গেল দুই মাসে এ মাছটি নিয়ে কারো আপত্তি না থাকায় ‘জিআই’ পণ্য হিসেবে স্বীকৃতি দিচ্ছে দেশীয় প্রতিষ্ঠান পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর। শিগগিরই মৎস্য অধিদপ্তরের কাছে এ সংক্রান্ত সনদ হস্তান্তর করা হবে বলে জানিয়েছে অধিদপ্তর।
অধিদপ্তরের রেজিস্ট্রার মো. সানোয়ার হোসেন সোমবার জানান, গত বছর মৎস্য অধিদপ্তর জাতীয় মাছ ইলিশকে ভৌগলিক নির্দেশক পণ্য (জিআই) হিসেবে নিবন্ধনের জন্য আবেদন করে।
“আমরা আবেদন পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে আইন অনুসারে ১ জুন গেজেট প্রকাশ করি। এ বিষয়ে কারো কোনো আপত্তি রয়েছে কি না তা যাচাই করতেই এ গেজেট প্রকাশ। এ তারিখ থেকে দু’মাস সময় দেওয়া হয়; এ নিয়ে কোনো আপত্তি পাইনি।”
গেল বছর জিআই পণ্য হিসেবে প্রথমবারের মতো জামদানিকে মতো স্বীকৃতি দেয় পেটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্কস অধিদপ্তর।
সানোয়ার হোসেন বলেন, “গত বছর জামদানিকে দিয়েছি, এ বছর ইলিশকে দিতে যাচ্ছি। শিগগিরই মৎস্য অধিদপ্তরকে এ সংক্রান্ত সনদ তুলে দেওয়া হবে।”
বাংলাদেশের ইলিশ সুস্বাদু। এর ব্যাপক চাহিদা ভারতেও রয়েছে। বিদেশে এতদিন রপ্তানিতে বাংলাদেশি ইলিশের কোনো ব্রান্ডিং ছিল না, নাম ছিল। যার ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে শনাক্তকরণের কোনো পদ্ধতিও ছিল না।
ইলিশ উৎপাদনে বাংলাদেশ বিশ্বের অন্যতম। বাংলাদেশে বিশ্বের মোট ৭৫ শতাংশ ইলিশ আহরিত হয়। এছাড়া ১৫ শতাংশ মিয়ানমার, ৫ শতাংশ ভারত ও ৫ শতাংশ অন্যান্য দেশের।
বাংলাদেশি ইলিশ
রূপালি ইলিশের বৈশিষ্ট্য নিয়ে পোনা থেকে বড় আকৃতির সার্বিক চিত্র তুলে ধরা হয় মৎস্য অধিদপ্তরের আবেদনে।
>> টর্পেডো আকৃতির রূপালি রংয়ের মাছ, পৃষ্ঠদেশে কিছুটা কালচে আভা।
>> তিন প্রকারের ইলিশ পাওয়া যায়; ইলিশ, চন্দনা ইলিশ ও গুর্তা/কানাগুর্তা ইলিশ।
>> আরও চার প্রজাতির ইলিশ বাংলাদেশ ঊপকূলে পাওয়া যায়। রামগাছা/রামচৌককা, পেতি চৌককা, চৌককা/চৌককা ফাইসা ও করোমেনডেল ইলিশ।
>> দেশের সব নদ-নদী, মোহনা, উপকূলীয় এলাকায় ডিম ছাড়ে ইলিশ।
>> মেঘনা নদীর ঢলচর, মনপুরা দ্বীপ, মৌলভীর চর ও কালির চর এলাকাকে ইলিশের প্রধান প্রজনন ক্ষেত্র ধরা হয়, যার আয়তন প্রায় ৭ হাজার বর্গকিলোমিটার।
সংরক্ষণ ও আহরণ
মৎস্য অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানান, দেশের পদ্মা-মেঘনা অববাহিকার প্রধান নদ-নদী ও উপকূলীয় এলাকায় পাওয়া যায় ইলিশ। এটি লম্বায় সর্বোচ্চ ৬৩ সেন্টিমিটার ও ওজনে তিন কেজি ৩০০ গ্রাম হতে পারে। তবে সচরাচর ২ কোজি ওজনে পৌঁছানোর আগে জেলেদের জালে ধরা পড়ে ইলিশ।
একসময় দেশে প্রচুর পাওয়া গেলেও বর্তমানে দেশের প্রায় ১০০ নদ-নদীতে পাওয়া যাচ্ছে ইলিশ। এর প্রধান আহরণ এলাকা হচ্ছে- মেঘনা নদীর নিম্নাঞ্চল, তেঁতুলিয়া, কালাবদর বা আড়িয়াল খাঁ, ধর্মগঞ্জ, নয়াভাঙগানি, বিষখালি, পায়রা, রূপসা, শিবসা, পশুর, কচা, লতা, লোহাদিয়া, আন্ধারমানিকসহ অনেক মোহনা ও উপকূলীয় অঞ্চল।
ইলিশ মাছ সারা বছরই প্রজনন করলেও বেশি করে অক্টোবর মাসের বড় পূর্ণিমায়। এসময় ৬০-৭০ শতাংশ ইলিশ পরিপক্ক ও ডিম ছাড়ার উপযোগী হয়। সাধারণ এক বছরের বয়সে মাছ পরিপক্ক হয়। আবহাওয়ার তারতম্যে অনেক সময় ৮-১০ মাস বয়সেও পরিপক্ক হতে পারে।
ইলিশের অবদান
>> দেশের মোট মৎস্য উৎপাদনে ইলিশ মাছের অবদান প্রায় ১০ শতাংশ। এর বার্ষিক উৎপাদন প্রায় ৩.৮৭ লাখ মেট্রিক টন (২০১৪-২০১৫); যার বাজার মূল্য ১৫ হাজার ৪৮০ কোটি টাকা।
>> জিডিপিতে ইলিশের অবদান প্রায় ১%।
>> কর্মসংস্থানে ইলিশের ভূমিকা রয়েছে ব্যাপক। দেশের ৪০ জেলার প্রায় ১৪৫ উপজেলার ১৫০০টি ইউনিয়নের সাড়ে ৪ লাখ জেলে ইলিশ মাছ ধরে। এরমধ্যে গড়ে ৩২% সার্বক্ষণিক ও বাকি ৬৮% খণ্ডকালীন জড়িত।
>> এছাড়া বিপণন, পরিবহন, প্রক্রিয়াজাতকরণ, রপ্তানি ও জাল-নৌকা তৈরিতে সার্বিকভাবে ২০-২৫ লাখ লোক প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষাভাবে জড়িত।
ঐতিহ্যে ইলিশ
জিআই পণ্য হিসেবে নিবন্ধনের আবেদনে মৎস্য অধিদপ্তর জানায়, ১৮২২ সাল থেকে ইলিশ বাংলাদেশের ঐতিহ্য ও কৃষ্টির সঙ্গে জড়িয়ে আছে। অর্থনীতি, কর্মসংস্থান ও আমিষ জাতীয় খাদ্যে এ মাছের ভূমিকা রয়েছে।
কবি সত্যেন্দ্রনাথ দত্তের ‘ইলশে গুড়ি’ কবিতা এখনও আমাদের আলোড়িত করে। প্রাচীনকালের লোকজনের বিশ্বাস ছিল, আশ্বিন-কার্তিক মাসের দুর্গাপূজার দশম দিন থেকে মাঘ-ফাল্গুনের স্বরস্বতী পূজার দিন পর্যন্ত ইলিশ ধরা ও খাওয়া বন্ধ রাখা হলে এ মাছ বহুগুণে বৃদ্ধি পায়।
মানিক বন্দ্যোপাধ্যায়ের ‘পদ্মা নদীর মাঝি’ উপন্যাসেও প্রমত্ত পদ্মায় এক সময় ইলিশ মাছে ভরপুর থাকার কথা রয়েছে।