বিডি ফুডসের হেরোইন পাচারের বিচার শুরু হয়নি ১১ বছরেও

১১ বছর পেরিয়ে গেলেও যুক্তরাজ্যে হেরোইন পাচারের ঘটনায় বিডি ফুডস লিমিটেডের কর্মকর্তা-কর্মচারীদের বিরুদ্ধে করা মামলার বিচার শুরু হয়নি।

প্রকাশ বিশ্বাসপ্রকাশ বিশ্বাস আদালত প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 22 July 2017, 12:37 PM
Updated : 22 July 2017, 12:37 PM

এজাহারত্রভুক্ত আসামি বিডি ফুডসের চেয়ারম্যান বদরুদ্দোজা মোমিনসহ দুজন অব্যাহতি পেলেও তা নিয়ে হাই কোর্ট প্রশ্ন তুলেছে।

এজহারের আট আসামির মধ্যে বাকি ছয়জনের বিরুদ্ধে ছয় বছর আগে অভিযোগ গঠন হলেও এখন পর্যন্ত আদালতে একজন সাক্ষীকেও হাজির করা যায়নি।

তদন্ত কর্মকর্তা এবং রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের অবহেলার কারণে বিচারকাজ এগোচ্ছে না বলে অভিযোগ করেছেন মামলার বাদী পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগের (সিআইডি) তৎকালীন সহকারী সুপার দীপক গুপ্ত।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তদন্ত কর্মকর্তা এই মামলায় জব্দ করা অনেক দলিল, অনেক মেমো অভিযোগপত্রে আনেননি; আবার বিভিন্ন স্মারক সমর্থনে কাগজপত্র ইচ্ছাকৃতভাবে জমা দেননি।”

এই মামলায় ৬ মাস আগে সমন পেয়ে তিনি আদালতে হাজির হলেও বিচারক ‘সময়ের অভাবে’ সাক্ষ্য নেননি বলে তিনি জানান।

দীপক বলেন, “এই মামলায় আদালত সংশ্লিষ্টদের প্রায় সবাই কোনো না কোনোভাবে আসামিদের কাছ থেকে সুবিধা নিয়েছেন। যে কারণে আমার বাসা আদালত সংলগ্ন ৪৮ জনসন রোডে হলেও সাক্ষ্য দেওয়ার জন্য আমার বাসায় আর কোনোবার এ আদালত থেকে সমন বা পরোয়ানা আসেনি।

“আমি খোঁজ নিয়ে জানতে পেরেছি যে, অন্য সাক্ষীদেরও আদালতে আনার বেলায়ও যত্ন নিয়ে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না।”

যুক্তরাজ্যে পাঠানো বিডি ফুডসের দুটি চালানে ২০০৫ সালে ৭৫ কেজি হেরোইন ধরা পড়ার পর সিআইডি বাদী হয়ে আটজনকে আসামি করে ঢাকার মতিঝিল ও সূত্রাপুর থানায় মাদকদ্রব্য নিয়ন্ত্রণ আইনে দুটি মামলা করে।

এর মধ্যে একটি চালানে ২১ কেজি হেরোইন পাচারের ঘটনায় একটি মামলা হয় মতিঝিল থানায়।

এই মামলায় ২০১২ সালের ২৬ মে ঢাকার মুখ্য মহানগর হাকিম আদালতে অভিযোগপত্র দেন সিআইডির পরিদর্শক মোহাম্মদ হোসেন।

আসামিরা হলেন- বিডি ফুডসের চেয়ারম্যান বদরুদ্দোজা মোমিন, কর্মচারী নাজমুল হায়দার ওরফে বুলবুল, ব্যবস্থাপক আবু বকর সিদ্দিক, ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ মাইনুদ্দিন, তাদের সহযোগী বিমানের কার্গো শ্রমিক মোখলেসুর রহমান নয়ন, আরেক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গ্রিন হ্যাভেনের মালিক আবুল বাশার সেলিম, তার সহযোগী কাজী জাফর রেজা ও মিন্টু ওরফে তাজউদ্দিন।

অভিযোগপত্রে বলা হয়, ২০০৫ সালে চট্টগ্রাম নৌবন্দর দিয়ে শিম, লতাপাতা, কচু ও জালি ভরে ১৭০টি কার্টনে মোট সাত হাজার কেজি সবজির ভেতরে লুকিয়ে যুক্তরাজ্যে ২১ কেজি হেরোইন পাচার করে বিডি ফুডস।

এদের মধ্যে মিন্টু ছাড়া বাকিরা জামিনে আছেন। তাকে গ্রেপ্তারে পরোয়ানা জারি হলেও পুলিশ ধরতে পারেনি।

ওই মামলায় মোমিনের এক আবেদনে ওই বছরের ২৬ ডিসেম্বর তাকে অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

বিডি ফুডস, যাদের বিরুদ্ধে রয়েছে হেরোইন পাচারের অভিযোগ

অন্য সাত আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন ও অব্যাহতির আবেদনের ওপর শুনানি শেষে ২০১৩ সালের ৭ এপ্রিল এক আদেশে কাজী জাফর রেজাকেও অভিযোগ থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়।

দুই আসামির অব্যাহতির আদেশের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষ আপিল না করলেও ২০১৪ সালের ২০ জানুয়ারি বদরুদ্দোজা মোমিনকে অব্যাহতি দেওয়া কেন বেআইনি ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চেয়ে স্বতঃপ্রণোদিত রুল জারির পাশাপাশি মোমিনকে বিচারিক আদালতে আত্মসমর্পণের নির্দেশ দেয় হাই কোর্ট। পরে ১২ ফেব্রুয়ারি তিনি আত্মসমর্পণ করে জামিন নেন।

এর মধ্যে ২০১৩ সালের ৩ জুন বাকি ছয় আসামির বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পর থেকে ২০১৭ সালের জুন পর্যন্ত সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য ৩০টিরও বেশি ধার্য তারিখ থাকলেও একজন সাক্ষীকেও আদালতে উপস্থাপন করতে পারেনি রাষ্ট্রপক্ষ।

এবিষয়ে ঢাকার ৮ নম্বর বিশেষ জজ আদালতের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী আমির হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা সাক্ষীদের সমন, গ্রেপ্তারে পরোয়ানা পাঠাচ্ছি। কিন্তু সাক্ষীরা কেন আদালতে আসছেন না, তা বলতে পারছি না।

“আমরা আদালত থেকে সাক্ষী আনার জন্য সব ধরনের প্রসেস পুলিশের কাছে পাঠালেও পুলিশ এখনও একজন সাক্ষীকেও হাজির করেনি। আমরা কী করতে পারি?”

এই বিষয়ে তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ হোসেনের কোনো বক্তব্য পাওয়া যায়নি নানা চেষ্টার পরও। তার বর্তমান কর্মস্থল কোথায়, তা জানা যায়নি সিআইডি কর্মকর্তা এবং রাষ্ট্রপক্ষের কৌঁসুলিদের কাছে থেকে। তার মোবাইল নম্বরটিও কারও কাছে পাওয়া যায়নি।

আরেক মামলার কেস ডকেট গায়েব

এদিকে সূত্রাপুর থানায় দায়ের করা একই প্রতিষ্ঠানের একই আসামিদের বিরুদ্ধে ৫৪ কেজি হেরোইন পাচারের অন্য মামলাটির কেস ডকেট (সিডি) খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না।

রাষ্ট্রপক্ষে মামলা প্রমাণে গুরুত্বপূর্ণ এই নথি ছাড়া বিচার শেষ হলে সব আসামি খালাস পেয়ে যেতে পারেন বলে শঙ্কা রয়েছে।

ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালত (ফাইল ছবি)

এই মামলায় রাষ্ট্রপক্ষে অন্যতম আইনজীবী সহকারী পাবলিক প্রসিকিউটর শাহ জামাল লিটন কেস ডকেট ফেরত দিয়েছেন বলে এর আগে আদালতপাড়ার সাংবাদিকদের জানিয়েছিলেন।

তবে রাষ্ট্রপক্ষের প্রধান কৌসুঁলি আবদুল্লাহ আবু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি লিটনকে মহানগর পিপির কার্যালয়ে কেস ডকেট ফেরত দেওয়ার আদেশ দিয়েছি। কিন্তু সে সেটি এখনও ফেরত দিতে পারেনি।”

শাহ জামাল লিটনের কাছে জানতে চাইলেও তিনি বার বার এড়িয়ে যাচ্ছেন বলে আবদুল্রাহ আবু জানান।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের ফোনও ধরেননি শাহ জামাল লিটন।

২০১২ সালের ১ অক্টোবর একই তদন্ত কর্মকর্তা মোহাম্মদ হোসেন এই মামলায়ও আদালতে অভিযোগপত্র দাখিল করেন। সেই সঙ্গে আসামি বদরুদ্দোজা মোমিন ও মাঈনুদ্দিনকে অব্যাহতির আবেদন করা হয়।

২০১৩ সালের ৩০ জানুয়ারি ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক মো. আখতারুজ্জামান অভিযোগপত্র গ্রহণ করে ওই দুই আসামিকে অব্যাহতি পান।

পরের বছর ২০ মে ঢাকার তৃতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতের বিচারক রুহুল আমিন আসামিদের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠন করেন। বর্তমানে ঢাকার ৩ নম্বর বিশেষ জজ আদালতে থাকা মামলাটি সাক্ষ্যগ্রহণের পর্যায়ে রয়েছে।

২০১৪ সালের ৭ জানুয়ারি মামলাটি ঢাকার দ্বিতীয় অতিরিক্ত মহানগর দায়রা জজ আদালতে বিচারাধীন থাকাবস্থায় প্রসিকিউটর শাহ জামাল লিটন কেস ডকেট নেন।

এরপর পাঁচ নম্বর বিশেষ জজ আদালত ও তিন নম্বর বিশেষ জজ আদালতে মামলা বদলি হয়ে গেলেও তিনি সংশ্লিষ্ট আদালতগুলোর প্রসিকিউটরদের সিডি বুঝিয়ে দেননি বলে অভিযোগ।