নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে জোর দিয়ে জাতীয় কমিটির বিকল্প প্রস্তাব

নবায়নযোগ্য জ্বালানির উপর জোর দিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদন খাতকে ঢেলে সাজানোর প্রস্তাব দিয়ে সরকারের মহাপরিকল্পনার বিকল্প উপস্থান করেছে তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটি।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 July 2017, 04:22 PM
Updated : 22 July 2017, 04:22 PM

শনিবার জাতীয় প্রেসক্লাবে এক উন্মুক্ত আলোচনা সভায় বিকল্প মহাপরিকল্পনার সারসংক্ষেপ উপস্থাপন করেন কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।

সারসংক্ষেপে বলা হয়, সরকারের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ মহাপরিকল্পনা (২০১৭-৪১) অনুযায়ী বিদ্যুৎ খাতের প্রতিটি প্রকল্পই হবে বিদেশি কোম্পানিভিত্তিক, আমদানি ও ঋণ নির্ভর।

সারা বিশ্বে নবায়নযোগ্য জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুৎ উৎপাদনে বৃদ্ধি ও খরচ কম হলেও ‘উদ্দেশ্যমূলকভাবে এই ব্যয়ের চিত্রটি অস্বাভাবিক হারে বাড়িয়ে দেখিয়ে’ পরিবেশ বিধ্বংসী উচ্চব্যয়ের বিদ্যুৎ উৎপাদনকে অগ্রাধিকার দেওয়া হয়েছে।

বিভিন্ন জ্বালানির তুলনামূলক খরচ তুলে ধরে জাতীয় কমিটি বলছে, নবায়নযোগ্য উৎস থেকে পুঁজি বিনিয়োগ, বিদ্যুৎ উৎপাদন খরচ ও একক চলতি খরচ গত ১০ বছরে শতকরা ৫০ শতাংশের বেশি কমেছে ।

জাতিসংঘের উদ্যোগে আন্তর্জাতিক একটি সংস্থার গবেষণার বরাত দিয়ে বলা হয়, ২০১০ থেকে ৫ বছরে প্রতি ইউনিট সৌরবিদ্যুতের দাম কমেছে ৫৮শতাংশ, যা ২০২৫ সাল পর্যন্ত কমে ৫৯ শতাংশে নেমে আসবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে।

২০৪০ সাল নাগাদ সৌরবিদ্যুতের দাম প্রতি ইউনিট কমবে ৫০ শতাংশ, বায়ুবিদ্যুৎ ৩০ শতাংশ ও ব্যাটারির দাম কমবে ৪৫ শতাংশ পর্যন্ত কমতে পারে, যেখানে জীবাশ্ম জ্বালানিভিত্তিক বিদ্যুতের দাম বাড়বে ৪৫ শতাংশ। কিন্তু সরকার কম দামের চেয়ে বেশি দামের পথে যাচ্ছে।

প্রস্তাবে বলা হয়, ২০৪১ সাল পর্যন্ত বিদ্যুৎ উৎপাদনের লক্ষ্য করে সরকার ১২৯ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগের যে পরিকল্পনা নিয়েছে, তার বিপরীতে ১১০ বিলিয়ন ডলার বিনিয়োগ করে তার চেয়ে অনেক বেশি বিদ্যুৎ উৎপাদন করা সম্ভব।

বিদ্যুতের দামও সরকারের (২০১৫-এর দামস্তর অনুযায়ী) ১২ টাকা ৭৯ পয়সার বিপরীতে ৫ টাকা ১০ পয়সায় নামিয়ে আনা সম্ভব।

তেল-গ্যাস কমিটির প্রস্তাবে বলা হয়, যথাযথ নীতিগ্রহণ করলে ২০৪১ সাল পর্যন্ত দেশের গ্যাস চাহিদা নিজেদের গ্যাস থেকেই মেটানো সম্ভব। তার জন্য গ্যাস নিয়ে রপ্তানিমুখি চুক্তি বাতিল করে বাপেক্সকে কাজের সুযোগ দিয়ে জাতীয় সক্ষমতা বৃদ্ধির জন্য প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক উন্নয়ন ঘটাতে হবে এবং স্থলভাগ এবং গভীর ও অগভীর সমুদ্রে নিয়মিতভাবে অনুসন্ধান চালাতে হবে।

দেশের জ্বালানি ও বিদ্যুৎ খাত নিয়ে জাতীয় কমিটি যে রূপরেখা দিয়েছে তাতে স্বল্প মেয়াদে বিদ্যুৎ উৎপাদনে বিদ্যমান কাঠামোতে কিছু পরিবর্তনের সুপারিশ করে বলা হয়েছে, এই সময়ের মধ্যে জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংক্রান্ত পরিকল্পনার আমূল পরিবর্তন করে জাতীয় সক্ষমতা বিকাশে বিপুল গবেষণা ও নিয়োগের ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে।

২০২১ সাল পর্য ন্ত স্বল্পমেয়াদ ধরে প্রস্তাবিত কাঠামোতে মোট উৎপাদিত বিদ্যুতের মধ্যে গ্যাস থেকে শতকরা ৫৯ ভাগ, তেল থেকে শতকরা ১৯ ভাগ, নবায়নযোগ্য (সৌর, বায়ু ও বর্জ্য) জ্বালানি থেকে শতকরা ১০ ভাগ এবং আঞ্চলিক সহযোগিতা থেকে শতকরা ৭ ভাগ বিদ্যুৎ পাওয়ার কথা বলা হয়েছে।

২০৩১ সাল পর্য ন্ত মধ্যমেয়াদ ধরে প্রস্তাবনায় বলা হয়েছে, পুরনো গ্যাসক্ষেত্র থেকে গ্যাস পাওয়ার হার হ্রাস পেলেও যথাযথভাবে অনুসন্ধান করলে গভীর ও অগভীর সমুদ্র থেকে নতুন পর্যায়ে গ্যাস সরবরাহ শুরু হবে এই সময়ের মধ্যে। কোনো কারণে তার ঘাটতি দেখা দিলে গ্যাস আমদানিও অর্থনৈতিকভাবে লাভজনক হবে।

ততদিনে নবায়নযোগ্য উৎসগুলো ব্যবহারের সক্ষমতাও বাড়বে। এই সময়কালেও গ্যাসভিত্তিক বিদ্যুৎ শীর্ষস্থানে থাকবে (শতকরা ৪৯ ভাগ)। এরপর যথাক্রমে নবায়নযোগ্য জ্বালানি (শতকরা ৩৯ ভাগ), তেল (শতকরা ৭ ভাগ) ও আঞ্চলিক সহযোগিতা (শতকরা ৫ ভাগ)।

২০৪১ সাল পর্যগন্ত দীর্ঘমেয়াদ ধরে প্রস্তাবে বলা হয়, গুণগত পরিবর্তন নিশ্চিত করে নবায়নযোগ্য উৎস থেকেই বিদ্যুৎ উৎপাদন শীর্ষস্থানে পৌঁছুবে। এই সময়ের মধ্যে বিদ্যুৎ উৎপাদন শতকরা ৫৫ ভাগ নবায়নযোগ্য উৎস থেকে আনা সম্ভব। দ্বিতীয় স্থানে থাকবে প্রাকৃতিক গ্যাস, শতকরা ৩৭ ভাগ। তেল ও আঞ্চলিক সহযোগিতা শতকরা ৮ ভাগ।

সভায় বক্তব্য রাখেন সিপিবি সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বিশেষজ্ঞ প্যানেলের সদস্য ড. আব্দুল হাসিব চৌধুরী, প্রকৌশলী মাহাবুব সুমন, ড. সুজিত চৌধুরী, রাজনীতিক সাইফুল হক, জোনায়েদ সাকী।

আনু মুহাম্মদ বলেন, “সরকার যেভাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন করতে চায় সেভাবে দেশ ঋণের শৃঙ্খল ও আধিপত্যের মধ্যে পড়বে, পানি-মাটি-পরিবেশ বিপর্যস্ত হবে। এর থেকে বেরিয়ে আসতেই জাতীয় কমিটি বিকল্প প্রস্তাবনা তুলে ধরছে।

“এটি প্রস্তাবিত মহাপরিকল্পনার খসড়া মাত্র। চূড়ান্ত করার জন্য বিশেষজ্ঞসহ বিভিন্ন মহলের পরামর্শ নেওয়া হবে।”

সিপিবি সভাপতি বলেন, “আওয়ামী লীগ-বিএনপি দিয়ে এ মহাপরিকল্পনা বাস্তবায়ন হবে না। তার জন্য যে রাজনৈতিক ক্ষেত্র দরকার সে রাজনৈতিক ক্ষেত্রও প্রস্তুত করা হবে।

টিপু বিশ্বাস, রুহিন হোসেন প্রিন্স, মোশরেফা মিশু, জাহিদুল হক মিলু, আজিজুর রহমান, নাসিরউদ্দিন নসু, ফকরুদ্দিন কবির আতিক, মাহিনউদ্দিন চৌধুরী লিটন, মাসুদ খান ও সামছুল আলমসহ অন্যরা এসময় উপস্থিত ছিলেন।