কারাগারের রোজনামচা বঙ্গবন্ধুর ‘সামগ্রিক সত্তার পরিচায়ক’

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের কারাগারের দিনলিপি অবলম্বনে প্রকাশিত ‘কারাগারের রোজনামচা’ গ্রন্থটি বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলনের নেতার সামগ্রিক সত্তাকে তুলে ধরেছে বলে মূল্যায়ন একদল লেখক-অধ্যাপকের।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 August 2017, 07:32 PM
Updated : 16 August 2017, 07:34 PM

১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুর ৪২তম শাহাদাৎবার্ষিকী উপলক্ষে বুধবার বিকালে বাংলা একাডেমির শহীদ মুনীর চৌধুরী সভাকক্ষে ‘কারাগারের রোজনামচা’ নিয়ে আলোচনা হয়।

১৯৬৬ সালে তৎকালীন পূর্ব বাংলার (বাংলাদেশ) স্বাধিকারের দাবি ছয় দফা দেওয়ার পর শেখ মুজিবুর রহমানকে গ্রেপ্তার করে উপনিবেশিক পাকিস্তান সরকার। ১৯৬৯ সাল পর্যন্ত কারাগারে বন্দি থাকার সময় তিনি যে দিনলিপি লিখেছেন তা নিয়েই সাজানো হয়েছে ‘কারাগারের রোজনামচা’। বঙ্গবন্ধুর ৯৭তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষে ৩ মার্চ বইটি প্রকাশ করে বাংলা একাডেমি।

বইটি নিয়ে আলোচনা শুরু করেন বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব ও বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক গভর্নর মোহাম্মদ ফরাসউদ্দিন। স্মৃতিচারণ পর্বে তিনি জানান, ছাত্র ইউনিয়ন কর্মী থেকে কীভাবে তিনি রাষ্ট্রপতি শেখ মুজিবুর রহমানের একান্ত সচিব হলেন। ১৯৭৩ থেকে ১৯৭৫ সালের ১২ অগাস্ট পর্যন্ত তিনি বঙ্গবন্ধুর একান্ত সচিব ছিলেন।

ওই সময়টুকুই তার জীবনের ‘শ্রেষ্ঠ সময়’ বলে মন্তব্য করেন তিনি।

‘কারাগারের রোজনামচায়’ বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিব বা রেনুর অধ্যায় নিয়েও বললেন ফরাসউদ্দিন।

তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধু যখন বিদেশ সফরে যেতেন, তখন বেগম মুজিব বলতেন, আমাকে যেন তার ঠিক পাশের রুমে রাখা হয়, যেন সঙ্গে সঙ্গে রাখা হয়। আমাকে বড় বিশ্বাস করতেন তিনি।”

পঁচাত্তরের প্রেক্ষাপট নিয়ে বলতে গিয়ে তিনি বলেন, “অনেকেই বলেন, ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে তিনি গণভবনে গেলে নিরাপদ থাকতেন। কিন্তু তখন সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান কর্মকর্তাদের খবর তো জানাই। গণভবনে গেলেও তার নিরাপত্তার কোনো গ্যারান্টি ছিল না।”

বঙ্গবন্ধু সারা জীবন বাংলার কৃষাণ-কৃষাণি ও মেহনতি মানুষকে ‘প্রকৃত বন্ধু’ ভাবতেন বলেও মন্তব্য করেন ফরাসউদ্দিন।

অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, “বঙ্গবন্ধু অত্যন্ত সূক্ষ্ম ও দূর দৃষ্টিসম্পন্ন ব্যক্তি ছিলেন। জেলজীবনে থেকে তিনি নিরাসক্ত দৃষ্টিতে ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলখানার কয়েদিদের মধ্য দিয়ে ভেতরের ইতিহাস বিশ্লেষণ করলেন। এখানে আমরা দেখি, মানুষ হিসেবে কতটা দরদি মনের মানুষ ছিলেন তিনি।”

বঙ্গবন্ধুকে ‘ক্যারিশমাটিক লিডার’ অভিহিত করে অধ্যাপক হারুন অর রশিদ বলেন, “কারাগারের রোজনামচা বইটির কি সম্মোহনী শক্তি, পড়তে বসলে শেষ না করে উঠা যায় না। এই বইটিতে একজন আপাদমস্তক রাজনীতিবিদের রাজনৈতিক চরিত্রের বহুমাত্রিকতা লক্ষ করি। পারিবারিক জীবনে ব্যক্তি মানুষ বঙ্গবন্ধু, কারাগার জীবনে প্রকৃতিপ্রেমী, বন্দী জীবনে নীতির প্রশ্নে অবিচল এক ব্যক্তিত্বের কথা জানতে পারি এই বইতে।

“কারাগারের রোজনামচা যেন বঙ্গবন্ধুর এক সামগ্রিক সত্তার পরিচায়ক।”

ইতিহাসের নানা পাঠ পর্যালোচনায় বঙ্গবন্ধু, মুক্তিযুদ্ধ, একাত্তর ও বাংলাদেশকে এক ‘অভিন্ন সত্তা’ হিসেবে দেখেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের এই অধ্যাপক।

তিনি বলেন, “অবহেলিত, নিষ্পেষিত, অধস্তন বাঙালির মুখে হাসি ফোটানোর লক্ষ্য থেকে একচুলও বিচ্যুত হননি তিনি। রাজনীতিতে তার ত্যাগের আদর্শ মহিমান্বিত। বাঙালি সমাজে এত উচ্চতা নিয়ে আর কেউ জন্মগ্রহণ করেননি। এ ভূখণ্ড যতদিন থাকবে বঙ্গবন্ধু স্বমহিমায় সমুজ্জ্বল থাকবেন।”

‘কারাগারের রোজনামচা’-জীবনীগ্রন্থকে এক ‘অসাধারণ ভিন্নধর্মী সাহিত্য’ হিসেবে দেখেন কথাসাহিত্যিক সেলিনা হোসেন।

বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তিনি বলেন, “ব্যক্তিকে ব্যক্তি হিসেবে দেখে মানব জীবনের সবটুকু সত্য যেমন তিনি উদঘাটন করেছেন, তেমনিভাবে সমাজ কাঠামোতে ভালো-মন্দগুলোকেও অবলীলায় তিনি বলে গেছেন। সাহিত্য বিবেচনায় এটি মানবিক, রাজনৈতিক বিবেচনায় গ্রন্থটি এক সত্য দর্শন।”

অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, “বইটিতে উঠে এসেছে প্রান্তিক মানুষের সংগ্রামের কথা, শ্রেণির মধ্যে আবদ্ধ না থেকে তিনি বলে গেছেন শ্রমিকের কথা। রাজনৈতিক সংগ্রামের পাশাপাশি তিনি বেগম মুজিবের উপর যে ডিপেনডেন্সির কথা বলেছেন, তাও শিক্ষণীয়। স্বায়ত্তশাসনে বিশ্বাস করতেন বলে তিনি তার লিডারশিপের মধ্য দিয়ে সেই চেতনা অন্যান্যদের মধ্যে ছড়িয়ে দেওয়ার চেষ্টা করেছেন।”

‘কারাগারের রোজনামচা’র আলোচনায় এসে যায় ‘বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত আত্মজীবনী’র কথাও।

দুটি বই ইতিহাস পুনর্নিমাণে ‘এক গুরুত্বপূর্ণ উৎস’ বলে মন্তব্য করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ইতিহাসের অধ্যাপক মেসবাহ কামাল।

“ইতিহাস লেখার জন্য ইনসাইড স্টোরি যা পাওয়া যায়, তাতে নির্ভরযোগ্যতা অনেক কম। সেক্ষেত্রে অসাধারণ কাজে লাগবে এই বইটি। নানা দিক থেকে বই দুটিকে বেস্ট প্রিজম লিটারেচার বলা যেতে পারে। ইনডিভিজুয়াল মানুষের মধ্যে দিয়ে সমাজকে দেখার যে গুরুত্বপূর্ণ উপকরণ আমরা ‘কারাগারের রোজনামচায়’ পাই, তা-ই সম্ভবত সবচেয়ে ভালো।”

অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, “বঙ্গবন্ধুর সাহসিকতা, সততার পাশাপাশি রাজনৈতিক চিন্তা, বিশ্বাস, দর্শন, বাঙালি জাতীয়তাবাদ ও  সমাজতন্ত্রের কথা উঠে এসেছে বইগুলোতে।”

অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন বলেন, “দুটি বইয়ে আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রে বঙ্গবন্ধুর দূরদর্শিতার পরিচয়ও পাই। রাজনীতিতে বড় দরকার হল বিশ্বাস, বই দুটি পড়তে গিয়ে তার সেই বিশ্বাসের কথাই জানতে পারি। ভাসানীর (মাওলানা আবদুল হামিদ খান) সঙ্গে মতের বিরোধ থাকলেও তিনি কখনও তার রাজনৈতিক গুরুকে অশ্রদ্ধা করেননি। সমসাময়িক রাজনীতিবিদদের প্রতি তিনি শ্রদ্ধা দেখিয়েছেন তার দুটি বইতে।”

ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেন, “ইতিহাসের অনেক মিথ্যা প্রচার খণ্ডন করবে এ দুটি বই। দুটি গ্রন্থেই বঙ্গবন্ধুর রাজনৈতিক দর্শন, অভিজ্ঞতা ও পর্যবেক্ষণের আলোকে পরিপূর্ণ।”

রাজনীতিবিদ, লেখক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, “৭২ সালে বইগুলো প্রকাশিত হলে কী প্রতিক্রিয়া হত!  ৪২ বছর পরে প্রকাশের পর বঙ্গবন্ধুর যে অবয়ব আমরা দেখতে পাই, তা আরও প্রকট।”

বাকশাল গঠনের পর ১৯৭৫ সালের ১৯ জুন বাকশালের প্রথম সভায় বাংলাদেশের রূপকল্প নিয়ে বঙ্গবন্ধুর ভাষণের তাৎপর্য উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আজকে যারা তার আদর্শের রাজনীতি করেন, তারা তা পড়েও দেখেননি।”

কলামনিস্ট সৈয়দ আবুল মুকসুদ বলেন, “যারা রাজনীতি ও সামাজিক ইতিহাস লিখবেন, তাদের কাজ বই দুটি সহজ করে দিল।”

সভাপতির বক্তব্যে অধ্যাপক আনিসুজ্জামান বলেন, “যার যতটুকু সম্মান প্রাপ্য, বঙ্গবন্ধু তাদের তা দিতেন। বঙ্গবন্ধু তাই আমাদের কাছে আরও বেশি আদরণীয় হয়ে উঠেছেন।”

অনুষ্ঠানে অন্যদের মধ্যে বাংলা একাডেমির মহাপরিচালক শামসুজ্জামান খান, ওয়ার্ল্ড ইউনিভার্সিটির ভিসি অধ্যাপক আব্দুল মান্নান চৌধুরী, জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপ-উপাচার্য অধ্যাপক মশিউল আলম উপস্থিত ছিলেন।