আদুরির দুঃস্বপ্নে এখনও হানা দেন গৃহকর্ত্রী নদী

চার বছর গড়ালেও গৃহকর্ত্রীর নির্যাতনের স্মৃতি ভুলতে পারেনি আদুরি; মামলার রায়ে নির্যাতনকারীর শাস্তি চেয়েছেন তার মা।

কামাল হোসেন তালুকদার ও সঞ্জয় কুমার দাসবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 July 2017, 03:25 AM
Updated : 18 July 2017, 05:58 AM

প্রায় চার বছর গড়িয়ে গেছে; দিনের হিসেবে চৌদ্দশ’ দিন। কিন্তু এখনও গৃহকর্ত্রী নওরীন জাহান নদীর নির্যাতনের দুঃস্বপ্ন ভাঙিয়ে দেয় কিশোরী আদুরির ঘুম।  

“নদী; আমি তারে দেহি; সব দেহি ঘুমালে,” বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলে আদুরি।

ঢাকা নগরীর নির্মম নির্যাতনের অভিজ্ঞতা নিয়ে এখন পটুয়াখালী সদর উপজেলার কৌরাখালী গ্রামে পরিবারের সঙ্গে আছে এই কিশোরী। ভর্তি হয়েছে পাশের গ্রাম পূর্ব জৈনকাঠীর একটি মাদ্রাসায়, পড়ে তৃতীয় শ্রেণিতে।

আদুরির মা শাফিয়া বেগম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সবাইর কথা মনে পড়ে আদুরির। রাইতে হুইলে চিক্কুর দিয়া উঠে বলে- ‘মাগো, আমার ভয় করে নদী আবার আয়’।”

২০১৩ সালের ২৩ সেপ্টেম্বর ঢাকা ক্যান্টনমেন্ট থানা এলাকায় একটি ডাস্টবিন থেকে অচেতন অবস্থায় শিশু আদুরিকে উদ্ধার করেছিল পুলিশ। তখন তার বয়স ছিল ১১ বছর।

পুলিশের তদন্তে বেরিয়ে আসে, আগের দিন তার গৃহকর্ত্রী পল্লবীর ১২ নম্বর সেকশনের ২৯/১, সুলতানা প্যালেসের দ্বিতীয় তলার বাসিন্দা নদী ধারালো চাকু দিয়ে গৃহকর্মী আদুরির শরীরের বিভিন্ন অংশ কেটে, ইস্ত্রি দিয়ে ছ্যাঁকা দিয়ে মারাত্মক জখম করে মেয়েটিকে সেখানে ফেলে রাখেন।

তার তিন দিন পর আদুরির মামা নজরুল চৌধুরী বাদী হয়ে পল্লবী থানায় নারী ও শিশু নির্যাতন দমন আইনে মামলা করেন। নদী ছাড়াও আসামি করা হয় তার মা ইশরাত জাহান, স্বামী সাইফুল ইসলাম মাসুদ, তাদের আত্মীয় সৈয়দ চুন্নু মীর ও মো. রনিকে।

ওই মামলায় আগামী ১৮ জুলাই রায় দেবেন ঢাকার ৩ নম্বর নারী ও শিশু নির্যাতন দমন ট্রাইব্যুনালের বিচারক জয়শ্রী সমাদ্দার।

রায়ের আগে আদুরির খোঁজ নিতে গেলে জানা গেল, এখনও ভয় কাটিয়ে উঠতে পারেনি মেয়েটি।

হাসপাতালের বিছানায় আদুরি

চার বছর আগে উদ্ধারের পর আদুরি আদালতে জবানবন্দিতে বলেছিল, গৃহকর্ত্রী নদী তাকে দিনে একবেলা খেতে দিতেন, তাও মুড়ি। মাঝেমধ্যে ভাত দিতেন, তাও শুধু লবণ কিংবা মরিচ দিয়ে। থাকতে দিতেন বেলকনিতে। আর নির্যাতন চলত অহরহ।

আদুরি এখন বয়সে বড় হলেও বাচনভঙ্গি আগের মতো আছে। বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে সে বলে, শরীরের যেসব স্থানে নির্যাতন করেছিল, সেই সব স্থানে এখনও ব্যথা হয়, চুলকায়। মাঝে মাঝে জ্বরও আসে।

নির্যাতনের কথা স্বীকার করে নদী আদালতে জবানবন্দিতে বলেছেন, সংসারে আর্থিক টানাটানিতে মানসিকভাবে ভেঙে পড়েছিলেন তিনি। আদুরি কোনো কাজে ভুল করলে তার খুব রাগ হত।

মামলায় কী সাজা চান- জানতে চাইলে শাফিয়া বলেন, “নদীর কী সাজা হবে, এটা আপনারাও তো জানেন। আমার আস্তা একটা মাইয়া কাজ করতে দিছি পেটের দায়। হেইয়া এমন অবস্থা করছে, প্রতিবন্ধী বানাইয়া দিছে। আমার দুঃখের কথা আমনেরা সবাই জানেন।

“মইরা গেছে ভাইবা ডাস্টবিনে ফালাইয়া দিছিলো। পরে সবার দোয়ায় এক মাসে বেশি হাসপাতালে থাইকা ভাল হইছে।”

সেই সময় আদুরিকে চিকিৎসা দিয়েছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারের (ওসিসি) চিকিৎসক বিলকিস বেগম।

আদুরির মা শাফিয়া বেগম

রায়ের বিষয়ে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি চাই উপযুক্ত শাস্তি হোক। একটা দৃষ্টান্ত থাকা উচিৎ।”

স্বামী মারা যাওয়ায় শাফিয়া নয় ছেলে-মেয়েকে নিয়ে বিপদে পড়েছিলেন। তখন এলাকার চুন্নু মীর তার শ্যালক মাসুদের বাসায় মাসিক ৫০০ টাকা বেতনে সাত বছর বয়সী আদুরিকে গৃহকর্মে দেওয়ার প্রস্তাব করলে তিনি রাজি হয়েছিলেন।

তবে তদন্তের পর নির্যাতনের এই মামলা থেকে চুন্নু মীর, রনি ও নদীর স্বামী মাসুদকে অব্যাহতি দেওয়ার সুপারিশ রেখে অভিযোগপত্র দেন এসআই কুইন আক্তার।

এরপর নদী ও তার মা ইশরাত বেগমের বিরুদ্ধে অভিযোগ গঠনের পর শুরু হয় বিচার। নদী কারাগারে থাকলেও তার মা জামিনে মুক্ত আছেন।

পটুয়াখালী সদর উপজেলার কৌরাখালী গ্রামে আদুরিদের বাড়ি

আদুরিকে পরিবারের কাছে হস্তান্তরের সময় ঢাকা মহানগর পুলিশ তার মা শাফিয়াকে পাঁচটি রিকশা ও কিছু টাকা দিয়েছিল।

দুটি রিকশা নষ্ট হয়ে গেছে জানিয়ে এই দরিদ্র নারী বলেন, “পায়ের রিকশা দিয়েছিল, অটো রিকশা হলে ভালো হত।”

খালেক মৃধা ও শাফিয়ার ছেলে-মেয়েদের মধ্যে আদুরি সপ্তম। বড় ছেলে সোহেল মৃধা মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে।

পুলিশের পক্ষ থেকে রিকশার পাশাপাশি চার কাঠা জমিও দেওয়া হয়েছিল। ওই জমিতেই এখন থাকে আদুরিরা।

গত ১২ জুলাই পটুয়াখালীর পুলিশ কর্মকর্তারা আদুরির বাড়িতে গিয়ে তার খোঁজ-খবর নিয়ে আসেন।