অপহরণের কথা বলা বন্ধ করতে স্ত্রীকে বলেছিলেন ফরহাদ মজহার: পুলিশ

নিরুদ্দেশ থাকা অবস্থায় ফরহাদ মজহার ও তার স্ত্রী ফরিদা আখতারের টেলি কথোপকথনের অডিও ক্লিপ পুলিশ পেয়েছে, যাতে তাকে অপহরণের কথা বলতে মানা করতে শোনা গেছে বলে দাবি করেছেন আইজিপি এ কে এম শহীদুল হক।

কামাল তালুকদারজ্যেষ্ঠ প্রতিবেদক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 July 2017, 04:12 PM
Updated : 13 July 2017, 10:00 PM

ফরহাদ মজহারের অন্তর্ধান রহস্য নিয়ে তুমুল আলোচনার মধ্যে বৃহস্পতিবার পুলিশ প্রধান বিভিন্ন ভিডিও ও অডিও নিয়ে সাংবাদিকদের সামনে হাজির হয়ে বলেন, এটি অপহরণের কোনো ঘটনা ছিল না।

পুলিশ সদর দপ্তরে এক সংবাদ সম্মেলনে শহীদুল হক বলেন, নিখোঁজ হওয়ার পর ফরহাদ মজহার তার স্ত্রীকে ১০ বার ফোন করেছিলেন এবং তাদের কী কথা হয়েছে, তার কিছু অডিও ক্লিপ শুনেছেন তারা।

“ঘটনা তদন্ত করতে গিয়ে দেখলাম, ভোর ৫টা ২৯ মিনিট থেকে আরম্ভ করে সন্ধ্যা ৭টা পর্যন্ত উনি উনার স্ত্রীর সঙ্গে ১০ বার টেলিফোনে কথা বলেছেন এবং কী কথা বলেছেন সেসব কথার কিছু কিছু আমাদের কাছে আছে।

“তাদের (ফরহাদ ও ফরিদা) একটি কথোপকথনের শেষের দিকে তিনি স্ত্রীকে বলছেন, ‘এগুলো তো সব ভাইরাল হয়ে গেছে, ফেইসবুকে অপহরণের কথা সব ছড়াইয়া পড়ছে, বন্ধ কর, বন্ধ কর, ওরা আমাকে ছেড়ে দিবে, ওরা আমাকে এখনই ছেড়ে দিবে, অপহরণ-অপহরণ দরকার নেই, এসব বন্ধ করে দেও, দরকার নেই’।”

গত ৩ জুলাই ভোরে রাজধানীর শ্যামলীর বাড়ি থেকে ফরহাদ মজহার বেরিয়ে যাওয়ার পর তার ফোন থেকে অপহরণের খবর শুনে পুলিশে অভিযোগ করেছিলেন ফরিদা। ওই রাতেই যশোরে ঢাকাগামী একটি বাস থেকে তাকে উদ্ধার করে র‌্যাব-পুলিশ।

ফরহাদ মজহার আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে তিনি অপহৃত হয়েছিলেন বলে দাবি করেন। তবে তার ওই কথার সত্যতা নিয়ে সন্দেহ শুরু থেকেই করে আসছিল পুলিশ। এরপর তার মোবাইল ফোনের ‘কললিস্টের সূত্র ধরে’ এক নারীকে আদালতে আনে পুলিশ।

অর্চনা রানি নামে ওই নারী আদালতে জবানবন্দিতে বলেন, তার জন্য অর্থ জোগাড় করতে সেদিন বেরিয়েছিলেন ফরহাদ মজহার এবং তিনি টাকাও পাঠিয়েছিলেন।

এর মধ্যে খুলনার একটি সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ পায় পুলিশ; যাতে ফরহাদ মজহারকে সেদিন বিকালে খুলনা নিউ মার্কেটে একাকী ঘোরাফেরা করতে দেখা যায়।

বৃহস্পতিবার আরেকটি ভিডিও ফুটেজও দেখায় পুলিশ, যাতে ফরহাদ মজহারকে মোবাইল ব্যাংক এজেন্টের দোকানে দেখা যায়। 

ফরহাদ মজহারের জবানবন্দি নিয়ে সন্দেহ প্রকাশ করে আসা পুলিশ কর্মকর্তারা মোবাইল এজেন্টের দোকানে তার উপস্থিতি অর্চনা রানির বক্তব্যের পক্ষে প্রমাণ হিসেবে দেখছেন।

শহীদুল হক বলেন, নিরুদ্দেশ থাকা অবস্থায় আরেকটি নম্বরে ফরহাদ মজহার ছয়বার কথা বলেন এবং ওই নম্বর থেকে একটি এসএমএসও পান। তার সূত্র ধরেই তারা অর্চনা রানি নামে ওই নারীর সন্ধান পান।

“বুঝলাম স্ত্রীর সাথে কথা বলেছে মুক্তিপণের টাকা আদায় করার জন্য, কিন্তু অন্য এক ব্যক্তির সাথে যদি কথা বলে তাহলে পুলিশের সন্দেহ জাগে, এই ব্যক্তি নিশ্চয়ই অপহরণকারীর পক্ষের লোক। তদন্ত করে দেখলাম, ওই ব্যক্তি ঢাকার ভাটারা এলাকায় আছে। পরে দেখলাম, চট্টগ্রাম চলে গেছেন। সেখান থেকে খুঁজে বের করে দেখলাম, সেই ব্যক্তি একজন নারী।”

আইজিপি বলেন, “যেহেতু সেই নারী ঘটনায় সম্পৃক্ত হয়ে গেছে, তাই তার বক্তব্য নেওয়ার আইনগত বাধ্যবাধকতা আছে। আমরা তার বক্তব্য নিয়েছি এবং এই বক্তব্যকে আরও গ্রহণযোগ্য করার জন্য আমরা তাকে আদালতে নিয়েছি। আদালতে সেই নারী অকপটে সাক্ষ্য দিয়েছেন।”

যশোর থেকে ঢাকায় আনার পর ফরহাদ মজহার

জবানবন্দিতে অর্চনার ফরহাদ মজহারের সঙ্গে সম্পর্কের ফলে গর্ভধারণ করার বিষয়টি তুলে ধরে তিনি বলেন, “সেই জন্য এই নারী ফরহাদ মজহারের সঙ্গে আগের দিন (২ জুলাই) দীর্ঘক্ষণ কথা বলেছে। তাদের মধ্যে উদ্বেগ-উৎকণ্ঠা ছিল- কী করা যায়? কীভাবে টাকা লাগবে, পয়সা লাগবে, এসব নিয়ে তাদের কথা হয়।

“এই কথা শুনে ফরহাদ মজহার নিজেই উদ্বিগ্ন হয়ে গেছে। এসব কথা, তথ্য আমাদের (পুলিশ) কাছে আছে। সবকিছু আছে।”

ঘটনার দিন ওই নারীর সঙ্গে টেলিফোন আলাপেও ফরহাদ মজহার ‘ভালো আছেন’ বলে জানিয়েছিলেন বলে পুলিশ প্রধান দাবি করেন।

তিনি বলেন, “সন্ধ্যার পর এই মেয়েটিকে ১৫ হাজার টাকা পাঠিয়েছে। সব ধরনের তথ্য আমাদের কাছে আছে।”

জবানবন্দিতে ফরহাদ মজহার অপহরণকারীরা তাকে ছেড়ে দিয়ে বাসের টিকেট ধরিয়ে দেওয়ার যে কথা বলেছেন, তাও নাকচ করেন পুলিশ প্রধান।

“আমরা তথ্য প্রমাণ পেয়েছি যে উনি নিজে হানিফ পরিবহনের কাউন্টারে গিয়ে গফুর নাম দিয়ে টিকেট কিনেছেন এবং নিজের মোবাইল নম্বর দিয়েছেন। হানিফ কাউন্টারে থাকা সিসি টিভির ভিডিও ফুটেজও আছে।”

ফরহাদ মজহার যদি মিথ্যা বক্তব্য দেন, তাহলে কী ব্যবস্থা নেবেন- জানতে চাইলে আইজিপি বলেন, “উনি তো বুদ্ধিজীবী। আমরা খতিয়ে দেখছি, কোনো ব্যবস্থা নেওয়া যায় কি না?”

ফরহাদ মজহার কেন অপহরণের ঘটনা সাজাবেন- উত্তরে শহীদুল হক বলেন, “ফরহাদ মজহার উনার স্ত্রীকে বারবার বলেছেন, টাকা পেলে ছেড়ে দিবে, টাকা সংগ্রহ কর।

“ঘটনার পূর্বে তার আচরণ আর ঘটনার পরে তার আচরণ দেখলেই বোঝা যায়। ঘটনার পূর্বের ওই নারীর সঙ্গে কথোপকথনে উদ্বেগ ও উৎকণ্ঠা আর ঘটনার পর উনাকে ভালোবাসে সরকার বিরোধীরা।”

“ফরহাদ মজহারের ঘটনার পরের আচরণগুলো এবং রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দ যে ধরনের বক্তব্য দিয়েছে, এতে ধারণা হয় সরকারকে বিব্রত করা বা বিপাকে ফেলা আর কিছু টাকা হাতিয়ে নেওয়া। এছাড়া আর কোনো উদ্দেশ্য পাই না।”

ফরহাদ মজহারের অন্তর্ধান নিয়ে নিজেদের বক্তব্যের প্রমাণ হিসেবে ভিডিও ফুটেজগুলো সাংবাদিকদের দেখান পুলিশ প্রধান।  

বর্তমানে বারডেম হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ফরহাদ মজহার; তার স্ত্রী ফরিদা আখতার এই বিষয়গুলো নিয়ে কিছু বলতে না চাইলেও ডানপন্থি এই অধিকারকর্মীর সমর্থকরা এসবকে পুলিশের ‘নাটক’ বলছেন।  

এ বিষয়ে পুলিশ প্রধান সাংবাদিকের কাছে পাল্টা প্রশ্ন রেখে বলেন, “আপনারা বলেন, এটা কি অপহরণ হয়েছে বলে ধারণা হয়?

“একজন ব্যক্তিকে যদি সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চোখ বেঁধে রাখে, উনি কথা বলবেন বারবার, টাকা পাঠাবেন, কাউন্টারে যাবেন। এগুলো কি অবাস্তব?”