ত্রিপুরা পাড়ার শিশুদের ‘চিকিৎসা’ চলছিল ঝাড়ঁফুকে

সীতাকুণ্ডের দুর্গম ত্রিপুরা পাড়ার নিরুবালা ত্রিপুরার তিন সন্তানের গায়ে ফুসকুড়ি ও গায়ে জ্বর দেখা দেয় গত মাসের শেষের দিকে। তিন সন্তানের অবস্থার অবনতি হলেও পাড়ার বৈদ্যের ঝাড়ফুঁক ও তাবিজকবজেই তারা সেরে উঠবে বলে আশায় ছিলেন নিরুবালা।

চট্টগ্রাম ব্যুরোমোস্তফা ইউসুফ, বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 13 July 2017, 05:09 AM
Updated : 13 July 2017, 07:06 AM

এভাবে গত তিন সপ্তাহে পুরো ত্রিপুরা পাড়ার অধিকাংশ শিশু অজ্ঞাত এক অসুস্থতায় আক্রান্ত হয়। তা মৃত্যু পর্যন্ত গড়ালেও হাসপাতালে যাওয়ার মত সচেতন ছিলেন পাড়ার কেউ।

চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, রোগটি তারা এখনও শনাক্ত করতে পারেননি। তবে চারদিনে নয় শিশুর মৃত্যু এবং একই লক্ষণ নিয়ে আরও ৪৬ শিশুর অসুস্থ হয়ে পড়ার পেছনে অসচেতনতা, কুসংস্কার আর মারাত্মক অপুষ্টির ভূমিকা দেখতে পাচ্ছেন তারা।

চট্টগ্রামের সিভিল সার্জন আজিজুর রহমান সিদ্দিকী বলেন, “রোগটি কী তা আরও পরীক্ষা নিরীক্ষা করে বলা যাবে। তবে এই শিশুরা সবাই মারাত্মক অপুষ্টিতে ভুগছে। গতকাল হাসপাতালে আনার পর আমরা দেখতে পাচ্ছি এক দিনেই অনেকের চেহারায় প্রাণ ফিরতে শুরু করেছে।”   

বুধবার ৪৬ শিশুকে হাসপাতালে নিয়ে আসার পর নতুন করে কেউ আক্রান্ত হওয়ার খবর পাওয়া যায়নি। যারা হাসপাতালে আছে, তাদের অবস্থা এখন পর্যন্ত স্থিতিশীল বলে সিভিল সার্জন জানান।

অসুস্থ এই ৪৬ শিশুর মধ্যে ১২ জনকে চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে এবং বাকিদের ফৌজদারহাটের বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ট্রপিক্যাল অ্যান্ড ইনফেকশাস ডিজিজে (বিআইটিআইডি) চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। তাদের অধিকাংশের বয়স দুই থেকে দশ বছর, সবাই পাহাড়ের ক্ষুদ্র নৃগোষ্ঠীর সদস্য।

সীতাকুণ্ডের বারআউলিয়া সোনাইছড়ির যে পাড়ায় তারা থাকে, সেখানে অধিকাংশ মানুষের জীবন চলে জুমচাষ ও দৈনিক শ্রমের ভিত্তিতে। ত্রিপুরা পাড়ার শতাধিক শিশুর মধ্যে স্কুলে যায় হাতে গোণা কয়েকজন।

ওই পাড়ার বাসিন্দা নিরুবালা ত্রিপুরা ফৌজদারহাট বিআইটিআইডি হাসপাতালে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ২০ দিন আগে তার তিন সন্তান অসুস্থ হয়ে পড়ে। জ্বরের সাথে গায়ে ফুসকুড়ি দেখা দেয়, সেই সঙ্গে গত কয়েকদিন ধরে চলছিল বমি আর পায়খানা।

নিরুবালা ভেবেছিলেন ‘খারাপ বাতাস’ লেগেছে। তাই পাড়ার অন্যদের মতো তিনিও বৈদ্যের কাছে সন্তানদের‘চিকিৎসা’ করান। কিন্তু শনিবার পাড়ার অসুস্থ বাচ্চারা মারা যাওয়া শুরু করলে নিরুবালার মনেও ভয় ধরে।

এদিকে ত্রিপুরা পাড়ায় শিশুদের ‘অজ্ঞাত রোগে’ মৃত্যুর খবর পেয়ে চট্টগ্রাম থেকে চিকিৎসকদের একটি দল বুধবার সকালে সেখানে যান। অসুস্থ ৪৬টি শিশুকে তারা নিয়ে এসে ভর্তি করেন হাসপাতাল।

অসুস্থ ভাগ্নেকে নিয়ে বিআইটিআইডিতে আসা নন্দ কুমার ত্রিপুরা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “গত দুই দিন ধরে খারাপ অবস্থা আমার ভাগ্নের। বৈদ্য তাবিজ দিয়ে বলেছিল ভালো হয়ে যাবে। কিন্তু তা হয়নি।”

সিভিল সার্জন আজিজুর রহমান জানান, ঢাকা থেকে রোগতত্ত্ব, রোগ নিয়ন্ত্রণ ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের (আইইডিসিআর) বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ফারুক আহমেদ ভূইয়ার নেতৃত্বে পাঁচজন বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ফৌজদারহাটে এসে বুধবার রাত ৩টা থেকে কাজ শুরু করেছেন।  

“তারা অসুস্থ বাচ্চাদের পরীক্ষা করে দেখেছেন এবং অভিভাবকদের সঙ্গে কথা বলে পরিস্থিতি বোঝার চেষ্টা করছেন। পরীক্ষার জন্য রক্তের নমুনাও সংগ্রহ করা হয়েছে।”

এই বিশেষজ্ঞ দলের সদস্যরা বৃহস্পতিবার চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন ১২ শিশুকেও পরীক্ষা করে দেখবেন। পরে যাবেন সোনাইছড়ির ত্রিপুরা পাড়ায়।

ওই এলাকায় শিশুদের এ অসুস্থতার খবর প্রথম পান সীতাকুণ্ড উপজেলার স্বাস্থ্য ও পরিবার পরিকল্পনা কর্মকর্তা এস এম নুরুল করিম।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “একজন গ্রাম ডাক্তার, যাকে আমি প্রশিক্ষণ দিয়েছিলাম, সেই প্রথম আমাকে জানায়, ত্রিপুরা পাড়ায় এরকম চারজন শিশু মারা গেছে কয়েকদিনে।”

ওই খবরে ঘটনাস্থলে গিয়ে পরিস্থিতির ভয়াবহতা বুঝতে পারেন নুরুল করিম। সঙ্গে সঙ্গে বিষয়টি জানান সিভিল সার্জনকে।

বুধবার সিভিল সার্জনের সঙ্গে যে চিকিৎসক দলটি ত্রিপুরা পাড়ায় গিয়েছিল, তাদের মধ্যে স্বাস্থ্য বিভাগের চট্টগ্রাম বিভাগীয় পরিচালক এ এম মুজিবুল হকও ছিলেন।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “আমরা যখন গেলাম তখন তারা আমাদের কাছ থেকে মৃতদের ব্যাপারটি এড়িয়ে যাওয়ার চেষ্টা করছিল। আক্রান্তদের ঘরের ভেতর রেখে নানা ধরনের তাবিজকবজ আর বৈদ্য দিয়ে জিন ভূত তাড়ানোর মাধ্যমে তারা বাচ্চাদের সুস্থ করার চেষ্টায় ছিল।”

পরে তাদের পরিস্থিতির ভয়াবহতা সম্পর্কে বুঝিয়ে আক্রান্তদের হাসপাতালে নিতে রাজি করানো হয় বলে জানান তিনি।

ডা. মুজিবুল হক বলেন, প্রথমে জ্বর হওয়ার পর গ্ল্যান্ড ফুলে গিয়ে বমি হচ্ছিল ওই শিশুদের। যারা মারা গেছে, শেষের দিকে তারা প্রচণ্ড নিউমোনিয়ায় ভুগছিল।

শুরুতেই খবর পেলে আর পরিবারগুলো সচেতন থাকলে এভাবে নয়টি শিশুর মৃত্যু হত না বলে মনে করেন এই চিকিৎসক।

রোগ শনাক্ত না হওয়ায় এখন কীভাবে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে জানতে চাইলে সিভিল সার্জন বলেন, “উপসর্গের উপর ভিত্তি করে চিকিৎসা দেওয়া হচ্ছে। আপতত অ্যান্টিবায়েটিক দিচ্ছি। শ্বাসকষ্ট হলে অক্সিজেন দেওয়া হচ্ছে। আমরা প্রতিটি শিশুর জীবনরক্ষায় চেষ্টা করে যাচ্ছি।”

আপাতত ত্রিপুরা পাড়ার শিশুদের স্কুলে যেতে নিষেধ করা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, “যে ঘরের শিশু আক্রান্ত হচ্ছে সে ঘরের বয়স্ক কেউ এ রোগে আক্রান্ত হচ্ছে না। ফলে আমরা হিসেব মেলাতে পারছি না।”

এ অবস্থায় ঢাকা থেকে আসা বিশেষজ্ঞ দলের পরামর্শের ভিত্তিতেই পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে বলে সিভিল সার্জন জানান।