বিচারপতি খায়রুল হকের গাত্রদাহ কেন: বিএনপি

সংবিধানের ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায় নিয়ে আইন কমিশনের চেয়ারম্যান হিসেবে সাবেক প্রধান বিচারপতি এ বি এম খায়রুল হকের প্রতিক্রিয়া জানানোর সমালোচনা করেছে বিএনপি।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 10 August 2017, 03:05 PM
Updated : 10 August 2017, 03:28 PM

আইন কমিশনের চেয়ারম্যান ও আইনমন্ত্রীর প্রতিক্রিয়া আসার পর বৃহস্পতিবার বিএনপির এক সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, তাদের দুজনের বক্তব্য ‘একই সুরে বাঁধা’।  

বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, “সরকার বা সরকারি দল আওয়ামী লীগ কোনো আনুষ্ঠানিক প্রতিক্রিয়া দেওয়ার পূর্বেই এ বি এম খায়রুল হক সুপ্রিম কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে বিষোদগার করেছেন। মনে হল,  এই রায়ের ফলে তার গাত্রদাহ শুরু হয়েছে।

“বিচারপতি খায়রুল হকের বক্তব্য আওয়ামী লীগের নেতা ও মন্ত্রীদের বক্তব্যের মধ্যে কোনো অমিল আছে বলে আমরা মনে করি না, একই সুরে বাঁধা। তার বক্তব্যই আওয়ামী লীগের বক্তব্য।”

বিচারপতি খায়রুল হকের সংবাদ সম্মেলনের বৈধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ বলেন, “তিনি সরকারের কোষাগার থেকে পাওয়া বেতনভুক্ত একজন কর্মকর্তা। সরকারের কোনো কর্মকর্তার এই ধরনের সংবাদ সম্মেলন করা সম্পূর্ণভাবে সরকারি আচরণবিধির লঙ্ঘন।

“তিনি (খায়রুল হক) যে উদ্দেশ্যে এই সংবাদ সম্মেলন করেছেন, তাতে তার দলীয় রাজনৈতিক আচরণের উন্মোচন হয়েছে।”

বিচারপতি অপসারণের ক্ষমতা সংসদের হাতে ফেরাতে সংবিধানে আনা ষোড়শ সংশোধনী বাতিল করে সর্বোচ্চ আদালত আগের সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ফিরিয়ে আনার পর তা নিয়ে তুমুল আলোচনা চলছে।

আওয়ামী লীগ আমলে আনা সংশোধনী বাতিল করে জিয়াউর রহমান আমলে গঠিত সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ফিরিয়ে আনার এই রায়কে ‘ম্যাগনাকার্টা’ বলছে বিএনপি।

সাবেক প্রধান বিচারপতি খায়রুল হক বুধবার এক সংবাদ সম্মেলনে এই রায়কে ‘পূর্ব ধারণা প্রসূত’ বলেছেন। সংসদ সদস্যদের নিয়ে প্রধান বিচারপতির পর্যবেক্ষণকে তার ‘অপ্রাসঙ্গিক’ মনে হয়েছে, শব্দ চয়নে তিনি দেখতে পেয়েছেন ‘অপরিপক্কতা’।    

এই রায়কে কেন্দ্র করে প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার সমালোচনা করছেন আওয়ামী লীগের নেতারা। আইনমন্ত্রী বলেছেন, মামলার ‘ফ্যাক্ট অব ইস্যুর’ সঙ্গে সম্পর্কিত নয় এমন ‘অনেক অপ্রাসঙ্গিক কথা’ প্রধান বিচারপতি তার রায়ে বলেছেন।

তাদের প্রতিক্রিয়ার পর বৃহস্পতিবার নিজেদের বক্তব্য নিয়ে নয়া পল্টনে দলীয় কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলনে আসেন বিএনপি নেতারা।

বিচারপতি খায়রুল হকের সমালোচনা করে ফখরুল বলেন, “তিনি যখন প্রধান বিচারপতি ছিলেন, তখন যেসব রায় দিয়েছেন তা বাংলাদেশের গণতন্ত্রকে কতখানি ক্ষতিগ্রস্ত করেছে, তা দেশের মানুষ এখন হাড়ে হাড়ে টের পাচ্ছে। বিচারপতি হকের রায়ের পরেই দেশে রাজনৈতিক অস্থিরতা, অস্থিতিশীলতা ও হতাশা বৃদ্ধি পেয়েছে।”

সামরিক শাসন অবৈধ ঘোষণা করে রায় বিচারপতি খায়রুল হক দিয়েছিলেন। তত্ত্বাবধায়ক সরকার বিলুপ্তির রায়ও এসেছিল তার কাছ থেকেই।

মওদুদ বলেন, “এই ভদ্রলোকের লজ্জাবোধ নাই। ত্রয়োদশ সংশোধনীর রায় ঘোষণা করে তিনি(বিচারপতি খায়রুল হক) বললেন, আগামী দুইট টার্মের জন্য তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচন করা যেতে পারে। ১৬ মাস পরে উনি পূর্ণাঙ্গ রায় দিলেন। সেই রায়ের মধ্যে এই কথাগুলো নাই।

“একজন প্রধান বিচারপতি তিনি যদি এরকম অনৈতিক কাজ করেন, আমি মনে করি তিনি (খায়রুল হক) বিরাট একটা অপরাধ করেছেন। ইট ইজ এ জুডিশিয়াল ক্রাইম হি হ্যাজ কমিটেড।”

পঞ্চম সংশোধনী বাতিলের রায়ে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলকে বৈধতা দেওয়ার কথাও বলেন সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মওদুদ।

উনি (খায়রুল হক) বলছেন যে প্রয়োজনের খাতিরে অনেকগুলো মার্জনা করেছেন। এই মার্জনার মধ্যে সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল ছিলো। উনি পঞ্চম সংশোধনী বাতিল করলেন কিন্তু সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিল বাতিল করলেন না কেন?”

ফখরুল বলেন, “আমরা স্পষ্টভাষায় বলতে চাই, পঞ্চম ও ত্রয়োদশ সংশোধনী বাতিলের ফলে আজ দেশে যে সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সঙ্কট সৃষ্টি হয়েছে, তা গণতন্ত্রকে পুরোপুরি ভঙ্গুর করে ফেলেছে।”

রায় নিয়ে আওয়ামী লীগের প্রতিক্রিয়ায় জবাবে বিএনপি মহাসচিব বলেন, “তারা (আওয়ামী লীগ) যে দানব সৃষ্টি করেছেন, সেই দানবই আজকে তাদেরকে গ্রাস করতে চলেছে, এখনও তা তারা বুঝে উঠতে পারছেন না।”

‘আইনমন্ত্রীর বক্তব্য দেয়াটা উচিৎ হয়নি’

সুপ্রিম কোর্টের রায় নিয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের বক্তব্য দেওয়া সঠিক হয়নি বলে মন্তব্য করেছেন সাবেক আইনমন্ত্রী মওদুদ আহমদ।

তিনি বলেন, “আইনমন্ত্রী হিসেবে তার এই কথাটা বলা একেবারেই উচিৎ হয়নি। আইনমন্ত্রীর দায়িত্ব হল যে বাংলাদেশে আদালতগুলো যে রায় দেয় সেই রায়গুলোকে বাস্তবায়ন করা। তিনি সেই দায়িত্ব থেকে সরে এসেছেন রাজনৈতিক কারণে।”

ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের পূর্ণাঙ্গ রায়ে কোনো অপ্রাসঙ্গিক বক্তব্য রাখা হয়নি বলে মনে করেন মওদুদ।

“কোনো অপ্রসাঙ্গিক বক্তব্য রাখা হয়নি। কারণ বিচার বিভাগের স্বাধীনতা কোনো আইসোলেটেড ব্যাপার না। এটা সমাজ, রাজনীতি, সংসদ, সংবিধান, রাষ্ট্র সব কিছুর সাথে জড়িত। আমরা মনে করি, সুপ্রিম কোর্ট যা কিছু বলেছেন প্রত্যেকটি শব্দ প্রাসঙ্গিক।”

আনিসুল হককে এই রায়ের রিভিউ চাওয়ার পরামর্শ দিয়ে সাবেক আইনমন্ত্রী মওদুদ বলেন, “বিচার বিভাগকে বিতর্কিত না করে, তাদের ভাবমূর্তি নষ্ট না করে সরকারের উচিৎ হবে, রিভিউ পিটিশন ফাইল করে তাদের যে বক্তব্য আছে সেটা তুলে ধরা। কিন্তু সুপ্রিম কোর্টকে স্ক্যান্ডালাইজড করার অধিকার তাদের নাই।”

ষোড়শ সংশোধনী বাতিলের রায়ের ফলে দেশ সেনা শাসনের দিকে যাওয়ার শঙ্কার বিষয়ে সাংবাদিকদের প্রশ্নে সামরিক সরকারের মন্ত্রী মওদুদ বলেন, “এটা উনার (খায়রুল হক) ইচ্ছা, আমাদের না। উনাকে জিজ্ঞাসা করুন, আপনি এই ইচ্ছা পোষণ করছেন কি না?”

সংবাদ সম্মেলনে বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, জমিরউদ্দিন সরকার, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ভাইস চেয়ারম্যান খন্দকার মাহবুব হোসেন, জয়নাল আবেদীন, আহমেদ আজম খান, নিতাই রায় চৌধুরী, কেন্দ্রীয় নেতা হারুনুর রশীদ, শহীদউদ্দিন চৌধুরী এ্যানি, সানাউল্লাহ মিয়া, কায়সার কামাল উপস্থিত ছিলেন।