মধ্যস্থতা করা ইসির কাজ নয়: সিইসি

রাজনৈতিক দলগুলোকে ভোটে আনতে ‘সমঝোতার’ কোনো উদ্যোগে নির্বাচন কমিশনের কোনো ভূমিকা থাকবে না বলে জানিয়েছেন প্রধান নির্বাচন কমিশনার কে এম নূরুল হুদা।

মঈনুল হক চৌধুরী জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 August 2017, 09:48 AM
Updated : 17 August 2017, 07:07 PM

ভোটে সেনাবাহিনী মোতায়েন করা হবে কি না, কোনো দলের চাওয়া বা না চাওয়ার ওপর তা নির্ভর করবে না বলেও তিনি জানিয়ে দিয়েছেন।

বৃহস্পতিবার গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সঙ্গে দ্বিতীয় দিনের সংলাপে এ কথা জানান সিইসি নূরুল হুদা, যার কমিশনের অধীনে ২০১৮ সালের শেষে একাদশ জাতীয় নির্বাচন হবে।

আলোচনায় এক প্রশ্নের জবাবে সিইসি বলেন, “ভোটে সেনাবাহিনী মোতায়েন হবে কি না- সে সিদ্ধান্ত নেবে ইসি। কেউ চাইল, বা না চাইল- তার উপর নির্ভর করে কিছু হবে না। পরিবেশ পরিস্থিতিতে যদি প্রয়োজন মনে করি, সবই আসবে।

“দরকার মনে না করলে সেনাবাহিনী আসবে না। এটা সম্পূর্ণভাবে ইসির উপর ছেড়ে দিতে হবে।”

দশম সংসদ নির্বাচন বর্জনকারী বিএনপি সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য সেনাবাহিনীকে রাখার দাবি জানিয়ে আসছে। তত্ত্বাবধায়ক সরকার পদ্ধতির মতো নির্দলীয় কোনো সরকারের মধ্যে নির্বাচন না হলে তা প্রতিহত করার হুমকিও তাদের রয়েছে।

অন্যদিকে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ বলে আসছে, সংবিধান অনুযায়ী বর্তমান সরকারের অধীনেই আগামী নির্বাচন হবে। আর তাতে সেনাবাহিনী মোতায়েনের কোনো প্রয়োজন নেই বলেও মত প্রকাশ করে আসছেন দলটির নেতারা। 

একাদশ সংসদ নির্বাচনের পথে সংশ্লিষ্ট নানা পক্ষের সঙ্গে সংলাপের অংশ হিসেবে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গেও আলোচনায় বসবে ইসি।

সিইসি বলেন, আগামী ২৪ অগাস্ট থেকে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে ইসির যে সংলাপ শুরু হবে, সেখানে কারও ভোটে আসা-না আসার বিষয়ে কোনো আলোচনা হবে না।

“আমরা যে ডায়লগ করব পলিটিক্যাল পার্টির সঙ্গে, এটা শুধু ডায়লগ। তাদের কথা শুনব, আমাদের কথা তারা শুনবেন। এ নিয়ে কে আসবে- না আসবে, তা নিয়ে আমাদের কোনো ইস্যু থাকবে না।”

সব দলকে নির্বাচনে আনতে ‘মধ্যস্থতাকারীর’ ভূমিকা নিতে গণমাধ্যমের প্রতিনিধিদের কারও কারও সুপারিশের বিষয়ে দৃষ্টি আকর্ষণ করলে সিইসি বলেন, “আমার মনে হয় না… আমি নিতে চাই না।”

বিগত নির্বাচনের আগে বিদেশিদের মধ্যস্থতায় প্রধান দুই দল আওয়াম লীগ ও বিএনপির মধ্যে সংলাপের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, “আমরা সবাই ভুলে যাই- আন্তর্জাতিক পর্যায়ের অনেক মেডিয়েটর এসে আমাদের রাজনৈতিক দলের সঙ্গে বসে সমঝোতায় আনতে পারেনি। সেখানে আমি কেন চাইব সে রিস্ক নিতে? অযথা সময় নষ্ট করতে? এটা আমার কাজ না। ভেরি ফার্মলি- এটা আমার কাজ না।”

ভোট নিয়ে চাপের মুখে পড়লে কী করবেন- এ প্রশ্নে সিইসি বলেন, “এর সুযোগ নেই। কারও কাছে যদি আমরা আত্মসমর্পণ করি, তাহলে এটা আমাদের দুর্বলতা। এটা আমরা করব না। কারণ আমাদের কারও কাছে যাওয়ার প্রয়োজন নেই। ইসি সম্পূর্ণ স্বাধীন সত্তা।”

সাবেক সরকারি কর্মকর্তা নূরুল হুদা মনে করেন, চাপের মুখেও ‘কম্প্রোমাইজ’ না করার অঙ্গীকার যদি থাকে, তাতেই কাজ হবে।   

“ইটস এনাফ, আর কোথাও যেতে হবে না। এবার আর কোথাও যাব না, এটা আমার অঙ্গীকার। এজন্য আপনাদের সাক্ষী রেখেই কথাগুলো বলছি।”

ইসির সংলাপে গণমাধ্যম প্রতিনিধিরা

সকাল ১০টার পর ইসির সম্মেলন কক্ষে গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের সঙ্গে সংলাপে বসেন সিইসি নূরুল হুদার নেতৃত্বে নির্বাচন কমিশনাররা। বিভিন্ন অনলাইন সংবাদমাধ্যম, টেলিভিশন ও রেডিওর ২৬ জন প্রতিনিধি বেলা ১টা পর্যন্ত তাদের মতামত তুলে ধরেন এবং প্রশ্নোত্তর পর্বে অংশ নেন।

ইসির ভূমিকার কথা জানাতে হ্যাঁ-না ভোট, তত্ত্বাবধায়ক সরকার, এক ব্যক্তির সরকার ও গণতান্ত্রিক পরিবেশের স্থায়িত্ব না থাকার প্রসঙ্গও টানেন নূরুল হুদা।

তিনি বলেন, যখন যে সরকার নির্বাচনের জন্য যে নিয়ম দাঁড় করিয়েছে নির্বাচন কমিশনকেও সেভাবেই ভোট করতে হয়েছে। নির্বাচনকালীন সরকারের পরিবর্তনে কমিশনের কোনো ভূমিকা রাখার সুযোগ নেই।

নির্বাচন কমিশনকে এ জন্যে একটি ‘টেকনিক্যাল অফিস’ বলেই উল্লেখ করেন সিইসি।

“এখন যে অবস্থা রয়েছে তার পরিবর্তন না হলে বর্তমান সরকারের অধীনে নির্বাচন হবে; আমরাও তাই করব। আর যদি সরকার পরিবর্তন করে, সে অনুযায়ী করব। এ পরিবর্তনে আমরা তো কোনো ভূমিকা রাখতে পারি না।”

‘জটিলতা অনেক, আস্থা রাখুন’

বাংলাদেশে নির্বাচন আয়োজনে অনেক জটিলতার কথা তুলে ধরলেও ইসির উপর আস্থা রাখতে সবার প্রতি আহ্বান জানান নূরুল হুদা।

সংলাপে সিইসি

তিনি বলেন, “নির্বাচনী মাঠে অনেক ধরনের সমস্যা রয়েছে। অনেক জটিলতা রয়েছে। বাংলাদেশে যেসব জটিলতা রয়েছে তা অনেক দেশে নেই।

“সেটা কেন নেই সেটা সবাই জানেন। নির্বাচনী পরিবেশ সৃষ্টির জন্যে যে গণতান্ত্রিক পরিবেশ দরকার, গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া যে লংজিবিলিটি দরকার তার অভাব রয়েছে আমাদের।”

কখনও হ্যাঁ/না ভোট, কখনও তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে ভোট, কখনও নির্বাচিত সরকারের অধীনে ভোট, কখনও একনায়কের অধীনে ভোটের কথা তুলে ধরেন সাবেক এই সরকারি কর্মকর্তা।

“এক নিয়মে এক নাগাড়ে কখনও তিনটা নির্বাচন করতে পারিনি আমরা।”

তবে সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের ক্ষেত্র তৈরিতে আশাবাদ প্রকাশ করেন নূরুল হুদা।

“সকলে মিলে অসুবিধাগুলো ধারণ করি, পালন করি ও প্রয়োগ করি- তাহলে একদিনে পারব, এক বছরে পারব বা এ নির্বাচনেই পারব তা আমি একেবারেই বিশ্বাস করি না। কিন্তু আমরা ক্ষেত্র তৈরি করতে পারব আশা করি।”

‘কারও প্রতি আকর্ষণ-বিকর্ষণ নেই’

বিদ্যমান আইনের যতটুকু সম্ভব বাস্তবায়ন ও প্রয়োগ করার আশ্বাস দেন সিইসি নূরুল হুদা।

“আপনাদের আশ্বস্ত করতে পারি- আমরা একটা সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য, অবাধ নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্য সংকল্পবদ্ধ। আমাদের কারও প্রতি কোনো দুর্বলতা নেই। কারও প্রতি শত্রুতা নেই, অনীহা নেই; কারও প্রতি আকর্ষণ-বিকর্ষণ নেই।”

বিদ্যমান যে নির্বাচনী আইন রয়েছে, সেটাই ‘অত্যন্ত শক্তিশালী’ মনে করছেন তিনি।

যে সরকারই থাকুক আপনি ভালো নির্বাচন করতে পারায় কতটা আশাবাদী- এ প্রশ্নে সিইসি বলেন, “আমরা কারও কাছে নির্বাচনের ব্যাপারে মাথা নত করব না।”

দলীয় সরকারের অধীনে নির্বাচন চ্যালেঞ্জ মনে করছেন কি না- এই প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপর নির্ভরশীল একটা সরকারের অধীনে নির্বাচন আমরা দেখেছি। খোলামেলা বলুন তো-শেষের দিকে কী অবস্থা হয়েছিল? তত্ত্বাবধায়ক সরকারের সেই আবেদন, নির্ভরশীলতা কি ছিল শেষদিকে? ছিল না।

সংলাপে ইসি

“রাজনৈতিক দল যখন ক্ষমতায় থাকে তখন দেখেন, কোন লোক পাঁচ বছর পরে কেয়ারটেকার গর্ভমেন্টের প্রধান হবেন সে হিসাব-নিকাশ এদেশে হয়নি? বলেন আপনার হয়েছে কি না? যদি হয়ে থাকে সেখানে আমরা দাঁড়াতে পারিনি।”

এখন কি সুষ্ঠু নির্বাচনের পরিবেশ রয়েছে- প্রশ্ন করলে নূরুল হুদা বলেন, “আমি ১০০ ভাগ অনকূল ও আস্থার অবস্থায় আছি। কারণ, আমাকে কেউই ডিস্টার্ব করেনি। সুতরাং এখন পর্যন্ত আস্থাশীল আছি, আস্থাশীল থাকব।”

২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির অভিযোগবিদ্ধ নির্বাচনে ৪০ শতাংশ ভোট পড়েছিল বলে মনে করেন কি না- এমন প্রশ্ন করা হলে তিনি মন্তব্য করতে চাননি।

‘ভোট কক্ষ স্পর্শকাতর, গণমাধ্যম যেতে মানা’

ভোটকেন্দ্রে অবাধ যাওয়ায় বিধি-নিষেধের কথা তুলে ধরে সিইসি গণমাধ্যম প্রতিনিধিদের বলেন, “ভোটকেন্দ্র জনগণের জায়গা, আবার স্পর্শকাতর জায়গাও। ভোটকেন্দ্রের ভোটকক্ষে (বুথ) সবাই যেতেও পারবে না।”

ভোটার যে কক্ষে ভোট দেবেন, সেখানে কেউ ঢুকলে প্রিজাইডিং কর্মকর্তা ব্যবস্থা নেবেন বলে জানান তিনি।

সংসদ নির্বাচনে জেলা প্রশাসক ও সমমর্যাদার কর্মকর্তারা রিটার্নিং কর্মকর্তা হিসাবে নিয়োগ পান। দায়িত্ব পালনে আইনের ব্যত্যয় ঘটালে সর্বনিম্ন ৩ বছর থেকে সর্বোচ্চ ৭ বছরের শাস্তির বিধান থাকলেও তার প্রয়োগ না হওয়ার কথা স্বীকার করেন সিইসি।

“এটা ঠিক (কারও শাস্তি হয়নি)। এটা আমাদের দুর্বলতা। নির্বাচন কমিশন, এদেশের দুর্বলতা; সামাজিক অবস্থার দুর্বলতা। হয় কেন? এ নিয়ে অনেক ব্যাখ্যা, জানার ও জিজ্ঞাসা থাকতে পারে। সংক্ষুব্ধ ব্যক্তিরা অভিযোগ, মামলা করলে ভালো হয়।”

সংক্ষুব্ধ ব্যক্তি মামলা করলে কমিশন সব সময় সহযোগিতা করবে বলে আশ্বাস দেন সিইসি।