অঙ্গদান: আইনে আত্মীয়দের পরিধি বাড়ছে

আত্মীয়ের সংজ্ঞা পরিবর্তন করে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দেওয়া-নেওয়ার ক্ষেত্রে অনুমোদিত রক্তসম্পর্কিতদের পরিধি বাড়াতে আইন সংশোধনের প্রস্তাবে সায় দিয়েছে সরকার।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 July 2017, 08:19 AM
Updated : 17 July 2017, 06:49 PM

সেই সঙ্গে সরকারি হাসপাতালের বিশেষায়িত ইউনিট ছাড়া অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে সব ধরনের হাসপাতালের জন্য সরকারের অনুমতি নেওয়া বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে।

সচিবালয়ে সোমবার প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে মন্ত্রিসভার নিয়মিত বৈঠকে ‘মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন (সংশোধন) আইন- ২০১৭’ এর খসড়ায় চূড়ান্ত অনুমোদন দেওয়া হয়।

সভা শেষে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের অতিরিক্ত সচিব মো. আশরাফ শামীম সাংবাদিকদের বলেন, নতুন আইন অনুযায়ী, আপন নানা, নানী, দাদা, দাদী, নাতি, নাতনী, চাচাতো-মামাতো-ফুফাতো-খালাতো ভাই বা বোনরাও রক্তসম্পর্কিত হিসেবে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দান ও গ্রহণ করতে পারবেন।

আগের আইনে নিকটাত্মীয় হিসেবে পুত্র, কন্যা, পিতা, মাতা, ভাই, বোন ও ও স্বামী-স্ত্রীর সঙ্গে রক্তসম্পর্কিত হিসেবে আপন চাচা, ফুফু, মামা, খালা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দান ও গ্রহণ করতে পারতেন বলে জানান তিনি।

অতিরিক্ত সচিব শামীম বলেন, “কোনো হাসপাতাল সরকারের অনুমতি ছাড়া মানবদেহে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন করতে পারবে না। যে হাসপাতালই অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজন করুক সরকারের অনুমতি লাগবে। বেসরকারি হাসপাতাল পরিদর্শন হবে, দেখবে শর্ত পূরণ হচ্ছে কি না, এরপরেই অনুমোদন দেওয়া হবে।

“যেসব সরকারি হাসপাতালে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজনের বিশেষায়িত ইউনিট রয়েছে সেসব হাসপাতালের অনুমোদন নেওয়ার দরকার নেই।”

যাদের অনুমতি নেই তারা এই আইন কার্যকর হওয়ার ৬০ দিনের মধ্যে অনুমতির জন্য সরকারের কাছে আবেদন করতে পারবে বলেও জানান আশরাফ শামীম।

নতুন আইন কার্যকর হলে কিডনি, হৃৎপিণ্ড, ফুসফুস, অন্ত্র, যকৃত, অগ্নাশয়, অস্থি, অস্থিমজ্জা, চোখ, চর্ম ও টিস্যু ছাড়াও মানবদেহে সংযোজনযোগ্য যে কোনো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন করা যাবে বলে তিনি জানান।

আইন সংশোধনের কারণ জানতে চাইলে শামীম বলেন, চিকিৎসা বিজ্ঞান অনেক এগিয়েছে, তার সঙ্গে সঙ্গতি রেখে চিকিৎসা সেবার মানোন্নয়নের লক্ষ্যে এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।

“এর সঙ্গে মানবদেহের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের অবৈধ পাচারের সংযুক্তি ঘটেছিল, এটা সেটাও রোধ করবে। এই বিষয়টা নিয়ে ব্যবসাপাতি করা সেটারও একটা প্রতিরোধক ভূমিকা এই আইন পালন করবে।”

অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দানের নিয়ম

স্বাভাবিক জীবনযাপনের ব্যাঘাত সৃষ্টির আশঙ্কা না থাকলে সুস্থ ও স্বাভাবিক বুদ্ধিসম্পন্ন ব্যক্তিরা আইনে নির্দিষ্ট আত্মীয়দের অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দান করতে পারবেন বলে জানান আশরাফ শামীম।

তবে চোখ ও অস্থিমজ্জা সংযোজন ও প্রতিস্থাপনে নিকটাত্মীয় হওয়ার প্রয়োজন হবে না।

বেঁচে থাকার সময় কেউ স্বেচ্ছায় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দান করে গেলে তা অন্যকে দেওয়া যাবে জানিয়ে অতিরিক্ত সচিব বলেন, “ব্রেইন ডেথ ঘোষণার পর কোনো আইনানুগ উত্তরাধিকারী কোনো ব্যক্তির দেহ থেকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ বিযুক্ত করার জন্য লিখিতভাবে অনুমতি দিলে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দেওয়া যাবে।”

ব্রেইন ডেথ ঘোষণার ২৪ ঘণ্টার মধ্যে কোনো দাবিদার না থাকলে ব্রেইন ডেথ ঘোষণাকারী হাসপাতালের প্রশাসনিক কর্তৃত্বপালনকারী ব্যক্তি অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দেওয়ার বিষয়ে অনুমতি দিতে পারবেন বলেও জানান আশরাফ শামীম।

“চোখ দান করার জন্য মৃতদেহ অন্য কোনো ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা স্থানে থাকলে উক্ত ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা স্থান যে জেলা প্রশাসকের প্রশাসনিক এখতিয়ারাধীন তিনি বা তার ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি লিখিত অনুমতি দিলে দান করা যাবে।”

ব্রেইন ডেথ ঘোষণার জন্য একটি কমিটি থাকবে জানিয়ে শামীম বলেন, মেডিসিন বা ক্রিটিক্যাল কেয়ার মেডিসিন, নিউরোলজি এবং অ্যানেস্থেসিয়লজির একজন করে বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক বা সহযোগী অধ্যাপক পদমর্যাদার কমপক্ষে তিনজন চিকিৎসক নিয়ে গঠিত কমিটি কোনো ব্যক্তিকে ব্রেইন ডেথ হিসেবে ঘোষণা করতে পারবে।

ব্রেইন ডেথ ঘোষণাকারী কমিটির কোনো চিকিৎসক বা তার কোনো নিকটাত্মীয় অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ প্রতিস্থাপন বা সংযোজনের সঙ্গে জড়িত থাকতে পারবেন না।

কোন কোন কারণে ব্রেইন ডেথ ঘোষণা করা যাবে না আইনের খসড়ায় তা বিস্তারিতভাবে বলা হয়েছে বলেও জানান শামীম।

দাতা ও গ্রহীতার যোগ্যতা

প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী, ব্রেইন ডেথ ঘোষণা করা হলেও কারো বয়স দুই বছরের কম বা ৬৫ বছরের বেশি হলে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেওয়া যাবে না। তবে চোখ ও অস্থিমজ্জার ক্ষেত্রে এই বিধান প্রযোজ্য হবে না।

১৮ বছরের কম এবং ৬৫ বছরের বেশি বয়সের জীবিত ব্যক্তির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেওয়া যাবে না। মারা যাওয়ার আগে কেউ অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দানে লিখিত আপত্তি করলেও তার অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেওয়া যাবে না।

শামীম বলেন, ১৫ বছর থেকে ৫০ বছরেরর ব্যক্তিরা অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ গ্রহীতা হিসেবে অগ্রাধিকার পাবেন। চোখের কর্নিয়া প্রতিস্থাপনে বয়সের এই বিধি-নিষেধ প্রযোজ্য হবে না।

দাতার চোখ, অস্থিমজ্জা প্রতিস্থাপন ছাড়া অন্য ক্ষেত্রে ‍এজিবিএসএজি, এনটিএইচসিবি এবং এইচআইভি পজেটিভ থাকলে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ দেওয়া যাবে না বলেও তিনি জানান।

মেডিকেল বোর্ড

অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজনের কাজ পরিচালনায় সংশ্লিষ্ট হাসপাতালে একটি মেডিকেল বোর্ড গঠন করতে হবে, যার প্রধান হবেন সংশ্লিষ্ট বিষয়ে সার্জারিতে অভিজ্ঞ অধ্যাপক পদমর্যাদার একজন চিকিৎসক।

এছাড়া কমপক্ষে সহযোগী অধ্যাপক পদমর্যাদার একজন অ্যানেস্থেসিয়লজিস্ট এবং সংশ্লিষ্ট হাসপাতালের পরিচালক পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা বা চিকিৎসকও এই বোর্ডে থাকবনে।

মেডিকেল বোর্ড প্রয়োজনে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে এক বা একাধিক অভিজ্ঞতাসম্পন্ন চিকিৎসককে সদস্য হিসেবে বোর্ডে অন্তর্ভুক্ত করতে পারবে।

দাতা ও গ্রহীতার আত্মীয়তার সম্পর্ক নির্ধারণ করে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজনের সিদ্ধান্ত দেবে বোর্ড। এছাড়া ব্রেইন ডেথ ঘোষিত ব্যক্তির অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংগ্রহের বিষয়েও বোর্ড সিদ্ধান্ত দেবে।

অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংগ্রহ ও সংযোজনে সহায়তা দিতে একটি প্রত্যয়ন বোর্ড থাকবে জানিয়ে শামীম বলেন, স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কমপক্ষে উপ-পরিচালক পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা হবেন এর প্রধান, মেডিকেল বোর্ডের উপরে হবে এর অবস্থান।

ব্রেইন ডেথ ঘোষিত কারো অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংগ্রহে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের উপচার্যকে সভাপতি করে সরকারের ‘কাড্যাভেরিক জাতীয় কমিটি’ থাকবে।

১১ সদস্যের এই কমিটিতে স্বাস্থ্য সেবা বিভাগের কমপক্ষে যুগ্ম-সচিব পদদর্যাদার একজন কর্মকর্তা সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন বলেও জানান আশরাফ শামীম।

“জাতীয় কমিটি কাড্যাভেরিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংগ্রহ কার্যক্রমের বিষয়ে দিক-নির্দেশনা দেবে। কাড্যাভেরিক অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংগ্রহ কার্যক্রম পরিদর্শন এবং অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংগ্রহ কার্যক্রম সহজীকরণ, সম্প্রসারণ ও সুষ্ঠ ব্যবস্থাপনার জন্য তাৎক্ষণিক পরামর্শ দেবে এই কমিটি।”

এছাড়া ব্রেইন ডেথ হিসেবে ঘোষণা করা ব্যক্তির শরীর থেকে অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ নেওয়ার বিষয়েও এই কমিটি সরকারের কাছে সুপারিশ দেবে।

‘কাড্যাভেরিক’ শব্দের‌ ব্যাখ্যায় শামীম বলেন, হৃৎপিণ্ড স্পন্দনরত এইরূপ মানবদেহ যা অনুমোদিত বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক কর্তৃক ব্রেইন ডেথ মর্মে ঘোষিত এবং যার অঙ্গ অন্য মানবদেহে প্রতিস্থাপনের জন্য লাইফ সাপোর্ট দিয়ে কার্যক্ষম রাখা হয়েছে।”

অপরাধ ও দণ্ড

নিকটাত্মীয়তা সম্পর্কে মিথ্যা তথ্য দিলে বা ওই ধরনের তথ্য দিতে উৎসাহিত, প্ররোচিত বা ভীতি প্রদর্শন করলে তা অপরাধ হিসেবে গণ্য হবে। এজন্য সর্বোচ্চ ২ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ৫ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ড হবে।

নিকট আত্মীয় সংক্রান্ত অপরাধ ছাড়া এই আইনের অন্য কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে বা লঙ্ঘনে সহায়তা করলে সর্বোচ্চ ৩ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড বা সর্বোচ্চ ১০ লাখ টাকা জরিমানা বা উভয় দণ্ডে দণ্ডিত হবেন।

এই আইনের অধীনে অপরাধের জন্য কোনো চিকিৎসক দণ্ডিত হলে বাংলাদেশ মেডিকেল অ্যান্ড ডেন্টাল কাউন্সিলের দেওয়া নিবন্ধন বাতিলযোগ্য হবে।

“কোনো হাসপাতাল এই আইনের অধীনে অপরাধ করলে ওই হাসপাতালের পরিচালনা বা ব্যবস্থাপনার সঙ্গে জড়িত মালিক বা পরিচালক তিনি যে নামেই পরিচিত হোন না কেন তিনি অপরাধ করেছেন বলে গণ্য হবেন। যদি না তিনি প্রমাণ করতে সক্ষম হন যে ওই অপরাধ তার অজ্ঞাতসারে হয়েছে এবং তা রোধ করার জন্য তিনি যথাসাধ্য চেষ্টা করেছেন।”

কোনো হাসপাতাল এই আইনের অধীনে অপরাধ করলে এর অঙ্গ-প্রত্যঙ্গ সংযোজনের অনুমতি বাতিল হবে এবং সংশ্লিষ্ট অপরাধের জন্য অর্থদণ্ড আরোপ করা যাবে।

আগের আইনে কোনো বিধান লঙ্ঘন করলে বা লঙ্ঘনে সহায়তা করলে সর্বোচ্চ ৭ বছর ও সর্বনিম্ন ৩ বছরের সশ্রম কারাদণ্ড বা কমপক্ষে ৩ লাখ টাকা অর্থদণ্ড বা উভয় দণ্ডের বিধান ছিল।

প্রস্তাবিত আইনে শাস্তি কমল কি না- এমন প্রশ্নে আশরাফ শামীম বলেন, “আগে শাস্তি ছিল ঢালাওভাবে, অনির্ধারিত। এবার দণ্ডের ক্ষেত্রগুলো সুনির্ধারিত করা হয়েছে।”