বিশ্বজিতের পলাতক খুনিরা কে কোথায়

পুরান ঢাকার দর্জি বিশ্বজিৎ দাস হত্যা মামলায় মৃত্যুদণ্ড ও যাবজ্জীবন কারাদণ্ডাদেশ পাওয়া ১৭ আসামির মধ্যে ১৩ জনকে পুলিশ পাঁচ বছরেও গ্রেপ্তার করতে পারেনি।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 6 August 2017, 06:54 PM
Updated : 6 August 2017, 07:07 PM

এই মামলায় জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের মোট ২১ নেতাকর্মীকে দোষী সাব্যস্ত করে ২০১৩ সালের ১৮ ডিসেম্বর আট আসামিকে মৃত্যুদণ্ড ও বাকিদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দিয়েছিল বিচারিক আদালত।

রোববার হাই কোর্টের রায়ে দুইজনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখে চারজনকে খালাস দেওয়া হয়েছে। দুই আদালত মিলিয়ে যাবজ্জীবন সাজা বহাল রয়েছে ১৫ জনের।

দণ্ডিত এই ১৭ জনের মধ্যে পাঁচজন দেশের বাইরে চলে গেছে বলে তথ্য পাওয়া গেলেও বেশিরভাগই দেশে রয়েছেন বলে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের অনুসন্ধানে জানা গেছে।

২০১২ সালের ৯ ডিসেম্বর বিএনপি নেতৃত্বাধীন ১৮ দলের অবরোধের মধ্যে পুরান ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্কের কাছে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের একটি মিছিল থেকে কুপিয়ে ও পিটিয়ে বিশ্বজিৎকে হত্যা করা হয়।

সূত্রাপুর থানা পুলিশ প্রথমে মামলার তদন্তে থাকলেও পরে তা ঢাকা মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

সাজাপ্রাপ্ত পলাতক আসামিদের গ্রেপ্তারের বিষয়ে জানতে চাইলে মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন রোববার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম বলেন, “যাদের এখনও গ্রেপ্তার করা যায়নি, পুলিশ তাদের আইনের আওতায় আনতে কাজ করছে।”

নাম প্রকাশ না করে এক ডিবি কর্মকর্তা বলেন, আসামিদের গ্রেপ্তারি পরোয়ানা হলে বা রায় হলে তা তাদের স্থায়ী ঠিকানায় চলে যায়। স্থানীয় পুলিশ সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নেয়।

ফাঁসির আসামি একজন ‘কলকাতায়’

বিশ্বজিৎ হত্যা মামলায় ফাঁসির দণ্ড পেয়েছেন সুনামগঞ্জের মনতলার কেশবপুরে সুখেন চন্দ্র তালুকদারের ছেলে রাজন তালুকদার, যিনি ওই হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বহিষ্কার হওয়ার আগে রসায়ন বিভাগের ছাত্র ছিলেন।

তার বন্ধু ও ঘনিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, রাজন ভারতের কলকাতায় পালিয়ে গিয়ে সেখানে একটি রাজনৈতিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়েছেন। দীর্ঘদিন বন্ধ থাকার পর কয়েক মাস আগে তার ফেইসবুক অ্যাকাউন্টও সচল করেছেন।

সম্প্রতি এক বন্ধুকে রাজন বলেন, অন্য আসামিদের জামিন না হলে তিনি দেশে ফিরবেন না। ফেইসবুকে নিজের অবস্থান ঢাকায় লিখলেও ভারতীয় একটি ফোন নম্বর সেখানে দেওয়া হয়েছে।

হাই কোর্টে রায়ের আগের দিন শনিবার ফেইসবুকে রাজন এবং এ মামলার ২১ আসামিকে নিয়ে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহ সভাপতি তানবির আহম্মেদ সিদ্দিকীর একটি পোস্টও তিনি শেয়ার করেছেন।

মৃত্যুদণ্ডের আরেক আসামি মো. রফিকুল ইসলাম ওরফে শাকিল পটুয়াখালীর কালিকাপুরের ফায়ার সার্ভিস রোডের আনসার আলীর ছেলে। তিনি জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগের ছাত্র ছিলেন।

 

যাবজ্জীবন পাওয়া ‘চারজন বিদেশে’

নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ডের রায় হলেও হাই কোর্টে এসে পলাতক আসামি মীর মো. নূরে আলম ওরফে লিমনের যাবজ্জীবন সাজা হয়েছে। রংপুরের পীরগাছা উপজেলার সুল্লিপাড়ার মীর মো. নুরুল ইসলামের ছেলে লিমন ছিলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের রাষ্ট্রবিজ্ঞান বিভাগের ছাত্র।

লিমন বর্তমানে মিরপুরের একটি পোশাক কারখানায় কাজ করছেন বলে তার এক বন্ধু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানিয়েছেন।

মৃত্যুদণ্ডের সাজা কমে যাবজ্জীবন পাওয়া মাহফুজুর রহমান নাহিদ, এমদাদুল হক এমদাদ ও জি এম রাশেদুজ্জামান শাওন আছেন কারাগারে।

তাদের মধ্যে ভোলার দৌলতখানের আবদুর রহমানের ছেলে নাহিদ জগন্নাথের বাংলা বিভাগের; যশোরের শার্শা উপজেলার পাঁচ কাইবা পূর্বপাড়া এলাকার আকরাম আলীর ছেলে এমদাদ দর্শন বিভাগ এবং খুলনার পাইকগাছা উপজেলার জিএম লুৎফর রহমানের ছেলে শাওন ইতিহাস বিভাগের ছাত্র ছিলেন।

নিম্ন আদালতে যাদের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছিল, তাদের মধ্যে ১১ জন পলাতক থাকায় আপিল করার সুযোগ পাননি। হাই কোর্টের রায়ে তাদের বিষয়ে কোনো মন্তব্যও করা হয়নি। ফলে মাথার ওপর যাবজ্জীবন সাজাই বহাল রয়েছে।  

এদের মধ্যে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগরের নারায়ণপুর এলাকার মৃত আব্দুল কাইয়ূমের ছেলে মো. কামরুল হাসান এখন আছেন মালয়েশিয়ায়।  সেখান থেকে ফেইসবুকে পোস্টও দিচ্ছেন জগন্নাথের অ্যাকাউন্টিং বিভাগের এই বহিষ্কৃত ছাত্র।

মাদারীপুরের রাজৈর উপজেলার সাতবাড়িয়া গ্রামের আক্কাস আলী শেখের ছেলে আল আমিন শেখ নিম্ন আদালতে রায় হওয়ার পরপরই কলকাতায় পালিয়ে গিয়ে একটি বেসরকারি কোম্পানিতে চাকরি নেন বলে তার বন্ধু ও নিকটজনদের ভাষ্য। 

তার এক বন্ধু ও ছাত্রলীগ নেতা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কিছুদিন আগে আল আমীন কলকাতা থেকে আমাকে ফোন দিয়েছিল।”

নোয়াখালীর ওবায়দুল কাদের ওরফে তাহসিন ভারত হয়ে দুবাই পালিয়ে গেছেন বলে তার বন্ধুদের মাধ্যমে জানা যায়। তিনি হাতিয়ার এক নম্বর ওয়ার্ডের চরকৈলাশের মাওলানা মহিউদ্দিনের ছেলে।

বগুড়ার সেওজ আমতলা এলাকার সামসুজ্জোহার ছেলে তারিক বিন জোহর ওরফে তমালও নিম্ন আদালতে রায় হওয়ার পর প্রথমে মালয়েশিয়ায় এবং সেখান থেকে সিঙ্গাপুরে চলে যান বলে ছাত্রলীগ কর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়।

বাকিদের মধ্যে ফরিদপুরের সদরপুরের চরচাঁদপুর এলাকার মীর আব্দুল জলিলের ছেলে ইমরান হোসেন ওরফে ইমরান ও নড়াইলের কল্যাণখালী এলাকার নূর মিয়ার ছেলে রফিকুল ইসলাম রাজধানীতেই রয়েছেন বলে তাদের বন্ধুরা জানিয়েছেন।

ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, মাগুরার গাংনালিয়ার খন্দকার ইয়াকুব আলীর ছেলে ইউনুস আলী মাঝেমধ্যেই বাড়ি আর ঢাকায় যাতায়াত করেন। ঢাকায় আওয়ামী লীগের এক নেতার সঙ্গেও তাকে দেখা যায়।

কিশোরগঞ্জের ভৈরবের শ্রীনগর এলাকার মাহতাব উদ্দিনের ছেলে মোশারেফ হোসেন পুরান ঢাকার ওয়ারীতে এক নেতার বাসায় থাকতেন। তবে এখন তিনি কোথায়, সে বিষয়ে কোনো তথ্য বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানতে পারেনি।

ছাত্রলীগের কর্মী ও বন্ধুদের তথ্য অনুযায়ী, খুলনার খানজাহান আলী থানার গিলাতলা এলাকার শেখ আ. মান্নানের ছেলে আজিজুর রহমান ওরফে আজিজ এলাকাতেই আছেন।

পুলিশের খাতায় ‘পলাতক’ মো. আলাউদ্দিন গাজীপুরে একটি পোশাক কারখানায় চাকরি করেন বলে তার স্বজনদের তথ্য। আলাউদ্দিন পঞ্চগড়ের আটোয়ারির ছোট ধাপ এলাকার হবিবুর রহমানের ছেলে।

এছাড়া কিশোরগঞ্জের ভৈরবের রাধানগর মধ্যপাড়া মোল্লাবাড়ির আ. হাসেমের ছেলে মনিরুল হক ওরফে পাভেল ঢাকাতেই আছেন বলে তার বন্ধুরা জানিয়েছে।

এছাড়া নিম্ন আদালতে মৃত্যুদণ্ড পাওয়া সাইফুল ইসলাম ও কাইয়ুম মিঞা এবং যাবজ্জীবনের আসামি গোলাম মোস্তফা ও এ এইচ এম কিবরিয়া হাই কোর্টে খালাস পেয়েছেন। এই চারজনই আছেন কারাগারে।