বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ২২ লাখের বেশি, মৃত ৩৯

দেশের উত্তর ও উত্তর-পূর্বাঞ্চলে বন্যায় ২২ লাখের বেশি মানুষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। আকস্মিক প্লাবনে পানিতে ভেসেসহ নানাভাবে অন্তত ৩৯ প্রাণ হারিয়েছেন।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 15 August 2017, 06:33 PM
Updated : 16 August 2017, 11:29 AM

এদিকে আগামী দুই দিন সীমান্ত সংলগ্ন ভারতের উত্তর-পূর্বের কয়েকটি প্রদেশ এবং বাংলাদেশে ভারি বৃষ্টির আভাস থাকায় দেশের উত্তরাঞ্চলে বন্যা পরিস্থিতির আরও অবনতির শঙ্কা করা হচ্ছে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা নাজনীন শামীমা মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, মাঠ কর্মকর্তাদের কাছ থেকে বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত ১৮ জেলা তথ্য পেয়েছেন তারা। এরমধ্যে ১৭টি জেলায় বন্যায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে ২২ লাখ ২৮ হাজার ৩১০ জন। বন্যার পানিতে মারা গেছেন ৩৯ জন।

বন্যায় সবচেয়ে বেশি ক্ষতি হয়েছে দিনাজপুর জেলায়। এ জেলার ১৩টি উপজেলার সবগুলোয় বন্যা কবলিত। ক্ষতিগ্রস্তের সংখ্যা এতে ৫ লাখ ৭২ হাজার ৫৫ জন।

নওগাঁর রানীনগর উপজেলার ঘোষগ্রামের বেড়ি বাঁধ মঙ্গলবার ভেঙে যায় পানির তোড়ে, প্লাবিত হয় নতুন এলাকা।

কুড়িগ্রাম, লালমনিরহাট, রংপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, নেত্রকোণা, রাঙামাটি, নীলফামারী, গাইবান্ধা, বগুড়া, সিরাজগঞ্জ, খাগড়াছড়ি, দিনাজপুর, জামালপুর, ঠাকুরগাঁও, পঞ্চগড়, ময়মনসিংহ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার ১৬০টি উপজেলার মধ্যে ৯০টি উপজেলা এখন বন্যায় প্লাবিত।

ক্ষতিগ্রস্ত ৬৪৯ ইউনিয়নে দেড় হাজারের বেশি আশ্রয় কেন্দ্রে ৮৬ হাজারেরও বেশি পরিবার আশ্রয় নিয়েছে। প্রায় পাঁচ লাখ পরিবারের ২২ লাখের বেশি মানুষ পানিবন্দীসহ নানাভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন।

দেশের উত্তর-উত্তর পূর্বাঞ্চলে নতুন এলাকা প্লাবিত হওয়ার শঙ্কা জানিয়ে আবহাওয়া অধিদপ্তর ও বন্যা পূর্বাভাস সতর্কীকরণ কেন্দ্র বলছে, ভারতের আসাম, মেঘালয়, অরুণাচল ও বিহারে আগামী দুই দিন ভারি বর্ষণের শঙ্কা রয়েছে। এ সময় দেশের ভিতরেও বৃষ্টিপাত অব্যাহত থাকবে। এ অবস্থায় বিরাজমান বন্যার আরও অবনতি হবে।

পানি উন্নয়ন বোর্ডের তত্ত্বাবধায়ক প্রকৌশলী মো. সাইফুল হোসেন বলেন, “মঙ্গলবার রাতে বহ্মপুত্রের উজানে পানি কমছে। আগামী কয়েকদিনে এর প্রভাব পড়বে দেশেও। গঙ্গা-পদ্মার পানি বাড়লেও শঙ্কা নেই, বিপদসীমা এখনও ছাড়ায়নি। কিন্তু ইতোমধ্যে প্লাবিত হয়ে গেছে বিস্তীর্ণ এলাকা। অবনতিশীল পরিস্থিতির পরিবর্তন আসতেও সময় লাগবে।”

বিস্তার ও ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনায় এবারের বন্যাকে ১৯৯৮ বা ১৯৮৮ সালের ‘ভয়াবহতা’র সঙ্গে তুলনা করার সময় এখনও হয়নি বলে মন্তব্য করেন তিনি।

তবে আগামীতে মধ্যাঞ্চল ও দক্ষিণ-মধ্যাঞ্চলের জেলাগুলো প্লাবিত হলে পরিস্থিতি ভিন্ন অবস্থায় দাঁড়াবে।

নদীর পানি বেড়ে চাঁদপুর, শরীয়তপুর ও মাদারীপুরে ভাঙন শুরু হয়েছে। ঝুঁকির মধ্যে রয়েছে মানিকগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নারায়ণগঞ্জ, নরসিংদী এবং রাজধানী ঢাকাও।

আবহাওয়া অধিদপ্তর জানায়, মৌসুমী বায়ু বাংলাদেশের উপর মোটামুটি সক্রিয় এবং উত্তর বঙ্গোপসাগরে দুর্বল থেকে মাঝারি অবস্থায় বিরাজ করায় বৃষ্টি হচ্ছে।

মঙ্গলবার ঢাকায় ১৩ মিলিমিটার বৃষ্টি হয়। এসময় দেশের সর্বোচ্চ বৃষ্টিপাত রেকর্ড হয়েছে চাঁদপুরে ১৭৫ মিলিমিটার।

“আরও দুই দিন বৃষ্টি অব্যাহত থাকবে। এরপর বৃষ্টিপাতের প্রবনাতা কমতে পারে। এরইমধ্যে উজানে আজ বৃষ্টি কম হলেও আগামী দুদিন ভারি বর্ষণের শঙ্কা রয়েছে,” বলেন আবহাওয়াবিদ আবুল কালাম মল্লিক।

আবহাওয়াবিদ আবদুর রহমান খান জানান, সক্রিয় মৌসুমী বায়ুর প্রভাবে বুধবার সিলেট ও চট্টগ্রাম বিভাগের কোথাও কোথাও ভারি থেকে অতি ভারি বর্ষণ হতে পারে। এ কারণে এই  ‍দুই বিভাগের পাহাড়ি এলাকার কোথাও কোথাও ভূমিধসের শঙ্কা রয়েছে।

এছাড়া
ময়মনসিংহ, রাজশাহী, ঢাকা, খুলনা ও বরিশাল বিভাগের অনেক জায়গায় অস্থায়ী দমকা হাওয়াসহ হালকা থেকে মাঝারি ধরনের বৃষ্টি অথবা বজ্রসহ বৃষ্টি হতে পারে।

বন্যা পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ কেন্দ্রের নির্বাহী প্রকৌশলী সাজ্জাদ হোসেন জানান, মঙ্গলবার দেশের ৯০টি পানি পর্যবেক্ষণ স্টেশনের মধ্যে ৩০টি পয়েন্টে পানি বিপদসীমার উপরে বয়ে যাচ্ছে। বহ্মপুত্র-যমুনা, গঙ্গা-পদ্মা নদ-নদীর অববাহিকায় ৭২ ঘণ্টা পানি বৃদ্ধি অব্যাহত থাকবে।

মঙ্গলবার ব্রহ্মপুত্র নদের সব কটি পয়েন্টে পানি বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। যমুনা নদী বাহাদুরাবাদ, সারিয়াকান্দি, কাজীপুর ও সিরাজগঞ্জ পয়েন্টে বিপদসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। বর্তমানে ব্রহ্মপুত্র-যমুনা নদীর পানি বাড়ছে।

কয়েকটি জেলার বন্যা পরিস্থিতি

কুড়িগ্রাম প্রতিনিধি জানান, পানিতে ভাসছে উলিপুরের হাতিয়া। চর অনন্তপুর গ্রামের কোথাও এক চিলতে শুকনা মাটি নেই। ঘরে ঘরে হাঁটু পানি থেকে অথৈ পানি। সবাই ছুটছে নিরাপদ আশ্রয়ের খোঁজে। খাদ্য ও ত্রাণের সংকট শুরু হয়েছে।

নওগাঁ প্রতিনিধি জানান, বন্যা পরস্থিতি ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। নওগাঁ শহরের রাস্তা-ঘাট বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। রাণীনগর উপজেলার গোনা ইউনিয়নের ঘোষগ্রাম নামক স্থানে নওগাঁ-আত্রাই সড়কের তিনটি, নান্দাইবাড়ীতে একটি জায়গায় সড়ক ভেঙে গেছে।

তিস্তার গ্রাসে দোকানপাট। রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলার ছালাপাকে উপ-বাঁধ ভেঙে মর্ণেয়া ইউনিয়নের আলমার বাজারের ৪৫০টি ব্যবসা-প্রতিষ্ঠান নদীতে বিলীন হয়ে যায়।

নীলফামারী
প্রতনিধি জানান, এখানে বন্যা পরিস্থিতির উন্নতি হয়েছে। তিস্তা নদীর পানি কমে যাওয়ায় জেলার অন্যান্য নদ-নদীর পানিও কমতে শুরু করেছে। তবে জেলার অধিকাংশ এলাকা এখনও হাঁটু সমান পানিতে তলিয়ে রয়েছে। এসব এলাকায় অন্তত লক্ষাধিক মানুষ পানিবন্দী।

রংপুর প্রতিনিধি জানান, রংপুরে বন্যা পরিস্থিতির কিছুটা উন্নতি হলেও দুর্ভোগে দিন কাটাচ্ছে বানভাসীরাষ; পানিবন্দী হয়ে আছে দেড় লাখেরও বেশি মানুষ। তিস্তার ডান তীর রক্ষা বাঁধ ভেঙে দুটি ইউনিয়নের ২০০ গ্রাম প্লাবিত হয়েছে।

নেত্রকোণা প্রতিনিধি জানান, পাহাড়ি ঢল ও টানা ভারি বৃষ্টিতে নেত্রকোণায় প্লাবনে অন্তত ১০ হাজার ২৫ হেক্টর রোপা আমনের জমি ও দুইশ হেক্টরের বেশি আমন বীজতলা তলিয়ে গেছে। কংস, উব্দাখালি ও ধনু নদীর পানি বিপৎসীমার উপর দিয়ে প্রবাহিত হচ্ছে। জেলায় দুই শতাধিক শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বন্ধ হয়ে গেছে।

ফরিদপুর প্রতিনিধি জানান, জেলার নিম্নাঞ্চল এরইমধ্যে প্লাবিত হয়েছে। পদ্মার পানি বাড়ার ফলে জেলা সদরের নর্থচ্যানেল ইউনিয়নের গোলডাঙ্গী সড়কটি পদ্মার পানিতে তলিয়ে গেছে। ওই সড়ক দিয়ে এখন নৌকায় করে যাতায়াত করতে হচ্ছে।