা নয়। কিন্তু যুক্তিবাদ থেকে সংস্কারে আত্মসমর্পণ সাধারণ ব্যাপার নয়।”

মুর্তজা বশীর বলেন, “আমি ছবি আঁকি। কিন্তু আশপাশের দেশে কী ঘটছে তা জানি না। তেমনি এখানে আমার জন্মদিনের অনুষ্ঠান আয়োজন করা হয়েছে কিন্তু স্ত্রীকে নিয়ে কোনো কথা হয়নি। এই বক্তৃতা অনুষ্ঠান আমার স্ত্রী আমিনা বশীরের নামে। তাই তাকে নিয়ে কিছু বললে আমার ভাল লাগত।”

চলতি বছর মে মাসে স্ত্রী আমিনা বশীরের মৃত্যুর পর তিনি গড়ে তুলেন আমিনা বশীর মেমোরিয়াল ট্রাস্ট ফান্ড। তার জন্মদিনের আয়োজনের মাধ্যমে এই ট্রাস্ট ফান্ড যাত্রা শুরু করল।

পরে মাকে নিয়ে বলেন ছোট মেয়ে মুনিজা বশীর।

অনুষ্ঠানে উপস্থিত ছিলেন এশিয়াটিক সোসাইটির সভাপতি আমিরুল ইসলাম চৌধুরী,  সাধারণ সম্পাদক ড. সাব্বির আহমেদ।