আমরা কি কিছুই বলতে পারব না: প্রধান বিচারপতি

নিম্ন আদালতের বিচারকদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলাবিধানের যে ক্ষমতা সংবিধানে রাষ্ট্রপতিকে দেওয়া হয়েছে, তা সুপ্রিম কোর্ট ‘নিয়ে নিতে চায়’ বলে আইনমন্ত্রী আনিসুল হকের মন্তব্যে তীব্র প্রতিক্রিয়া হয়েছে আপিল বিভাগে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 1 August 2017, 07:02 AM
Updated : 1 August 2017, 07:42 AM

প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা মঙ্গলবার অ্যাটর্নি জেনারেলকে বলেছেন, “আপনারা প্রধান বিচারপতি ও কোর্টের স্বাধীনতা খর্ব করতে করতে এমন জায়গায় নিয়ে যাচ্ছেন… আমরা কি কিছুই বলতে পারব না? আমরা কি কোর্টে বসে মন্তব্য করতে পারব না?”

বিচারকদের শৃঙ্খলাবিধি নিয়ে বিচার বিভাগের সঙ্গে রাষ্ট্রের নির্বাহী বিভাগের দীর্ঘ টানাপড়েনের পর আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ওই বিধিমালার খসড়া সুপ্রিম কোর্টে জমা দিলেও প্রধান বিচারপতি রোববার তা গ্রহণ না করে কয়েকটি শব্দ ও বিধি নিয়ে তীব্র ক্ষোভ প্রকাশ করেন। 

সেদিন তিনি অ্যাটর্নি জেনারেলকে বলেন, “আইনমন্ত্রীর সঙ্গে কথা হল। উনি খসড়া দিয়ে গেলেন। আমি তো খুশি হয়ে গেলাম। যদিও খুলে দেখিনি। কিন্তু এটা কী! এখানে বলা হল ‘উপযুক্ত কর্তৃপক্ষ’। এটার মানে কী? সব আইনে ব্যাখ্যা থাকে। কিন্তু এখানে কোনো ব্যাখ্যা নেই। কর্তৃপক্ষ বলতে বিচার বিভাগের জন্য রাষ্ট্রপতিকে রাখলেন। তবে তো আইন মন্ত্রণালয়ই থাকছে। এর সমাধান না হলে চলবে না।”

প্রধান বিচারপতি সেদিন বলেন, কারও বিরুদ্ধে অভিযোগ উঠলে তাকে মন্ত্রণালয়ে সংযুক্ত করার কথা বলা হয়েছে আইনমন্ত্রীর দেওয়া বিধিমালার খসড়ায়।

“তাহলে হাই কোর্টের কী থাকল? সবই তো মন্ত্রণালয়ের। ১৮৬১ সালে কলকাতা হাই কোর্ট হয়েছে; তখন থেকে হাই কোর্টের বিচারকরা নিম্ন আদালত পরিদর্শন করেন। এ ব্যবস্থাই চলে আসছে। হাই কোর্ট কেন রাখবেন? হাই কোর্ট উঠিয়ে দিন।”

এর জের ধরে সোমবার সন্ধ্যায় বঙ্গবন্ধু আওয়ামী আইনজীবী পরিষদের এক অনুষ্ঠানে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক বলেন, সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদে অধঃস্তন সব আদালত ও ট্রাইব্যুনালের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণের ক্ষমতা হাই কোর্টের হাতে দেওয়া হয়েছে, আপিল বিভাগের হাতে নয়। সে অনুযায়ী শৃংখলাবিধির খসড়া তৈরি করে তিনি প্রধান বিচারপতিকে দিয়েছিলেন।     

“তারা (সুপ্রিম কোর্ট) সংশোধন করে যেটা দিয়েছিল, সেখানে দেখা গেছে… আমার কাছে ডকুমেন্ট আছে… ১১৬ অনুচ্ছেদে মহামান্য রাষ্ট্রপতির যে ক্ষমতা, সেটা তারা নিয়ে নিতে চায়। আমি কি করে সেটা দিই? আপনারা আমাকে রায় দিয়ে দেন, বলেন… আমি তো দিতে পারি না।”

অ্যাডভোকেট আনিসুল হক বলেন, “আমি সম্মান ও অধিকার রেখে মাননীয় প্রধান বিচারপতিকে বলতে চাই, আমিতো হাই কোর্ট সুপ্রিম কোর্ট ওঠানোর কথা বলি নাই। ডিসিপ্লিনারি রুলস দিয়ে হাই কোর্ট সুপ্রিম কোর্ট ওঠে না। এজলাসে বসে আপনার এগুলো বলারতো দরকার হয় না।”

২০১৫ সালে বিচার প্রশাসন ও প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউটে এক অনুষ্ঠানে প্রধান বিচারপতির সঙ্গে আলাপে আইনমন্ত্রী

আইনমন্ত্রীর ওই বক্তব্যের প্রতিক্রিয়ায় মঙ্গলবার আপিল বিভাগে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট দিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনার মামলার শুনানিতে কথা বলেন প্রধান বিচারপতি।

অ্যাটর্নি জেনারেলকে সামনে রেখে তিনি বলেন, “কিছু কিছু মন্ত্রী এজলাসে বসে কথা বলার বিষয়ে মন্তব্য করেন। এটা কি ফেয়ার? আপনাকে প্রশ্ন করছি।”

জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, “দুই দিক থেকে বক্তব্য আসে। বক্তব্য মিডিয়া লুফে নেয়।”

প্রধান বিচারপতি বলেন, “আপনি কেন এ কথা বলছেন? কোর্ট প্রসিডিংসে আমরা পলিটিক্যাল বক্তব্য দিই না। বিচার বিভাগ সংক্রান্ত বক্তব্য দেই। বিচার বিভাগে যখন যে ইস্যু চলে আসে… যেমন আজকে মোবাইল কোর্ট সম্পর্কে। না বললে কি থাকল? মাসদার হোসেন মামলা… আমরা পলিটিক্যাল কথা বলছি না।”

এ সময় বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহহাব মিঞা বলেন, “শৃঙ্খলা বিধির খসড়ায় গেজেট প্রকাশের বিষয়টি আমরা সুপ্রিম কোর্টের কথা অনুসারে বলেছিলাম। কিন্তু আপনারা সেখানে সরকারের কথা বলেছেন।”

এরপার প্রধান বিচারপতি বলেন, “পলিটিক্যাল কথা বলছি না। কিছু কিছু মিনিস্টার… মিস্টার অ্যাটর্নি জেনারেল, আপনারা জাজদের মধ্যে ডিভিশন সৃষ্টি করতে চাচ্ছেন। পত্রিকায় এসেছে… একজন বলেছেন যে কোর্ট প্রসিডিংসে আদালতের কার্যক্রমে যা হয় তা নিয়ে পার্লামেন্ট বা পাবলিকলি কথা বলার সুযোগ নেই।”

সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ ও ১১৬ অনুচ্ছেদের ‘ক’ ধারার ব্যাখ্যা দিয়ে মাসদার হোসেন মামলার রায় হয়েছিল জানিয়ে প্রধান বিচারপতি অ্যাটর্নি জেনারেলকে বলেন, “এখন যদি আপনার কাছ থেকে ব্যাখ্যা শুনতে হয়, তাহলে তা দুঃখজনক।”