জঙ্গিবাদ দমনের কাজে দীর্ঘদিন ধরে নিয়োজিত এই পুলিশ কর্মকর্তা বলেছেন, “বর্তমানে সক্রিয় জঙ্গি সংগঠন হল নব্য জেএমবি। নিজেদের মধ্যে অবিশ্বাস আর দ্বন্দ্বে তারা বহু ভাগে বিভক্ত হয়ে পড়েছে।সেই খণ্ডগুলো বিভিন্ন সময় সক্রিয় হওয়ার চেষ্টা করে। তবে এই মুহূর্তে বড় ধরনের হামলা করার সক্ষমতা তাদের নাই।”
নিজেদের অবস্থানের জানান দিতে জামাআতুল মুজাহিদিন বাংলাদেশের (জেএমবি) জঙ্গিরা ২০০৫ সালের ১৭ অগাস্ট একযোগে দেশের ৬৩টি জেলার পাঁচশর বেশি স্থানে বোমা হামলা চালিয়ে ত্রাস সৃষ্টি করে।
এরপর গত এক যুগে দেশের বিভিন্ন স্থানে জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে, মুক্তচিন্তা ও ভিন্ন মতাবলম্বীরা আক্রান্ত হয়েছে বার বার। এর ধারাবাকিতায় গতবছর ১ জুলাই গুলশানের হলি আর্টজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার ঘটনা পুরো বাংলাদেশকে নাড়িয়ে দিয়ে গেছে।
তবে এরপর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর একের পর এক অভিযানে জঙ্গিরা এখন অনেকটাই হীনবল হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন মনিরুল।
জঙ্গি মোকাবেলায় দেশের একমাত্র বিশেষায়িত এই ইউনিটের প্রধান অনেকটা আত্মসমালোচনার সুরে বলেন, “আগে আমাদের সক্ষমতার ঘাটতি ছিল, সেটাও বলা যায়। কারণ জঙ্গিবাদ নিয়ে কাজ করার মত ডেডিকেটেড ইউনিট বাংলাদেশের ছিল না।”
২০১৫ সালের শুরু থেকে দেশের বিভিন্ন স্থানে একের পর এক চাপাতি হামলার মধ্যে ২০১৬ সালের মে মাসে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট গঠন করা হয়, এর দায়িত্ব দেওয়া হয় ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুলকে।
এই ইউনিট পুরোমাত্রায় প্রস্তুত হওয়ার আগেই গুলশানের ঘটনা ঘটে। কয়েকজন তরুণ কূটনৈতিক পাড়ার মধ্যে ওই রেস্তোরাঁয় ঢুকে ১৭ বিদেশি নাগরিকসহ ২০ জনকে হত্যা করে। জঙ্গিদের বোমায় নিহত হন দুই পুলিশ কর্মকর্তা। পরদিন ভোরে সেনা কমান্ডোদের অভিযানে সঙ্কটের রক্তাক্ত সমাধান হয়।
সেই সময়ের ভূ-রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট তুলে ধরে মনিরুল বলেন, “অপরাজনীতির বাই প্রোডাক্ট হিসেবেই বিশ্বে সন্ত্রাসবাদের জন্ম। দুই সুপার পাওয়ারের প্রাধান্য বিস্তারের যে প্রচেষ্টা; সেটার বাই প্রোডাক্ট হিসেবে ১৯৮৮ সালে আল-কায়েদার জন্ম হয়। আল-কায়েদার অনুসরণে ১৯৯২ সালে বাংলাদেশে জন্ম হয় জঙ্গি দল হরকাতুল জিহাদের, পরে আসে জেএমবি।”
তিনি জানান, ২০০৫ সালের ১৭ অগাস্ট হামলায় জড়িতদের মধ্যে যাদের গ্রেপ্তার করা হয়েছিল, তাদের জবানবন্দি বিশ্লেষণ করে আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী জঙ্গি দলগুলোর বেড়ে ওঠার এই চিত্র পেয়েছে।
১৭ অগাস্টের হামলার পর ওই বছর ১৪ নভেম্বর ঝালকাঠি জেলার সিনিয়র সহকারী জজ সোহেল আহম্মেদ ও জগন্নাথ পাঁড়ের গাড়িতে বোমা হামলা চালিয়ে তাদের হত্যা করা হয়।
জেলা জজ আদালতের চতুর্থ শ্রেণীর কর্মচারী আব্দুল মান্নান ও ও দুধ বিক্রেতা বাদশা মিয়ার পাশাপাশি হামলাকারী জঙ্গি ইফতেখার হোসেন মামুনও ওই ঘটনায় আহত হন।
ওই মামলায় ২০০৭ সালের ২৯ মার্চ জেএমবির শীর্ষ নেতা শায়খ আবদুর রহমান, সিদ্দিকুল ইসলাম ওরফে বাংলা ভাই, আতাউর রহমান সানি, আবদুল আউয়াল, ইফতেখার হোসেন মামুন, খালেদ সাইফুল্লাহ (ফারুক) ও আসাদুল ইসলাম আরিফের ফাঁসি কার্কর করা হয়।
শীর্ষ নেতাদের ফাঁসি হওয়ার পর হবিগঞ্জের সাবেক জামায়াত নেতা মাওলানা সাইদুর রহমানের নেতৃত্বে পুনর্গঠিত হয় নিষিদ্ধ জঙ্গি সংগঠন জেএমবি। পরে ২০১০ সালের ২৫ মে সাইদুরসহ তিনজনকে ঢাকায় গ্রেপ্তার করে পুলিশ।
সেই প্রসঙ্গে টেনে মনিরুল বলেন, “নেতাদের ফাঁসির মধ্যে দিয়ে জেএমবির প্রথম অধ্যায়ের পরিসমাপ্তি ঘটেছিল। দ্বিতীয় অধ্যায় শুরু করার পর্যায়ে মাওলানা সাইদুর রহমান গ্রেপ্তার হলে তাদের সেই চেষ্টা ভণ্ডুল হয়ে যায়। তারপরও জেএমবি বিভিন্ন সময় চেষ্টা করেছে, আমরা তৎপর থেকেছি। কিন্তু ধর্মকে পুঁজি করে তারা দল গড়ে বলে তাদের সেই জঙ্গি আদর্শকে কখনোই পুরোপুরি নির্মূল করা সম্ভব হয়নি।”
কাউন্টার টেররিজম ইউনিটের প্রধানের মতে, ধর্মের অপব্যাখ্যা দিয়ে, আন্তর্জাতিক জঙ্গিবাদ থেকে অনুপ্রেরণ নিয়ে বিভিন্ন সময়ে যেভাবে এ সংগঠনগুলে তৎপর হয়েছে, সেই কারণগুলো এখনও বিদ্যমান। এই পথ ধরেই পুরনো জেএমবির একটি অংশ সংগঠিত হয়ে নব্য জেএমবির জন্ম।
তিনি বলেন, “পুরনো জেএমবির কার্যক্রম এখন বাংলাদেশে সেভাবে নেই। আর নব্য জেএমবির সাংগঠনিক যে নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছিল, তা অনেকটাই বলা যায় বিধ্বস্ত করে ফেলেছি। সাংগঠনিক কাঠামো খণ্ড-বিখণ্ড হয়ে গেছে।… এরাই হলি আর্টিজানের ঘটনা ঘটিয়েছে, এরাই শোলাকিয়ায় বড় হামলার চেষ্টা করেছিল।”
গুলশান হামলার এক সপ্তাহের মাথায় কিশোরগঞ্জের শোলাকিয়ায় দেশের সবচেয়ে বড় ঈদ জামাতের মাঠের কাছে নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা পুলিশ সদস্যদের ওপর হামলা চালিয়ে দুই পুলিশ সদস্যকে হত্যা করে জঙ্গিরা। পরে গোলাগুলির মধ্যে এক গৃহবধূর প্রাণ যায়, এক জঙ্গিও পুলিশের গুলিতে নিহত হয়।
মনিরুল বলেন, “জেএমবির কোনো কোনো গ্রুপকে এখনও হয়তো পুরোপুরি ধ্বংস করা যায়নি।সেই খণ্ডগুলো বিভিন্ন সময় সক্রিয় হওয়া চেষ্টা করে।তারা খুবই স্বল্প পরিচিত লোককে আমির বানিয়ে সংগঠিত হওয়া চেষ্টা করে। তবে এই মুহূর্তে তাদের বড় হামলা করার সামর্থ্য সেভাবে নেই।”
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য অনুযায়ী ২০০৫ সালের ১৭ অগাস্টের ঘটনায় সারাদেশে মোট ১৫৯টি মামলা করা হয়। সেসব মামলায় আসামির সংখ্যা ছিল ১ হাজার ১০৬ জন।
মামলাগুলো মধ্যে ৯৩টির রায় হয়েছে। তাতে ২৭ জনকে মৃত্যৃদণ্ড দেওয়া হয়েছে; বিভিন্ন মেয়াদের সাজা হয়েছে আরও ৩২০ জনকে।
দণ্ডিত আসামিদের মধ্যে ছয় জনের মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয়েছে। আর কারাগারে সাতজনের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে।
[প্রতিবেদনটি তৈরি করতে সহযোগিতা করেছেন সুমন মাহবুব]