যুদ্ধপরাধ: ওসমান ফারুকের বিরুদ্ধে তদন্ত, মুসা বিন শমসেরের বিষয়ে অনুসন্ধান

বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা ও সাবেক মন্ত্রী ওসমান ফারুকের বিরুদ্ধে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে ট্রাইব্যুনালে মামলা হওয়ার কথা জানিয়ে প্রসিকিউশনের তদন্ত সংস্থা বলেছে, ওই মামলার ১১ আসামির বিরুদ্ধে তাদের তদন্ত চলছে।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 27 July 2017, 09:45 AM
Updated : 27 July 2017, 09:50 AM

আর বিতর্কিত ব্যবসায়ী মুসা বিন শমসেরের বিরুদ্ধে একাত্তরের যুদ্ধাপরাধের অভিযোগ এখনও অনুসন্ধান পর্যায়ে রয়েছে বলে জানিয়েছেন তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক সানাউল হক।

নড়াইল ও শেরপুরের যুদ্ধাপরাধের দুটি মামলার তদন্ত প্রতিবেদন চূড়ান্ত করার কথা জানাতে বৃহস্পতিবার তদন্ত সংস্থার ধানমণ্ডির কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এসে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে ওসমান ফারুক ও মুসা বিন শমসেরের বিষয়ে এ তথ্য দেন সমন্বয়ক।   

তিনি বলেন, নড়াইলে ছয়জন ও শেরপুরের নকলার চার জনের বিরুদ্ধে তৈরি করা তদন্ত প্রতিবেদন শিগগিরই প্রসিকিউশনে জমা দেওয়া হবে।

সংবাদ সম্মেলনে এক প্রশ্নের জবাবে সানাউল হক বলেন, বিএনপি নেতা ও সাবেক শিক্ষামন্ত্রী ওসমান ফারুকের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অভিযোগে তদন্ত চলছে। আর ‘কথিত ধনকুবের’ মুসা বিন শমসেরের বিরুদ্ধে অনুসন্ধান চলছে।

“ওসমান ফারুকের বিরুদ্ধে নিয়মত মামলা আছে, তদন্ত হচ্ছে। আর মুসা বিন শমসেরের বিষয়ে অনুসন্ধান চলছে। কোনো অগ্রগতি পাওয়া গেলে জানানো হবে।”

ওসমান ফারুক

১৯৭১ সালে ময়মনসিংহ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মানবতাবিরোধী অপরাধের সঙ্গে যুক্ত থাকার অভিযোগে গতবছর প্রাথমিক তদন্ত শুরু করে প্রসিকিউশনের তদন্ত সংস্থা। ওই ১১ জনের অধিকাংশই মুক্তিযুদ্ধের সময় বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বা কর্মকর্তা ছিলেন।

ওসমান ফারুক তখন ওই বিশ্ববিদ্যালয়ের এগ্রিকালচার ইকোনমি বিভাগের রিডার ছিলেন। ১১ জনের তালিকায় তার নামও রয়েছে বলে গতবছর ৫ এপ্রিল এক সংবাদ সম্মেলনে জানান তদন্ত সংস্থার সমন্বয়ক সানাউল হক।

কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠাকালীন উপাচার্য ওসমান গণির ছেলে ওসমান ফারুক ২০০১-২০০৬ মেয়াদে বিএনপি-জামায়াত জোট সরকারের শিক্ষামন্ত্রী ছিলেন।

ওসমান ফারুক বা বাকি দশ আসামির বিরুদ্ধে কী কী অভিযোগ এসেছে, সে বিষয়ে বিস্তারিত তথ্য প্রকাশ করেনি প্রসিকিউশনের তদন্ত সংস্থা। এ বিষয়ে ওসমান ফারুকের বক্তব্যও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম জানতে পারেনি। 

গতবছর অক্টোবরে ময়মনসিংহ-৭ আসনে জাতীয় পার্টির সাংসদ এম এ হান্নানকে যুদ্ধাপরাধের অভিযোগে গ্রেপ্তারের সময় যেসব অপরাধের কথা বলা হয়েছিল, তাতে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে পাকিস্তানি বাহিনীর ‘টর্চার সেলের’ কথাও আসে।

বিভিন্ন সময়ে গণমাধ্যমে প্রকাশিত তথ্য অনুযায়ী, একাত্তর সালের ২৩ এপ্রিল পাকিস্তানি বাহিনী বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করে সেখানে ক্যাম্প খোলে। বিশ্ববিদ্যালয়ের অতিথিশালায় বানানো হয় আঞ্চলিক কমান্ড হেড কোয়ার্টার। আর ব্রহ্মপুত্র নদের তীর সংলগ্ন একটি বাড়িতে চালু হয় সেই নির্যাতন কেন্দ্র।

ময়মনসিংহের বিভিন্ন এলাকা থেকে রাজাকার বাহিনীর সহযোগিতায় ধরে আনা অসংখ্য নারী-পুরুষকে সেখানে হত্যার পর পাশেই নদের তীরে মাটিচাপা দেওয়া হয় সে সময়। বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পর  বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ওই স্থানটিকে ‘বধ্যভূমি’ ঘোষণা করে।

মুসা বিন শমসের

২০১০ সালে যুদ্ধাপরাধের বিচার শুরুর পর বিভিন্ন পর্যায় থেকে মুসা বিন শমসেরের বিচারের দাবি ওঠে। এর পরিপ্রেক্ষিতে তদন্তের কথা বলা হলেও তাতে কোনো অগ্রগতির খবর দিতে পারেনি তদন্ত সংস্থা।

জাঁকজমকপূর্ণ চলাফেরার জন্য বিদেশি সংবাদ মাধ্যমে ‘বাংলাদেশের প্রিন্স’ হিসেবে পরিচয় পাওয়া মুসা বিন শমসের ফরিদপুরে তার নিজের এলাকায় পরিচিত ‘নুলা মুসা’ নামে।

অভিযোগ আছে, একাত্তরের ২১ এপ্রিল পাকিস্তানি সৈন্যদের ফরিদপুরে ঢোকার ক্ষেত্রে মানচিত্র ও পথ নির্দেশনা দিয়ে নেপথ্যে সহযোগিতা করেন মুসা বিন শমসের। সাংবাদিক-কলামনিস্ট আবু সাঈদের লেখা বইয়েও মুসার একাত্তরের ভূমিকার কথা এসেছে।

ট্রাইব্যুনালে আবুল কালাম আযাদ ওরফে বাচ্চু রাজাকারের যুদ্ধাপরাধ মামলায় সাক্ষ্য দেওয়া ফরিদপুরের মুক্তিযোদ্ধা আবু ইউসুফ পাখীর ভাষ্য, ফরিদপুরে পাকিস্তানি সৈন্যরা ঢোকার পরদিন অর্থাৎ একাত্তরের ২২ এপ্রিল ফরিদপুর সার্কিট হাউসে পাকিস্তানি মেজর আকরাম কোরায়েশী ও মুসাকে অন্তরঙ্গ পরিবেশে দেখেছিলেন তিনি।

ট্রাইব্যুনালের আরেক সাক্ষী মুক্তিযোদ্ধা বাবুনাথ একাত্তরে হত্যা-ধর্ষণের কয়েকটি ঘটনায় মুসার সংশ্লিষ্টতার তথ্যও জানিয়েছিলেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে।

তবে বিতর্কিত এই ব্যবসায়ীর দাবি, তিনি একাত্তরের ২২ এপ্রিল থেকে ৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত পাকিস্তানি বাহিনীর হাতে বন্দি ছিলেন।

জিয়াউর রহমানের আমলে জনশক্তি রপ্তানির ব্যবসা শুরু করা মুসার ব্যবসা প্রতিষ্ঠানের নাম প্রথমে ছিল শাহবাজ ইন্টারন্যাশনাল, পরে নাম হয় ড্যাটকো। তিনি বঙ্গবন্ধুর ভাগ্নে ও আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য শেখ ফজলুল করিমের বেয়াই।

এ কারণে মুসা অভিযোগ থেকে পার পেয়ে যাচ্ছেন কি না- সেই প্রশ্ন ওঠার পর ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা তার যুদ্ধাপরাধের বিষয়ে তথ্য-প্রমাণ থাকলে তা দিতে সাংবাদিকদের অনুরোধ করে।

ওই আহ্বানে সাড়া দিয়ে সাংবাদিক সাগর লোহানী ও প্রবীর সিকদার গত ৬ এপ্রিল তদন্ত সংস্থার কার্যালয়ে গিয়ে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম, জনকণ্ঠ ও ঢাকা ট্রিবিউনের প্রতিবেদনসহ ২৮ পৃষ্ঠার নথি হস্তান্তর করেন।

তদন্ত সংস্থার প্রধান সমন্বয়ক আব্দুল হান্নান খান সেদিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেছিলেন, “উনারা যেসব ডকুমেন্টস দিয়েছেন, আমরা যাচাই-বাছাই করে দেখব। সত্যতা থাকলে আমরা অবশ্যই তদন্তে যাব।”