মঙ্গলবার জাতীয় প্রেস ক্লাবে ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের (ডিইউজে) আয়োজনে এই স্মরণ সভায় বেবী মওদুদের কর্মময় জীবনের উপর আলোচনা করেন তারা। তবে সবচেয়ে বেশি উঠে আসে তার সাদাসিধে জীবন-যাপনের কথাই।
প্রধানমন্ত্রীর তথ্য বিষয়ক উপদেষ্টা ও বিএফইউজের সাবেক সভাপতি ইকবাল সোবহান চৌধুরী বলেন, “প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তার সতীর্থ ছিলেন, সহপাঠী ছিলেন। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে পরিচয় আছে এমন দাবি নিয়ে অনেকে অনেক সুযোগ-সুবিধা পেয়ে থাকেন বা পেয়েছেন। কিন্তু বেবী মওদুদ কখনও সম্পর্কের অপব্যবহার করেননি।”
বেবী মওদুদ আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্যও হয়েছিলেন। তবে সাংবাদিক ও লেখক হিসেবে পরিচয় দিতে স্বচ্ছন্দ বোদ করতেন তিনি। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের সোস্যাল অ্যাফেয়ার্স এডিটর ছিলেন তিনি।
ইকবাল সোবহান বলেন, “বেবী মওদুদের জন্ম হয়েছিল বিচারপতির ঘরে। কিন্তু তার সারাজীবনের যাত্রা দেখলে দেখা যাবে, বহু সংগ্রাম, আন্দোলন, পারিবারিক জীবনের অনেক দুঃখ-বেদনা, সেগুলো মেনে নিয়েই তিনি নীতি-আদর্শের প্রতি অবিচল থেকেছেন।
“খুব অল্প বয়সে স্বামী হারানোর পর দুই সন্তানকে নিজে তিনি যে সংগ্রাম শুরু করেছিলেন, জীবনের শেষ সময়েও তার সাদাসিধে বেশভূষা দেখে যে কেউ বলতে পারবেন তার জীবন কেমন ছিল। অনেক দুঃখ-কষ্ট থাকলেও মুখে কাউকে কিছু বলেননি, কোনো সুযোগ কারও কাছ থেকে নেননি। এটি ছিল তার আরেকটি গুণ। সারা জীবন সংগ্রামের পর ক্যান্সারের সঙ্গে সংগ্রাম করে মৃত্যুবরণ করতে হয়েছে তাকে।”
বঙ্গবন্ধুর ‘অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ সম্পাদনার কাজে বেবী মওদুদের অবদানও স্মরণ করেন ইকবাল সোবহান। যুদ্ধাপরাধীদের বিচার দাবিতে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম নেতৃত্বাধীন আন্দোলনে তার সক্রিয়তার কথাও বলেন তিনি।
বেবী মওদুদের স্মরণে এক মিনিট নীরবতা পালনের মধ্য দিয়ে শুরু হয় সভা। বৈরী পরিবেশে হলেও স্মরণসভায় সাংবাদিকদের উপস্থিতি কম দেখে ক্ষোভও প্রকাশ করেন কেউ কেউ।
ইকবাল সোবহান বলেন, “যারা আমাদের ছেড়ে চলে গেছেন তাদের সম্মান জানাতে না পারলে নিজেরাই নিজেদের কাছে ছোট হয়ে যাব। এই স্মরণ সভায় সবাই মিলে যদি উপস্থিত থাকতে পারতাম তাহলে বেবী মওদুদের প্রতি যেমন শ্রদ্ধা জানাতে পারতাম, তেমনি নিজেরাও ধন্য হতে পারতাম।”
বিএফইউজের মহাসচিব ওমর ফারুক বলেন, “বেবী আপা বেঁচে থাকতে উনি যখন প্রেস ক্লাবে ঢুকতেন, তার পেছনে যতজন জাতীয় প্রেস ক্লাবে আসতেন, আজকে সেই লোকগুলো আসেননি। তার থেকে যারা বিভিন্ন সুযোগ-সুবিধা নিয়েছেন, আজকে তারা তাকে ভুলে গিয়েছেন। আজকের স্মরণসভা তাই আমাদের সবার জন্য একটা পরীক্ষা।”
বাসসে বেবী মওদুদের এক সময়ের সহকর্মী ওমর ফারুক বলেন, “এক সময় ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি পদে আপা নির্বাচন করেছিলেন। আমি সাংগঠনিক সম্পাদক পদে নির্বাচন করেছিলাম। আপা নির্বাচনে পরাজিত হবার পরেও দেখলাম অফিসে সবাইকে মিষ্টি খাওয়াচ্ছেন। আমি অবাক হয়ে তার কাছে গেলে তিনি বললেন, ‘আমি পরাজিত হয়েছি তাতে কী, তুমি তো জয়ী হয়েছ’।
“বিশেষ দিনে ভালো কিছু রান্না করলে অফিসে খাবার এনে আমাদের খাওয়াতেন। মন ভালো থাকলে অনেক কথা বলতেন।”
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সভাপতি শাবান মাহমুদ বলেন, “প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠ বান্ধবী হওয়ার পরও কোন সুযোগ-সুবিধা কোনোদিন নেননি তিনি। তিনি ভেবেছিলেন স্বাধীন সাংবাদিকতার কথা, প্রগতির কথা, গণতন্ত্রের কথা, সাংবাদিক সমাজের উন্নয়নের কথা।”
বেবী মওদুদকে ঘিরে যারা প্রেস ক্লাবে ভিড় জমাতেন, স্মরণসভায় তাদের অনুপস্থিতির দিকে ইঙ্গিত করে শাবান মাহমুদ বলেন, “তাদের জন্য দয়া ও করুণা ছাড়া কিছু নেই। আমাদের কিছু হলেও তারা আসবেন না।”
সাংবাদিক নাসিমুন আরা হক মিনু প্রয়াত বেবী মওদুদের ছাত্র আন্দোলনের সম্পৃক্ততার কথা তুলে ধরে বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পড়ার সময় মিনু-বেবী-রাকা এই তিন বান্ধবীর নাম এক সঙ্গে উচ্চারিত হতো। সবাই আমাদের চিনত। আমরা ছাত্র ইউনিয়নে যুক্ত ছিলাম। বিশ্ববিদ্যালয় জীবনের শুরু থেকেই আমাদের বন্ধুত্ব হয়, পরে সু-সম্পর্ক গড়ে ওঠে।
“বেবী শুধু সাংবাদিকই নয়, নারী আন্দোলনেরও একজন সক্রিয় কর্মী ছিল। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ও অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার আন্দোলনের প্রথম সারির নেত্রী ছিল। অকালে চলে গেলেও তার জীবনটা ছিল সার্থক।”
বেবী মওদুদের সঙ্গে ষাটের দশকে এক সঙ্গে ছাত্র ইউনিয়নে সম্পৃক্ত থাকার কথা তুলে ধরে জাতীয় প্রেস ক্লাবের কোষাধ্যক্ষ কার্তিক চ্যাটার্জী বলেন, “বেবী আপা মানুষকে খুব সহজে আপন করে নিতে পারতেন।”
ঢাকা সাংবাদিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক সোহেল হায়দার চৌধুরীর সঞ্চালনায় সভায় উপস্থিত ছিলেন বিএফইউজের সাবেক মহাসচিব আবদুল জলিল ভূঁইয়া, জাতীয় প্রেস ক্লাবের নির্বাহী কমিটির জ্যেষ্ঠ সহসভাপতি আজিজুল ইসলাম ভূঁইয়া, সাধারণ সম্পাদক ফরিদা ইয়াসমিন, নির্বাহী কমিটির সদস্য শাহনাজ বেগম, বিএফইউজের নির্বাহী সদস্য মফিদা আকবর, ডিইউজের নির্বাহী সদস্য মাহমুদুর রহমান খোকন, মর্তুজা হায়দার লিটন, সাবেক কোষাধ্যক্ষ খায়রুজ্জামান কামাল, বাসসের সাবেক বিশেষ প্রতিনিধি সুভাষ চন্দ বাদল প্রমুখ।
রাতে বেবী মওদুদের ধানমন্ডি ১০/এ সড়কের ৪৫ নম্বর বাসায় পরিবারের উদ্যোগে মিলাদ ও দোয়া অনুষ্ঠান হয়।