মঙ্গলবার ভোরে চার তলা ওই ভবন ঘিরে ফেলার পর পুলিশের আত্মসমর্পণের আহ্বানে সাড়া না দিয়ে খুলনা থেকে আসা ওই তরুণ সুইসাইড ভেস্টে বিস্ফোরণ ঘটিয়ে আত্মঘাতী হন।
পুলিশ মহাপরিদর্শক এ কে এম শহীদুল হক বলেছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের মৃত্যুবার্ষিকীতে ধানমণ্ডি বত্রিশ নম্বরের জমায়েতে আত্মঘাতী হামলার পরিকল্পনা ছিল সাইফুল ইসলাম নামের ওই জঙ্গির।
জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে মঙ্গলবার ভোর সাড়ে ৬টায় ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে ফুল দিয়ে শ্রদ্ধা জানান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
পরে স্পিকার শিরীন শারমিন চৌধুরী, প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা, আওয়ামী লীগ ও সহযোগী সংগঠনগুলোর পক্ষ থেকেও বঙ্গবন্ধুর প্রতিকৃতিতে শ্রদ্ধা জানানো হয়।
শ্রদ্ধা নিবেদনের এই আনুষ্ঠানিকতা শুরুর আগেই আনুমানিক তিনশ মিটার দূরে পান্থপথের স্কয়ায় হাসপাতালের কাছে ওলিও ইন্টারন্যাশনাল হোটেল ঘিরে ফেলেন পুলিশের কাউন্টার টেররিজম ও সোয়াট সদস্যরা। রাসেল স্কয়ার থেকে পান্থপথ-গ্রিন রোড পর্যন্ত প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তার দুই পাশে যান চলাচলও বন্ধ করে দেওয়া হয়।
অভিযান শেষে বেলা ১১টার দিকে আইজিপি শহীদুল হক এবং পরে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের প্রধান মনিরুল ইসলাম সাংবাদিকদের ব্রিফ করেন।
মনিরুল বলেন, দুই দিন আগে তারা তথ্য পান যে এ মাসেই বড় ধরনের নাশকতার পরিকল্পনা করছে জঙ্গিরা। এর ভিত্তিতে বিভিন্ন হোটেল ও মেসে তারা তল্লাশি চালানো শুরু করেন।
“আমাদের কাছে ইনফরমেশন ছিল, যে চক্র হামলা করবে, তারা খুব কাছাকাছি অবস্থান করছে। গতকাল সন্ধ্যায় তথ্য পেলাম, ১৫ অগাস্টকে কেন্দ্র করে অনেক বড় ধরনের নাশকতা ঘটানো হবে। আরও জানতে পারি, মিরপুর রোড ও পান্থপথ- ওই এলাকাতেই তারা থাকবে।”
ওই তথ্যের ভিত্তিতে অনুসন্ধান চালিয়ে হোটেল ওলিও ইন্টারন্যাশনালে সন্দেহভাজন জঙ্গির অবস্থান শনাক্ত করা হয়। তারপর ভোর ৩টার দিকে সেখানে তল্লাশি শুরু করে পুলিশ।
মনিরুল বলেন, “তল্লাশির সময় ওই হোটেলের প্রতিটি কক্ষের বোর্ডারকে ডাকা হয়। তারা কক্ষ থেকে বেরিয়ে এসে নিজেদের পরিচয় দেন। কিন্তু চতুর্থ তলার একেবারে পূর্ব দিকের শেষ কক্ষের বোর্ডারকে ডাক দিলে সে ভেতর থেকে বলে, ‘আপনারা কারা, সকালের আগে আমি দরজা খুলব না’।”
সে সময় ওই কক্ষের একটি জানালা দিয়ে পুলিশ সদস্যরা একটি ব্যাগ ও তার দেখতে পান। পরে আর কথা না বলে বাইরে থেকে তালা লাগিয়ে দিয়ে কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিট ও বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দলের সদস্যরা নিচে নেমে অবস্থান নেন।
এরই মধ্যে চলতে থাকে অভিযানে প্রস্তুতি। হোটেলের অন্য বোর্ডারদের নিরাপদে সরিয়ে নেওয়া হয়। সড়কে যান চলাচল বন্ধ করে দিয়ে আশপাশের প্রতিটি গলিতে অবস্থান নেন পুলিশ সদস্যরা।
কাউন্টার টেরোরিজম, সোয়াট, বোমা নিষ্ক্রিয়কারী দল ও অন্যান্য বাহিনীর এই অভিযানের নাম দেওয়া হয় অপারেশন ‘অগাস্ট বাইট’।
আইজিপি বলেন, পুলিশ মাইকে আত্মসমর্পণের আহ্বান জানালেও ওই তরুণ তাতে সাড়া দেয়নি। ফলে পুলিশ অভিযানে যেতে বাধ্য হয়।
“পুলিশ যখন অপারেশন শুরু করেছে, তখন সে একটি বিস্ফোরণ ঘটিয়ে পুরো দরজা ভেঙে ফেলে। সে যখন আরেকটি বোমা ফাটাতে যাবে, পুলিশ তখন গুলি করে। তার সাথে সুইসাইড ভেস্ট ছিল, ব্যাকপ্যাক ছিল, সেগুলো দিয়ে সে নিজেই আত্মাহুতি দিয়েছে।”
পুলিশের দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, সাইফুল ইসলামের বাড়ি ডুমুরিয়া উপজেলার সাহস ইউনিয়নের নোয়াকাঠি গ্রামে। ওই এলাকার উলা দাখিল মজিদিয়া মাদ্রাসা থেকে দাখিল এবং খুলনা আলিয়া মাদ্রাসা থেকে আলিম পাসের পর তিনি সরকারি বিএল কলেজের রাষ্ট্র বিজ্ঞান বিভাগে ভর্তি হন।
নব্য জেএমবির সদস্য সাইফুল এক সময় ছাত্রশিবিরের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলে সাংবাদিকদের জানিয়েছেন কাউন্টার টেররিজমের মনিরুল।
সাইফুলের বাবা আবুল খায়ের মোল্লা নোয়াকাঠির মাঠের হাট মসজিদের ইমাম এবং ইউনিয়ন জামায়াতে ইসলামীর বায়তুল মাল (কোষাধ্যক্ষ) সম্পাদক।
চাকরির খোঁজ করার কথা বলে ৭ অগাস্ট ঢাকায় আসেন সাইফুল। সোমবার তিনি ওলিও ইন্টারন্যাশনাল হোটেলে ওঠেন।
ডুমুরিয়া থানা পুলিশ আবুল খায়ের মোল্লাকে থানায় নিয়ে প্রায় তিন ঘণ্টা জিজ্ঞাসাবাদ করেছে।
এছাড়া সাইফুলের সঙ্গে আগে থেকে যোগাযোগ থাকায় নোয়াকাঠি গ্রামের আবু ওয়াহেদের ছেলে মো. সানি (২২) ও একই এলাকার জালাল সরদারের ছেলে ইসানকে (২১) জিজ্ঞাসাবাদের জন্য থানায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে।
বিস্ফোরণে ছিটকে পড়া ইটের টুকরো মাথায় লেগে আহত একজনকে সরিয়ে নিতে দেখা যায় রাস্তার ওপর থেকে।
আইজিপি বলেন, “বোঝা যাচ্ছে অত্যন্ত শক্তিশালী বিস্ফোরক ছিল। এটা যদি কোনো জনসভা বা সমাবেশে ব্লাস্ট করা হত, তাহলে বড় ধরনের ক্ষতি হত। আল্লাহর রহমতে আমাদের গোয়েন্দা ও কাউন্টার টেররিজম পুলিশের চৌকস তৎপরতার কারণে এ বিপদ থেকে রক্ষা পেয়েছি।”
কাউন্টার টেরোরিজম ইউনিটের অতিরিক্ত উপ কমিশনার ছানোয়ার হোসেন জানান, অভিযানের পর বোমা নিষ্ক্রিয়করণ ইউনিটের সদস্যরা ওই হোটেল কক্ষে একটি ট্র্যাভেল ব্যাগে বোমার সন্ধান পান। পরে ওই অবস্থাতেই নিয়ন্ত্রিতভাবে তাতে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়।
ছানোয়ার বলেন, ভেতরে তল্লাশি চালিয়ে আর কোনো অস্ত্র বা বিস্ফোরক তারা পাননি।
কলাবাগান থানার পরিদর্শক তদন্ত সমীর চন্দ্র সূত্রধর জানান, পান্থপথের ওলিও ইন্টারন্যাশনাল হোটেলের মালিক লায়ন ফিরোজুর রহমান ওলিও। তিনি হোটেল এরাম ইন্টারন্যাশনাল, হোটেল গোল্ডেন ড্রাগন ও হোটেল পিকক লিমিটেডেরও মালিক।
ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সুলতানপুর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান স্ট্যান্ডার্ড ব্যাংক লিমিটেডের একজন উদ্যোক্তা পরিচালক। হোটেলে পুলিশের অভিযান নিয়ে তার বা তার প্রতিষ্ঠানের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি।