রামপাল: ইউনেসকোর সিদ্ধান্তের সঙ্গে মিলছে না সরকারের দাবি

জাতিসংঘ সংস্থা ইউনেসকো সুন্দরবনের কাছে রামপালে তাপবিদ্যুৎ কেন্দ্র নিয়ে ‘আপত্তির জায়গা থেকে সরে এসেছে’ বলে সরকারের পক্ষ থেকে দাবি করা হলেও ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তের সঙ্গে তা মিলছে না।

নিউজ ডেস্কবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 31 July 2017, 05:31 AM
Updated : 31 July 2017, 11:37 AM

ইউনেসকো স্পষ্ট করে বলেছে, সুন্দরবন এলাকার কৌশলগত পরিবেশ মূল্যায়নের (এসইএ) আগে সেখানে যাতে বড় কোনো শিল্প বা অবকাঠামো নির্মাণ করা না হয় তা সরকারকে নিশ্চিত করতে হবে। এসইএ শেষ করে যত দ্রুত সম্ভব প্রতিবেদনের একটি অনুলিপি পর্যালোচনার জন্য হেরিটেজ সেন্টারে পাঠাতেও অনুরোধ করা হয়েছে বাংলাদেশ সরকারকে।

পোল্যান্ডের ক্রাকাও শহরে চলতি মাসের প্রথম সপ্তাহে ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির ৪১তম সভায় সুন্দরবন বিষয়ে শুনানির পর ওই সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। সভার সিদ্ধান্তের চূড়ান্ত প্রতিবেদন ইউনেসকোর ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয় রোববার।

সুন্দরবনের বিশ্ব ঐতিহ্যের অংশ থেকে ৬৭ কিলোমিটার দূরে বাগেরহাটের রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট উৎপাদন ক্ষমতার এই কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে পরিবেশের ওপর যে প্রভাব পড়বে, তা নিয়ে ইউনেসকোর উদ্বেগ এবারের প্রতিবেদনেও স্পষ্ট।  

হেরিটেজ কমিটির সভার সিদ্ধান্তে বলা হয়, রামপালে ওই বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে পানি ও বায়ু দূষণ বাড়বে। সেই সঙ্গে নৌচলাচল ও ড্রেজিংয়ের প্রয়োজনও বাড়বে; প্রচুর মিঠা পানি তোলার প্রয়োজন হবে। এর বিরূপ প্রভাব সামাল দিতে আধুনিক প্রযুক্তি ব্যবহার করতে হবে। সমীক্ষার মাধ্যমে এই প্রভাব নিরূপণ এবং সুন্দরবনের ক্ষতি কীভাবে প্রশমন করা যাবে সে বিষয়ে বিস্তারিত থাকতে হবে এসইএ প্রতিবেদনে। 

ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সেন্টার ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচারের (আইইউসিএন) রিঅ্যাকটিভ মনিটরিং মিশন ২০১৬ সালে সুন্দরবন এলাকা ঘুরে যাওয়ার পর তাদের প্রতিবেদনে যেসব সুপারিশ করেছিল, তার বাস্তবায়ন এবং এসইএসহ অন্যান্য সুপারিশ বাস্তবায়নের অগ্রগতি জানিয়ে ২০১৮ সালের ১ ডিসেম্বরের মধ্যে বাংলাদেশ সরকারকে প্রতিবেদন দিতে বলেছে হেরিটেজ কমিটি। ২০১৯ সালে হেরিটেজ কমিটির ৪৩তম অধিবেশনে এসব প্রতিবেদন পর্যালোচনা করা হবে।

প্রধানমন্ত্রীর জ্বালানি, বিদ্যুৎ ও খনিজ সম্পদ বিষয়ক উপদেষ্টা ড. তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের একটি উচ্চ পর্যায়ের প্রতিনিধি দল জুলাইয়ের শুরুতে হেরিটেজ কমিটির শুনানিতে অংশ নেন।

পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, দীর্ঘ আলোচনার পর হেরিটেজ কমিটি যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে সুন্দরবনের উপর ক্ষতিকর প্রভাব এড়িয়ে বাংলাদেশ সরকার পরিকল্পিত স্থান রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণকে ‘অনুমোদন করেছে’। পাশাপাশি হেরিটেজ কমিটির পরামর্শ অনুযায়ী দেশের সুন্দরবনসহ দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলে পরিবেশগত প্রভাব সমীক্ষা (ইআইএ) চালাতে রাজি হয়েছে।

ওই সভার সিদ্ধান্ত সম্পর্কে জানতে চাইলে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ সে সময় বলেছিলেন, “ওদের এজেন্ডায় যে নিষেধাজ্ঞাটা ছিল সেটা এখন আর নেই। আমরা কাজ করতে পারব। অফকোর্স দেয়ার আর সাম কনসার্ন; একটা এনভায়রনমেন্টাল এসেসমেন্ট রিপোর্ট দিতে হবে আমাদের। দ্যাটস অল।”

ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির সভা শেষে দেশে ফিরে ঢাকায় এক মিট দ্য প্রেস অনুষ্ঠানে ‘ইউনেসকোর সরে আসা’ প্রসঙ্গে বক্তব্যের ব্যাখ্যা দেন তৌফিক-ই-এলাহী চৌধুরী।

তিনি সেদিন বলেন, “ইউনেসকো আগে প্রকল্প বন্ধ করতে বলেছিল। সুন্দরবন এলাকায় রামপালসহ সব অবকাঠামো উন্নয়ন বন্ধ রাখতে বলেছিল। এখন রামপালের বিষয়ে সেই কথা তারা তুলে নিয়েছে।

“একদিকে বলেছিল রামপাল এলাকার স্ট্র্যাটেজিক এনভায়রনমেন্টাল অ্যাসেসমেন্ট (এসইএ) করতে, অন্যদিকে প্রকল্প অন্যত্র সরিয়ে নিতে। তাদের সেই বক্তব্য অসঙ্গতিপূর্ণ ছিল। কারণ সরিয়েই যদি নিতে হয় তাহলে তো অ্যাসেসমেন্টের প্রয়োজন থাকে না। সুন্দরবনকে ঝুঁকিপূর্ণ তালিকার অন্তর্ভুক্ত করতে যে প্রস্তাব এসেছিল সেটিও পাস হয়নি। এগুলোই হচ্ছে ইউনেসকোর অবস্থান থেকে সরে আসা।”

সরকারের ওই দাবি নিয়ে সে সময় সন্দেহ প্রকাশ করেছিলেন রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রবিরোধী আন্দোলনকারীদের একটি সংগঠন তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।

ইউনেসকোর পূর্ণাঙ্গ সিদ্ধান্ত প্রকাশিত হওয়ার পর সোমবার তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকার একটি মিথ্যা তথ্যের ওপর ভিত্তি করে সংবাদ সম্মেলন করে, তড়িঘড়ি কিছু বক্তব্য দিয়েছে, যেটা ইউনেসকোর পর্যালোচনা প্রতিবেদনের সঙ্গে মিলছে না। এখানে রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের বিষয়টি উল্লেখ না করলেও সুন্দরবন এলাকায় বড় ধরনের যে কোনো অবকাঠামো নির্মাণ কিংবা সরকারের পৃষ্ঠোপোষকতায় যেসব শিল্প কলকারখানা করার পরিকল্পনা চলছে; সেখান থেকে সরে আসতে বলা হয়েছে।”

তিনি বলেন, “আমরা আগে থেকেই বলে আসছি, অসততা ও একগুয়েমি করে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র করতে চাইছে সরকার। আমরা এখন চাইব, ইউনেস্কোর এই প্রতিবেদন প্রকাশের পর সরকার রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্র থেকে সরে আসবে এবং যেসব অবকাঠামো নির্মাণের পরিকল্পনা হচ্ছিল, সেখান থেক সরে এসে সুন্দরবনকে রক্ষার নীতিমালা প্রণয়ন করবে।”

কয়লাভিত্তিক ওই বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে সুন্দরবনের পরিবেশ ও প্রতিবেশ মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে দাবি করে পরিবেশবাদীদের একটি অংশ শুরু থেকেই রামপাল প্রকল্পের বিরোধিতা করে আসছে। অন্যদিকে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হচ্ছে, সুন্দরবনের যাতে ক্ষতি না হয়, তার সব ব্যবস্থাই নেওয়া হচ্ছে।

পাল্টাপাল্টি এই অবস্থানের মধ্যে ২০১৬ সালের মার্চে ইউনেসকোর একটি প্রতিনিধি দল প্রকল্প এলাকা সরেজমিন পরিদর্শন করেন। পরে যে প্রতিবেদন তারা জমা দেন, তাতে রামপালকে সুন্দরবনের জন্য ‘মারাত্মক হুমকি’ হিসেবে বর্ণনা করে প্রকল্পটি অন্য স্থানে সরিয়ে নিতে বলা হয়। তা না হলে সুন্দরবনের বিশ্ব ঐতিহ্যের মর্যাদা বাতিল করে একে ঝুঁকিপূর্ণ তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশ করা হয়।

চলতি মাসের শুরুতে ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির ৪১তম সভায় আলোচনার পর বিশ্ব ঐতিহ্য (ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ) সুন্দরবনকে ঝুঁকিপূর্ণ প্রাকৃতিক নিদর্শনগুলোর তালিকায় যুক্ত করার প্রস্তাব বাদ দেওয়া হয়।

ইউনেসকোর বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকায় কোন কোন প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক নিদর্শন থাকবে, কোনটি বাদ যাবে এবং কোন নিদর্শন ঝুঁকিতে রয়েছে- সেসব বিষয়ে ২১ সদস্যের এই হেরিটেজ কমিটিই সিদ্ধান্ত নেয়।

রামপাল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের প্রস্তাবিত নকশা

রামপাল প্রকল্পের দ্বিতীয় পর্যায়ে ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার আরেকটি বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের পরিকল্পনা সরকারের থাকলেও ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সেন্টার ও আইইউসিএন রিঅ্যাকটিভ মনিটরিং মিশনের ওই প্রতিবেদন আসার পর সরকার দ্বিতীয় পর্যায় বাস্তবায়নের সিদ্ধান্ত থেকে সরে আসে। সেই সঙ্গে ওই এলাকায় অরিয়ন গ্রুপের একটি বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণের প্রস্তাব অনুমোদন না করার কথাও ইউনেসকোকে জানানো হয়।

ইউনেসকোর সভার সিদ্ধান্তে বাংলাদেশ সরকাররের এসব পদক্ষেপ এবং বাংলাদেশ ন্যাশনাল অয়েল স্পিল অ্যান্ড কেমিকেল কনটিনজেন্সি প্ল্যানের খসড়া প্রণয়ন ও কৌশলগত পরিবেশ মূল্যায়নের (এসইএ) সিদ্ধান্তকে স্বাগত জানানো হয়।

সেই সঙ্গে ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সেন্টার ও ইন্টারন্যাশনাল ইউনিয়ন ফর কনজারভেশন অফ নেচারের (আইইউসিএন) রিঅ্যাকটিভ মনিটরিং মিশনের ২০১৬ সালের সব সুপারিশ পুরোপুরি বাস্তবায়ন করতে বলা হয়। ওই প্রতিবেদনেই রামপাল প্রকল্প বাতিল করতে বলেছিল ইউনেসকো। 

রামপালে ১৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার ওই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণে ঠিকাদার প্রতিষ্ঠান ভারত হেভি ইলেক্ট্রিক্যালকে গত এপ্রিলে কাজ শুরুর অনুমতি দিয়েছে বাংলাদেশ-ভারত মৈত্রী বিদ্যুৎ কোম্পানি।

দুই ইউনিটের কেন্দ্রটির প্রথম ইউনিটের নির্মাণকাজ ৪১ মাস এবং দ্বিতীয় ইউনিটের নির্মাণকাজ ৪৭ মাসের মধ্যে শেষ করার সময় বেঁধে দেওয়া হয়েছে।