জিয়া পরিষদে ছিলেন মামলাকারী সেই নীল শিক্ষক

সহকর্মীর বিরুদ্ধে তথ্য প্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা করে আলোচনায় আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল মনসুর আহাম্মদ আওয়ামী লীগপন্থি শিক্ষকদের নীল দল থেকে এখন সিনেট সদস্য হলেও আগের কর্মস্থল রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে বিএনপিপন্থি সংগঠন জিয়া পরিষদের সক্রিয় সদস্য ছিলেন।

নিজস্ব প্রতিবেদকও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 16 July 2017, 04:16 PM
Updated : 16 July 2017, 06:27 PM

বিষয়টি নিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীল দলের শিক্ষকদের মধ্যে ক্ষোভ থাকলেও রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক রোববার এক ফেইসবুক পোস্টে তা প্রকাশ্যে এনেছেন।

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক মনসুর ফেইসবুকে মিথ্যা তথ্য দিয়ে ভাবমূর্তি ক্ষুণ্নের অভিযোগ তুলে ১৩ জুলাই তার বিভাগের আরেক অধ্যাপক ফাহমিদুল হকের বিরুদ্ধে ৫৭ ধারায় মামলা করেন ।

এরপর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রতিবাদ ও আলোচনার ঝড় উঠে, মামলা প্রত্যাহার চেয়ে রোববার ক্যাম্পাসে মানববন্ধন করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল শিক্ষক-শিক্ষার্থী।

এদিকে অধ্যাপক মনসুরের এক সময়ের সহকর্মী রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক আ-আল মামুন দুপুরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের জিয়া পরিষদের একটি স্মরণিকার চারটি পাতার ছবি দিয়ে একটি ফেইসবুক পোস্ট দেন।

বিএনপির প্রতিষ্ঠাতা জিয়াউর রহমানের ২৫তম মৃত্যুবার্ষিকী উপলক্ষে ২০০৬ সালে ‘মৃত্যুঞ্জয়ী জিয়া’ নামে জিয়া পরিষদের বের করা ওই স্মরিণিকার ১১৫ পৃষ্ঠায় পরিষদের সদস্য তালিকায় অধ্যাপক মনসুরের ছবিসহ পরিচয় প্রকাশ হয়।

ওই পাতার ছবি তুলে দিয়ে আ-আল মামুন তার ফেইসবুক পোস্টে লেখেন, “ড. আবুল মনসুর আহাম্মদ রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে দীর্ঘদিন আমার প্রিয় সহকর্মী ছিলেন। আজকের ঢাবি ব্লু গ্রুপের প্রতাপশালী শিক্ষক, বর্তমান ঢাবি সিনেট সদস্য ড. মনসুর রাবিতে জিয়া পরিষদ করতেন। তখনকার প্রশাসনের সাথেও নিবিড়ভাবে সম্পর্কিত ছিলেন।”

তিনি লেখেন, “শুধু এক টুকরো অতীত তুলে ধরার জন্য আমাকে এই পোস্ট দিতে হল, এক বিশেষ পরিস্থিতিতে অনেকে জানতে চাইছিলেন বলে। নইলে আর কে চায় এসব অতীত খুঁড়ে বেদনা জাগাতে!!”

রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় জিয়া পরিষদের সেই সময়কার যুগ্ম-সম্পাদক অধ্যাপক মোহা. এনামুল হক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যতটুকু দেখেছি, ১৯৯৫ সাল থেকে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ইউসুফ আলীর ডান হাতই ছিলেন উনি (অধ্যাপক মনসুর)। আমাদের সাথে একসাথে অনেক মিটিং সিটিং সব কিছু করেছেন। পলিটিক্যাল অ্যাক্টিভিটিজ যেটা আমাদের সঙ্গে করেছেন।
“তারপর এখান থেকে চলে যাওয়ার পরে শুনলাম যে উনি আওয়ামী রাজনীতি করেন। এখানে যতদিন ছিলেন, ২০০৬ সাল পর্যন্ত আমাদের পরিষদের মেম্বারও ছিলেন উনি।”

ওই স্মরণিকা প্রকাশে ‘সার্বিক সহযোগিতাকারী’ হিসাবে নাম ছাপা হয়েছিল মনোবিজ্ঞান বিভাগের অধ্যাপক এনামুলের; সর্বশেষ কমিটিতে জিয়া পরিষদের সাংগঠনিক সম্পাদক ছিলেন তিনি।

অধ্যাপক এনামুল জানান, স্মরণিকার শেষের দিকে অনুষদ ও ইনস্টিটিউট অনুযায়ী সদস্যদের ছবিসহ নাম পরিচয় ছাপানো হয়। তার মধ্যে গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগ থেকে সদস্য হিসাবে আবুল মনসুর আহাম্মদের নাম ছিল। 

এই প্রেক্ষাপটে আবুল মনসুরসহ ক্ষমতা বদলের সঙ্গে আদর্শিক অবস্থান বদলানো শিক্ষকদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা চাইছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের নীল দলের অনেক শিক্ষক।

অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ

তাদের একজন অধ্যাপক মুহাম্মদ সামাদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অন্য দল থেকে আসা সাত থেকে আটজন এখানে আছে। উপাচার্য মহোদয়, ট্রেজারার ও নীল দলের আহ্বায়ক মিলে তাদের সেখানে অন্তর্ভুক্ত করেছেন।

“আমার একটা প্রশ্ন, নীল দল কোনো ক্রাইসিসে পড়লে তখন এরা সাথে থাকবে? আমারতো মনে হয়, রাতারাতি ছেড়ে যাবে। এমন ঘটনায় আমরা সিনিয়র শিক্ষকরা হতাশ ও ক্ষুব্ধ।”

নীল দলের আরেক শিক্ষক সমাজবিজ্ঞানের অধ্যাপক সাদেকা হালিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কেবল ড. মনসুর নন, সিনেটের মধ্যে এমন চার-পাঁচজন সদস্য আছেন যারা কি না সাদা দল থেকে সরাসরি এসে এ ধরনের রাজনীতি করে আবার নীল দলে ঢুকেছেন। এবারকার সিনেটে অন্তত ছয়জন সরাসরি সাদা দলের সঙ্গে জড়িত ছিল আগে।

অধ্যাপক সাদেকা হালিম

“তিনি (অধ্যাপক মনসুর) যে জিয়া পরিষদের সদস্য ছিলেন, তখন শিক্ষকরা বারবার সেটা বলেছেন। দলের ভেতরের মিটিংয়ে মনোনয়নের সময়ই বলা হয়েছে।

“কিন্তু আমাদের যিনি সর্বোচ্চ প্রশাসন তিনি গ্রাহ্য করেননি,” উপাচার্য আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিককে ইঙ্গিত করে বলেন তিনি।

এ বিষয়ে জানতে চাইলে অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তার (অধ্যাপক মনসুর) আগের অবস্থান আমি জানি না। আমার কাছে সে সংক্রান্ত তথ্য নাই। এই রকম সময় আসলে অনেকে পরিস্থিতি জটিল করার চেষ্টা করে। এ বিষয়ে যেহেতু কোনো তথ্য নাই, সেহেতু আমি মন্তব্য করতে চাই না।”

অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক

এ বিষয়ে অধ্যাপক আবুল মনসুর আহাম্মদের সঙ্গে মোবাইল ফোনে অনেকবার যোগাযোগের চেষ্টা করেও পাওয়া যায়নি। পরবর্তীতে সরাসরি দেখা করে বক্তব্য জানতে চাইলে কোনো মন্তব্য করতে রাজি হননি তিনি।

গত ২২ মে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সিনেটে ৩৫ জন শিক্ষক প্রতিনিধি নির্বাচনে নীল দল থেকে বিজয়ী হন গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের অধ্যাপক আবুল মনসুর আহাম্মদ।

ওই নির্বাচনের আগে প্রার্থিতা নিয়ে বিরোধ বাধে সরকার সমর্থক শিক্ষকদের এই দলে; নীল দলের সভায় চূড়ান্ত করা প্যানেলের বাইরে গিয়ে নেতৃত্ব আরেকটি প্যানেল তৈরি করায় ক্ষোভ দেখা দেয়। পরে আরেকটি প্যানেল জমা দেন বিদ্রোহীরা। নীল দলের সভায় পাস হওয়া ওই প্যানেলে ছিলেন না অধ্যাপক আবুল মনসুর।

নির্বাচনের সাতদিন আগে বিদ্রোহীদের প্যানেল বাতিল ঘোষণা করার পরদিন উভয়পক্ষই দ্বারস্থ হয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার। প্রার্থিতা বাতিল নিয়ে আদালতে যাওয়ার হুমকি দিলেও প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকের পর রণেভঙ্গ দেন বিদ্রোহীরা।

ওই প্রার্থিতা বাতিলকে ৭৩’র অধ্যাদেশ অনুযায়ী বেআইনি দাবি করে অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেন, “আমাদের দাবি হচ্ছে, এই সিনেটে যারা আছেন এই রকম, সিনেটের যিনি প্রধান, মাননীয় উপাচার্য, তার উচিত হবে পুনরায় নির্বাচন দিয়ে পরিষ্কার করা, সিনেটইতো বৈধ না। ৭৩’র অধ্যাদেশ লঙ্ঘন করে আমাদের প্রার্থিতা তিনি বাদ দিয়েছেন।”

তিনি বলেন, “নীল দল এখন যে পরিস্থিতিতে গিয়েছে, কোনো দল যখন ক্ষমতায়  থাকে তখন তাদের কাছে অনেকে ভিড়তে চায়, জামায়াত বলি, জিয়া পরিষদ বলি, তারা আসতে চায়। এরা একটি অপারচুনিটি চায়। তারা অনেক সময় ক্ষমতার কাছাকাছি থাকেন। আবার যারা ক্ষমতার শীর্ষে থাকেন তারাও তাদেরকে কাছে রাখেন। কারণ যখন কোনো অশুভ উদ্দেশ্য সাধন করতে চান, তখন এদেরকে কাজে লাগানো সম্ভব হয়।”

রোববার গণযোগাযোগ ও সাংবাদিকতা বিভাগের একাডেমিক কমিটির সভায় ফেইসবুক স্ট্যাটাসের জন্য অধ্যাপক ফাহমিদুল হকের দুঃখপ্রকাশের প্রেক্ষাপটে অধ্যাপক মনসুর মামলা প্রত্যাহারে রাজি হয়েছেন বলে রাতে বিভাগের এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে।