ইসির সংলাপে আস্থা অর্জনের তাগিদ সাংবাদিকদের

সংসদ নির্বাচনে সব দলের জন্য সমান সুযোগ তৈরির পাশাপাশি জনগণের আস্থা অর্জন করতে নির্বাচন কমিশনকে তাগিদ দিয়েছেন ইন্টারনেট সংবাদপত্র, টেলিভিশন ও রেডিওর জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 August 2017, 11:10 AM
Updated : 17 August 2017, 11:14 AM

সেই সঙ্গে সুষ্ঠু ভোট আয়োজনে বিদ্যমান আইনের সঠিক প্রয়োগ নিশ্চিত করার পরামর্শ এসেছে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে ইসির দ্বিতীয় দিনের সংলাপে।

বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমের ২৬ জন প্রতিনিধি বৃহস্পতিবার সকাল সোয়া ১০টা থেকে বেলা ১টা পর্যন্ত আগারগাঁওয়ের নির্বাচন ভবনে এই আলোচনায় অংশ নেন। 

প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদার সভাপতিত্বে চার নির্বাচন কমিশনার ও ইসির ভারপ্রাপ্ত সচিবের উপস্থিতিতে আলোচনা শেষে প্রশ্নোত্তর পর্বও ছিল।

জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের অধিকাংশই বলেছেন, নির্বাচনের সুষ্ঠু পরিবেশ তৈরির জন্য নির্বাচন কমিশনকেই যথাযথ পদক্ষেপ নিতে হবে।

কে ভোটে অংশ নেবে বা না নেবে- তা দলগুলোর রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়; তবে সম্ভব হলে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ইসি একাধিকবার মত বিনিময় করতে পারে বলে মত দেন সাংবাদিকদের কেউ কেউ। 

আলোচনায় তারা বলেন, যেসব দল ভোটে থাকবে, তাদেরসহ সব প্রার্থীর জন্য ‘লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড’ তৈরি করতে হবে ইসিকে। পরিস্থিতি বুঝে প্রয়োজনে সেনাবাহিনীকে রাখতে হবে মাঠে। আবার আগাম সেনাবাহিনী মোতায়েন নিয়ে ‘বিতর্কে’ জড়ানো থেকেও ইসিকে বিরত থাকার পরামর্শ এসেছে গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের কাছ থেকে।

রাষ্ট্রায়ত্ত বার্তা সংস্থা বাসসের প্রধান সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ বলেন, নির্বাচন কমিশনকে সংবিধান এবং আইন অনুযায়ী সঠিকভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে। আইনি প্রয়োগ ও নিরপেক্ষতা বজায় রাখলে সবার প্রশংসা পাবে কমিশন।

সেনাবাহিনীকে ‘জাতীয় গৌরব’ হিসেবে বর্ণনা করে তিনি বলেন, ভোটের মাঠে সেনাবাহিনী মোতায়েনের প্রয়োজন নেই। তবে পরিস্থিতি বিবেচনায় কমিশন যদি প্রয়োজন মনে করে, তাহলে স্ট্রাইকিং ফোর্স হিসেবে সেনা মোতায়েন করতে পারে বলে তিনি মত দেন।

সেনা মোতায়েন নিয়ে ‘আগাম বিতর্ক তৈরির’ পেছনে ‘বিশেষ মহলের মতলব’ রয়েছে বলেও মন্তব্য করেন আবুল কালাম আজাদ।

“সেনা মোতায়েন নিয়ে আগাম এত তর্ক কেন? ভোটের দিন কি কিছু হবে? তাদেরকে বিতর্কিত করার জন্যে কোনো মতলব রয়েছে কি না… এটা একটি রাজনৈতিক মতলব, সুকৌশলে এসব করা হচ্ছে।”

একাত্তর টিভির প্রধান সম্পাদক মোজাম্মেল বাবু বলেন, ভোটে সেনাবাহিনীর প্রয়োজন নেই। সেনাবাহিনীর ব্যবহার রাজনৈতিক কারণে হলে তা থেকে বিরত থাকতে হবে।

“নিরপেক্ষভাবে আইন ও সংবিধানের ভেতরে থেকে কাজ করতে হবে কমিশনকে। সব দলকে নিয়ে আলোচনা, ঐক্যমত বা সংলাপের দরকার নেই। জনগণের আস্থা অর্জন করতে হবে আপনাদের। কে এল, না এল- তা ইসির দেখার বিষয় নয়।”

ভোটের দিন ইসির নিজস্ব ওয়েবসাইটে দ্রুত ও সঠিক ফলাফল প্রচার এবং দেশের ৪০ হাজার ভোট কেন্দ্রে টিভি চ্যানেলের ক্যামেরা ব্যবহারের সুযোগ দেওয়ার পরামর্শ দেন মোজাম্মেল বাবু।

মাছরাঙ্গা টিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক রেজোয়ানুল হক রাজা বলেন, ভোটে যারা আসবে, তাদের জন্য সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। ভোটে সেনাবাহিনী মোতায়েন নিয়ে টানাহেঁচড়া না করাই ভালো। সব দলের অংশগ্রহণের জন্য পরিবেশ তৈরি রাখতে হবে, তবে কে ভোটে এল- না এলো, তা রাজনৈতিক বিষয়।

ডিবিসির সিইও মঞ্জুরুল ইসলাম বলেন, “পর্যবেক্ষকদের মধ্যে রাজনীতি রয়েছে, এ নিয়ে সতর্ক থাকতে হবে। পোলিং এজেন্ট যেন দলীয় না হয়- সে বিষয়েও সজাগ থাকতে হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশের সুযোগ নিয়ে দ্রুততম সময়ে কেন্দ্রভিত্তিক ফল কেন্দ্রীয়ভাবে প্রচারের উদ্যোগ নিতে হবে।”

নির্বাচনী ব্যয় বাস্তবসম্মত ও ভোটারদের জাতীয় পরিচয়পত্র ব্যবহার করে ভোট দেওয়ার বিধান চালুর পরামর্শ দেন তিনি।

নিউজ টোয়েন্টিফোরের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক হাসনাইন খুরশিদ বলেন, ইসির কাছে পর্যাপ্ত ক্ষমতা রয়েছে, তার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

“দলগুলোর আস্থা চূড়ান্তভাবে অর্জন সম্ভব নাও হতে পারে; তবে জনগণের আস্থা অর্জনে সব পদক্ষেপ নিতে হবে।”

প্রধান দুই দলের সঙ্গে ‘সিরিজ সংলাপে’র প্রস্তাব দেন বাংলাভিশনের বার্তা প্রধান মোস্তফা ফিরোজ।

তিনি বলেন, ভোটের মাঠে সেনাবাহিনী বা এলিট ফোর্স দিয়ে কোনো লাভ হবে না। আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে সমঝোতা হলে বাহিনীরও দরকার পড়বে না।

“সিরিজ সংলাপ, ৩০০ আসনে একাধিক দিনে ভোট ও ধর্মীয় দলগুলোর নিবন্ধন বাতিল করে গঠনতন্ত্র সংশোধন ও নাম পরিবর্তনের উদ্যোগ নিতে হবে,” বলেন তিনি। 

উপস্থিতি

গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপের দ্বিতীয় দিনে অনলাইন, টেলিভিশন ও রেডিওর ৩৪ জনকে আমন্ত্রণ জানিয়েছিল ইসি।

ইসির তালিকার ক্রমানুসারে তাদের মধ্যে বাসসের প্রধান সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ, এনটিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক খায়রুল আনোয়ার, এটিএন বাংলার হেড অব নিউজ জ ই মামুন, চ্যানেল আইয়ের পরিচালক শাইখ সিরাজ, আরটিভির সিইও সৈয়দ আশিক রহমান, একুশে টিভির হেড অব নিউজ রাশেদ চৌধুরী, বাংলা ভিশনের হেড অব নিউজ মোস্তফা ফিরোজ, সময় টিভির বার্তা প্রধান তুষার আবদুল্লাহ, ইন্ডিপেনডেন্ট টিভির নির্বাহী সম্পাদক খালেদ ‍মুহিউদ্দীন, মাছরাঙা টিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক রেজোয়ানুল হক রাজা, একাত্তর টিভির প্রধান সম্পাদক মোজাম্মেল বাবু, চ্যানেল ২৪ এর এডিটর ইনপুট তালাত মামুন, দেশ টিভির হেড অব নিউজ সুকান্ত গুপ্ত অলোক, যমুনা টিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক ফাহিম আহমেদ, নিউজ টোয়েন্টিফোরের ব্যবস্থাপনা সম্পাদক হাসনাইন খুরশিদ, ডিবিসি নিউজের সিইও মঞ্জুরুল ইসলাম, মোহনা টিভির বার্তা সম্পাদক মুস্তাফিজুর রহমান, মাই টিভির বার্তা সম্পাদক খান মোহাম্মদ সাদেক, এসএ টিভির বার্তা সম্পাদক শরিফুল ইসলাম, দীপ্ত টিভির বার্তা সম্পাদক মাহমুদুল করিম চঞ্চল, এশিয়ান টিভির প্রধান বার্তা সম্পাদক বিল্লাল হোসাইন বেলাল,  রেডিও টুডে’র বার্তা প্রধান সেলিম বাশার, ভয়েস অব আমেরিকা বাংলাদেশ প্রতিনিধি আমির খসরু, ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটির সভাপতি সাখাওয়াত হোসেন বাদশা, সাধারণ সম্পাদক মুরসালীন নোমানী, বাংলাদেশ টেলিভিশনের মহাপরিচালক এস এম হারুন-উর-রশীদ সংলাপে উপস্থিত হয়েছেন।

নির্বাচন কমিশনের সংলাপে আমন্ত্রণ পেলেও কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ সংবাদমাধ্যমের প্রধান সম্পাদক ও জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকরা আলোচনায় আসেননি। 

যারা উপস্থিত ছিলেন না, তারা হলেন: বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক তৌফিক ইমরোজ খালিদী, বাংলানিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান সম্পাদক আলমগীর হোসেন, এটিএন নিউজের হেড অব নিউজ মুন্নী সাহা, গাজী টিভির হেড অব নিউজ মেজবাহ আহমেদ, চ্যানেল নাইনের হেড অব নিউজ আমিনুর রশীদ, বৈশাখী টিভির হেড অব নিউজ অশোক চৌধুরী, এবিসি রেডিওর বার্তা প্রধান সানাউল্লাহ আহমেদ এবং বাংলাদেশ বেতারের মহাপরিচালক মো. নাসির উদ্দিন আহমেদ।

সংলাপের শুরুতেই একাত্তর টিভির প্রধান সম্পাদক মোজাম্মেল বাবু নির্বাচন কমিশনের এই আমন্ত্রণ পদ্ধতি নিয়ে প্রশ্ন তোলেন।

“গতকাল সম্পাদকদের সঙ্গে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিকদের আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল। আমাদের এখানে বাসসের প্রধান সম্পাদকসহ অনেকে সিনিয়র সাংবাদিক রয়েছেন। তাহলে তারা কি জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক না? এ সব বিষয়ে কমিশনের আরও মনোযাগী হওয়া প্রয়োজন ছিল।” 

যেসব সুপারিশ এসেছে

সংলাপ শেষে ইসির সম্মেলন কক্ষে ইসির ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ সার্বিক বিষয়ে একীভূত মতামতগুলো তুলে ধরেন।

১. সেনা মোতায়েন নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে মত রয়েছে; অধিকাংশই বলেছেন, এ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেবে ইসি।

২. ‘না’ ভোট নিয়ে দ্বিধাভিক্ত মত এসেছে।

৩. পর্যবেক্ষক নিয়োগে সতর্কতা অবলম্বনের পরামর্শ এসেছে।

৪. ভোট কেন্দ্রে যে এনআইডি লাগবে না- এ বিষয়ে প্রচার চালাতে হবে।

৫. ভোটের প্রচারে ধর্মের অপব্যাহার বন্ধের সুপারিশ এসেছে।

৬. টিভি চ্যানেল ও সাংবাদিকদের পর্যবেক্ষক নিয়োগের সুপারিশ।

৭. প্রশাসন ও আইন-শৃঙ্খলা রক্ষায় দল নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের নিয়োগ দিতে হবে।

৮. ভোটের দায়িত্বে থাকা গণমাধ্যম কর্মীদের প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা যেতে পারে।

৯. প্রার্থীর হলফনামা এনবিআর-দুদকের মাধ্যমে যাছাই করা যেতে পারে।

১০. ভোটার অনুপাতে আসন বন্টন নিশ্চিত করা।

১১. স্বাধীনতাবিরোধীদের নিবন্ধন না দেওয়া এবং নিবন্ধিতদের কার্যক্রম নিরীক্ষা।

১২. ভোটের ফলাফল দ্রুত ও সঠিকভাবে প্রচারের ব্যবস্থা করা।

১৩. নির্বাচন ঘিরে ধর্মীয় ও জাতিগত ‘সংখ্যালঘুদের’ নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

১৪. পরাজিত প্রার্থীর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

১৫. একাধিক দিনে ভোট আয়োজন করা যায় কি না, বিবেচনা করা।

১৬. প্রবাসীদের ভোটাধিকার নিশ্চিত করা।

১৭. সংবাদ সংগ্রহে গণমাধ্যমকর্মীদের নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।

১৮. ঝুঁকিপূর্ণ কেন্দ্রের তালিকা এখনই প্রস্তুত রেখে ব্যবস্থা নেওয়া।

১৯. অনূকূল পরিবেশ তৈরিতে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে ঘন ঘন সংলাপের সুপারিশ।

২০. সীমানা পুনঃনির্ধারণ ও আইন সংস্কারের সময় বড় ধরনের পরিবর্তন না আনা।

গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সঙ্গে প্রথমদিনের সংলাপে আমন্ত্রিত ৩৭ জনের মধ্যে ২৬ জন উপস্থিত ছিলেন। একাদশ সংসদ নির্বাচনে সব দলের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে যথাযথ পরিবেশ তৈরির পাশাপাশি নির্বাচন কমিশনকে আস্থা অর্জনের পরামর্শ দিয়েছেন তারা।

২০১৯ সালের ২৮ জানুয়ারির আগের ৯০ দিনের মধ্যে একাদশ সংসদ নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে আয়োজন করতে গত ১৬ জুলাই দেড় বছরের কর্মপরিকল্পনা প্রকাশ করে কে এম নূরুল হুদা নেতৃত্বাধীন নির্বাচন কমিশন।

এর অংশ হিসেবে রাজনৈতিক দল, নির্বাচন পরিচালনা বিশেষজ্ঞ, গণমাধ্যম প্রতিনিধি, পর্যবেক্ষক ও নারী সংগঠনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ইসির এই মতবিনিময়।

৩১ জুলাই সুশীল সমাজের প্রতিনিধিদের নিয়ে সংলাপ শুরু করে ইসি। গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সঙ্গে মত বিনিময় শেষে ২৪ অগাস্ট থেকে রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সংলাপ শুরু হবে।

ইসির ভারপ্রাপ্ত সচিব হেলালুদ্দীন আহমদ বলেন, “এ পর্যন্ত পাওয়া সুপারিশগুলো দলগুলোর সামনে তুলে ধরা হবে। সংলাপ শেষ করে সব প্রস্তাব একীভূত করে প্রয়োজনীয় সিদ্ধান্ত নেবে কমিশন।”

ঈদের আগে ২৪, ২৮ ও ৩০ অগাস্ট এবং পরে ১০ সেপ্টেম্বর থেকে ফের সংলাপ শুরু হবে।