দুর্নীতির বিরুদ্ধে ডিসিদের কঠোর হতে বললেন প্রধানমন্ত্রী

দুর্নীতির বিরুদ্ধে কঠোর অবস্থান নিয়ে জনসচেতনতা সৃষ্টি করতে জেলা প্রশাসকদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 July 2017, 07:47 AM
Updated : 25 July 2017, 11:29 AM

মঙ্গলবার নিজ কার্যালয়ে তিন দিনের জেলা প্রশাসক সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এ আহ্বান জানান তিনি।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, “করাপশন দূর করতে হবে আমাদের। কারণ কোনো কাজ করতে গেলে সেখানে যদি করাপশন হয়, আর সেটুকুই যদি খেয়ে ফেলে তাহলে আমার উন্নয়নের ছোঁয়াটা গ্রাম-বাংলায় বা কোথাও লাগবে না।

“কাজেই এ ব্যাপারে আপনাদেরকে জনসচেতনতাও সৃষ্টি করতে হবে এবং নিজেদেরকে এ ব্যাপারে কঠোর অবস্থানে থাকতে হবে,” জেলা প্রশাসকদের উদ্দেশ্যে বলেন তিনি।

শেখ হাসিনা বলেন, দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য, মানুষের ভাগ্য গড়ার জন্য কাজ করবে- এটাই যেন সবার লক্ষ্য হয়।

দুর্নীতির বিরুদ্ধে বঙ্গবন্ধুকে উদ্ধৃত করে তিনি বলেন, “করাপশন আমার বাংলার কৃষক করে না। করাপশন আমার বাংলার মজদুর করে না। করাপশন করি আমরা শিক্ষিত সমাজ; যারা তাদের টাকা দিয়ে লেখাপড়া শিখেছে।”

প্রধানমন্ত্রী জানান, দেশকে ডিজিটালাইজড করতে তার সরকার যেসব পদক্ষেপ নিয়েছে তার ফলে দুর্নীতিও নিয়ন্ত্রণ হচ্ছে। এখন আর ওই টেন্ডারের বাক্স ছিনতাইয়ের ঘটনা খুব বেশি শোনা যাচ্ছে না।

“ডিজিটালাইজ করার ক্ষেত্রে কয়েকটা মন্ত্রণালয় এখনো একটু পিছিয়ে আছে। কিন্তু প্রতিটা ক্ষেত্রে আমরা ডিজিটালাইজড করে দেওয়ার ফলে এখন অনেকটা স্বচ্ছতা চলে এসেছে। কাজেই এটা আমাদের অব্যাহত রাখতে হবে।”

সরকারি কাজের জবাবদিহিতা ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা  এবং নতুন নতুন উপায় উদ্ভাবন করে সরকারি সেবা প্রদান সহজ করতে তার দপ্তরের অধীনে ‘গভর্নেন্স ইনোভেশন ইউনিট’ চালু করা হয়েছে বলেও জানান প্রধানমন্ত্রী।

শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকারের মূল্ লক্ষ্য তৃণমুল পর্যায় থেকে উন্নয়ন করা। দেশের একটা মানুষও গৃহহীন থাকবে না। দেশের মানুষের মৌলিক অধিকার পূরণে সরকার কাজ করে যাচ্ছে।

সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপ বাস্তবায়নে মাঠ পর্যায়ের সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদের ধন্যবাদ জানিয়ে দেশের মানুষের ভাগ্য পরিবর্তনে লক্ষ্য নিয়ে কাজ করার আহ্বান জানান তিনি।

২৩ দফা নির্দেশনা

প্রধানমন্ত্রী জেলা প্রশাসকদের সামনে ২৩ দফা নির্দেশনা তুলে ধরেন:

সরকারি সেবা গ্রহণে সাধারণ মানুষ যাতে কোনভাবেই হয়রানি বা বঞ্চনার শিকার না হন, সেদিকে লক্ষ্য রাখতে হবে।

তৃণমূল পর্যায়ে সুশাসন প্রতিষ্ঠায় জনপ্রতিনিধিদের সঙ্গে একাত্ম হয়ে কাজ করতে হবে।

গ্রামীণ অর্থনীতিকে আরও শক্তিশালী করে নতুন নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। মানুষ যেন শহরমুখী না হয়; শহরের উপর জনসংখ্যার চাপ যাতে না বাড়ে সে ব্যবস্থা করতে হবে।

গ্রামীণ অবকাঠামো উন্নয়ন, সম্ভাবনাময় স্থানীয় ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের বিকাশ এবং কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দারিদ্র্য বিমোচনে ব্রতী হতে হবে।

ধনী-দরিদ্র্যের বৈষম্য কমাতে উন্নয়ন কর্মসূচি এমনভাবে গ্রহণ করতে হবে যাতে সর্বোচ্চ সংখ্যক মানুষ উপকৃত হয়। বৈষম্যহীন সমাজ বিনির্মাণে সম্পদের সুষম বণ্টন নিশ্চিত করতে হবে।

জঙ্গিবাদ, সন্ত্রাস ও সাম্প্রদায়িকতা দূর করে সমাজ জীবনের সর্বক্ষেত্রে শান্তি-শৃঙ্খলা ও স্থিতিশীলতা বজায় রাখার ক্ষেত্রে আরও সতর্কতার সঙ্গে এবং কঠোরভাবে দায়িত্ব পালন করতে হবে।

জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস নির্মূলে স্থানীয় জনপ্রতিনিধি, স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসার শিক্ষক, মসজিদের ইমাম, গ্রামের মুরুব্বি, নেতৃস্থানীয় ব্যবসায়ী, নারী সংগঠক, আনসার-ভিডিপি, গ্রাম পুলিশ, এনজিও কর্মীসহ সমাজের সবাইকে সম্পৃক্ত করতে হবে।

প্রতিবন্ধী, অটিস্টিক ও পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠীর কল্যাণে বিশেষ পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে।

সাধারণ মানুষকে সহজে সুবিচার প্রদান ও আদালতে মামলার জট কমাতে গ্রাম আদালতগুলোকে কার্যকর করতে হবে।

জনগণের দোরগোড়ায় সেবা পৌঁছাতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির উন্নয়ন ও বিকাশে নেতৃত্ব প্রদান করতে হবে।

শিক্ষার সর্বস্তরে নারী শিক্ষার হার বৃদ্ধি এবং ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের মূলধারায় ফিরিয়ে আনার পদক্ষেপ নিতে হবে।

ভূমি প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি এবং সরকারি ভূমি রক্ষায় আরও সচেষ্ট হতে হবে।

কৃষি-উৎপাদন বৃদ্ধিতে সার, বীজ, বিদ্যুৎ, জ্বালানি ইত্যাদির সরবরাহ নির্বিঘ্ন করতে প্রয়োজনীয় সব ব্যবস্থা নিতে হবে। পরিবেশবান্ধব কৃষি ব্যবস্থাপনাকে জনপ্রিয় করতে উদ্যোগী হতে হবে।

ভেজাল খাদ্যদ্রব্য বাজারজাতকরণ প্রতিরোধে ব্যাপক গণসচেতনতা সৃষ্টি করে এসব অনৈতিক কর্মকাণ্ড কঠোর হস্তে দমন করতে হবে।

সপ্তম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনা ও এসডিজির সফল বাস্তবায়নে মেধা, দক্ষতা ও অভিজ্ঞতার যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

প্রাকৃতিক দুর্যোগ ও বিপর্যয় প্রশমনে সঠিক সময়ে সঠিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। পরিবেশ রক্ষার জন্য জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং এই সংক্রান্ত আইন ও বিধি বিধানের যথাযথ প্রয়োগ নিশ্চিত করতে হবে।

শিল্পাঞ্চলে শান্তি রক্ষা, পণ্য পরিবহন ও আমদানি-রপ্তানি নির্বিঘ্ন করা এবং পেশিশক্তি, চাঁদাবাজি, টেন্ডারবাজি ও সন্ত্রাস নিমূর্ল করতে ব্যবস্থা নিতে হবে।

ভোক্তা অধিকারকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিতে হবে এবং বাজারে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টির যে কোনো অপচেষ্টা কঠোর হস্তে দমন করতে হবে।

নারী উন্নয়ন নীতি সুষ্ঠু বাস্তবায়ন করতে হবে। নারীর প্রতি সহিংসতা, নিপীড়ন ও বৈষম্যমূলক আচরণ বন্ধ এবং নারী ও শিশু পাচার রোধে যথাযথ আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

শিশু-কিশোরদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের লক্ষ্যে শিক্ষা, ক্রীড়া, বিনোদন ও সৃজনশীল সাংস্কৃতিক কর্মকাণ্ডের সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। শিশু-কিশোরদের মধ্যে ইতিহাস চেতনা, জ্ঞানস্পৃহা ও বিজ্ঞানমনস্কতা জাগিয়ে তুলতে হবে।

কঠোরভাবে মাদক ব্যবসা, মাদক চোরাচালান এবং এর অপব্যবহার বন্ধ করতে হবে।

ভূমি প্রশাসন ও ব্যবস্থাপনায় স্বচ্ছতা ও দক্ষতা বৃদ্ধি করে সরকারি ভূমি রক্ষায় সজাগ থাকবে হবে।

পার্বত্য জেলাসমূহের উন্নয়ন ত্বরান্বিতকরণের পাশাপাশি এ অঞ্চলের ভূ-প্রাকৃতিক সৌন্দর্য ও জীব বৈচিত্র্য সংরক্ষণ করতে হবে। পর্যটন শিল্প, ক্ষুদ্র ও মাঝারি ও ঐতিহ্যবাহী কুটির শিল্পের বিকাশে সর্বাত্মক সহযোগিতা করতে হবে।

এছাড়াও নিজ নিজ জেলার সমস্যা ও সম্ভাবনা চিহ্নিত করে সে বিষয়ে পদক্ষেপ নিতে জেলা প্রশাসকদের আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী। একইসঙ্গে উদ্ভাবনী কর্মসূচি প্রণয়ন করতেও মাঠ প্রশাসনের কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন তিনি।

ডিসিদের জেলা পর্যায়ে বিভিন্ন কমিটি প্রধানের দায়িত্ব পালন করার কথা উল্লেখ করে মানুষের সেবা সহজ করতে এসব কমিটি যাতে আরও ‘সক্রিয়, গতিশীল ও ফলপ্রসূভাবে’ করে সেদিকে বিশেষ দৃষ্টি দেওয়ারও আহ্বান জানান প্রধানমন্ত্রী।

জনপ্রশাসনমন্ত্রী সৈয়দ আশরাফুল ইসলাম, প্রতিমন্ত্রী ইসমাত আরা সাদেক, প্রধানমন্ত্রী মূখ্য সচিব কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী ও মন্ত্রিপরিষদ সচিব শফিউল আলম অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন।