রামপাল: সরকারের ভাষ্য নিয়ে সন্দেহ আনু মুহাম্মদের

রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণ প্রকল্প নিয়ে ইউনেসকোর অবস্থান বদলের সরকারি বক্তব্যের বিষয়ে সন্দেহ প্রকাশ করেছেন তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব অধ্যাপক আনু মুহাম্মদ।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 7 July 2017, 05:24 PM
Updated : 7 July 2017, 05:29 PM

শুক্রবার দুপুরে রাজধানীর মুক্তিভবনে সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, “পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় তড়িঘড়ি করে, তাড়াহুড়া করে বিবৃতিটা দিয়েছে। সেই বিবৃতিতে তারা কোনো লবিংয়ের মাধ্যমে কোনো শব্দ ম্যানিপুলেট করতে পারে বলে আমার ধারণা।

“কিন্তু ইউনেসকোর যে পজিশন… কী কী কারণে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সুন্দরবনের জন্য ক্ষতিকর, এই পজিশনের কোনো পরিবর্তন হয় নাই। কারণ এটা হচ্ছে এমন একটা সায়েন্টিফিক এভিডেন্স, আরগুমেন্ট, যেটা পরিবর্তন হওয়ার কোনো সুযোগ নাই।”

পোল্যান্ডে ইউনেসকোর ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ কমিটির ৪১তম অধিবেশনে সুন্দরবনের পাশে নির্মাণাধীন এই বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে শুনানি হয়।

পরে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক বিবৃতিতে বলা হয়, দীর্ঘ আলোচনার পর হেরিটেজ কমিটি যথাযথ পদক্ষেপ নেওয়ার মাধ্যমে সুন্দরবনের উপর ক্ষতিকর প্রভাব এড়িয়ে বাংলাদেশ সরকার পরিকল্পিত স্থান রামপালে বিদ্যুৎ কেন্দ্র নির্মাণকে ‘অনুমোদন করেছে’।

বিশ্ব ঐতিহ্য (ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ) সুন্দরবনকে ঝুঁকিপূর্ণ প্রাকৃতিক নিদর্শনগুলোর তালিকায় যুক্ত করার যে প্রস্তাব এসেছিল তাও বাদ দেওয়া হয়েছে বলে জানায় মন্ত্রণালয়।

বাগেরহাটের রামপালে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনের কাছে ওই বিদ্যুৎকেন্দ্র নির্মাণের বিরোধিতায় তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটিসহ বিভিন্ন পরিবেশবাদী সংগঠনের মধ্যেই গতবছর  ইউনেসকো এক প্রতিবেদনে রামপাল প্রকল্প বাতিলের সুপারিশ করে।

সেই প্রসঙ্গ টেনে আনু মুহাম্মদ বলেন, ইউনেসকোর প্রতিনিধি দল সে সময় বাংলাদেশে এসে রামপাল এলাকা পরিদর্শন করে। তারা স্থানীয়দের সঙ্গেও কথা বলার চেষ্টা করেন।

“কিন্তু যারা সুন্দরবন রক্ষার জন্য কাজ করছে, আন্দোলন করছেন, সুন্দরবন কীভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে সেটা নিয়ে বিশেষজ্ঞ যাদের সুনির্দিষ্ট বক্তব্য ছিল, তাদের কারও সাথে সরকার দেখা করতে দেয়নি। সরকারের ধারণা ছিল এদের সাথে কথা বললে ইউনেসকো প্রভাবিত হবে। কিন্তু সায়েন্টিফিক এভিডেন্স সব জায়গায় একই রকম হয়।

“ইউনেসকো যখন সায়েন্টিফিক এভিডেন্স সংগ্রহ করেছে, ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ শুরু করেছে, আমাদের সাথে কথা না বলার পরও দেখা গেছে, তাদের ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ আমাদের বক্তব্যের সাথে মিলেছে। তারা সুনির্দিষ্টভাবে বলেছেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে সুন্দরবনের বিনাশ হবে, বিপর্যস্ত হবে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সেখানে রাখা যাবে না।”

আনু মুহাম্মদ বলেন, “রামপালে বিদ্যুৎকেন্দ্র হলে বায়ু দূষণ, পানি দূষণ, পরিবহন এবং জীববৈচিত্র্য ধ্বংসের কারণে সুন্দরবনের পুরো অঞ্চল কোনোভাবে রক্ষা করা যাবে না। তারপরে তারা এটাও লক্ষ্য করেছেন যে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের কারণে আরও যে সমস্ত অর্থনৈতিক-বাণিজ্যিক তৎপরতা ওখানে শুরু হচ্ছে কিংবা আরও প্রকল্প নেওয়া হচ্ছে, তার কারণে সুন্দরবনের বিপদটা আরও বাড়বে। সে কারণে রামপালের বিদ্যুৎকেন্দ্রটা ওখান থেকে সরাতে- এটাই ছিল ইউনেসকোর মূল অবস্থান।”

এবারের অধিবেশনে ইউনেসকোর সেই অবস্থানের পরিবর্তন হয়নি দাবি করে তিনি বলেন, সুন্দরবন রক্ষার কী কী পদক্ষেপ সরকার নিচ্ছে বা নেবে- তা নিয়ে একটি ‘অতিরঞ্জিত চিত্র’ এবারের অধিবেশনে উপস্থান করা হয়েছে।

“ইউনেসকোর এই অধিবেশনে সুনির্দিষ্টভাবে কী সিদ্ধান্ত হয়েছে, আমরা জানি না। কিন্তু এতটুকু পরিষ্কার বুঝতে পারি, ইউনেসকোর মূল অবস্থানটা অপরিবর্তিত আছে। তারা রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র সম্পর্কে আরও কিছু শর্ত সরকারকে দিয়েছে। তার মধ্যে বড় ধরনের একটি হল এনভায়রনমেন্টাল অ্যাসেসমেন্ট করা… পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বিবৃতিতে এসব তথ্য উল্লেখ করা হয়নি।”

আনু মুহাম্মদ বলেন, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে যে কয়লা ব্যবহার হবে, তা পোড়ানোই হবে। সেই কয়লা জাহাজে করে আনতে হবে। সেজন্য ড্রেজিংও করতে হবে। ইউনেসকো বলেছে, তাদের শর্তগুলো পূরণ করে এসব কাজ করতে হবে। কিন্তু সরকার শর্তের কথা ‘বাদ দিয়ে’ বলছে ‘ওই প্রকল্প করা যাবে’ এবং সেটিই সামনে আনছে।

“সরকার যেটা নিয়ে এখন বড় উল্লাস প্রকাশ করছে যে, রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্র নিয়ে আপত্তি প্রত্যাহার করেছে ইউনেসকো, এই কথাগুলো যদি সত্যও হয়, ইউনেসকো যতদিন পর্যন্ত আপত্তি করেছিল সরকারতো কারও কথা শোনে নাই।… এখন একটা ম্যানিপুলেশন করে, লবিং করে, ইউনেসকোর কোনো একটি শব্দের খেলা খেলে সরকার যদি এখানে একটি রাস্তা তৈরি করার চেষ্টা করে, সেটাতে ক্ষতি হবে কার?

“ইউনেসকোর কোনো একটি ব্যাপারে, ওখানে তো বড় ধরনের আমলা, যারা এসবে অভ্যস্ত, তারা ছিলেন; ওখানে শব্দের খেলা দিয়ে সরকার যদি তার স্পেসটা বের করে, সুন্দরবনবিনাশী রামপাল প্রকল্প নিয়ে অগ্রসর হয়, তাহলে ক্ষতিগ্রস্ত কে হবে?”

তেল-গ্যাস-খনিজ সম্পদ ও বিদ্যুৎ-বন্দর রক্ষা জাতীয় কমিটির সদস্য সচিব বলেন, ইউনেসকোর আপত্তি কিংবা অনাপত্তি যাই থাক, দেশের সম্পদ ও পরিবেশের স্বার্থে তাদের আন্দোলন চলবে।

“আমরা যে আন্দোলন করছি, এটাতো ইউনেসকোর অবস্থানের পরে শুরু হয় নাই। এটা আমাদের নিজস্ব অবস্থান থেকে শুরু হয়েছে।… এখানে আমরা এবং আন্তর্জাতিকভাবে কাজ করা বিশেষজ্ঞরা যথষ্ট উদ্বিগ্ন। সুতরাং ইউনেসকো ওই আপত্তি প্রত্যাহার যদি করেও থাকে, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের বক্তব্য যদি সত্যও হয়, লবিংয়ের কারণে বা কোনো না কোনো প্রভাবের কারণে ইউনেসকো যদি বনধ্বংসী কাজের ‍সুযোগ দিয়ে থাকে, বাংলাদেশের মানুষতো এই আপত্তি প্রত্যাহার করতে পারে না।”

ইউনেসকোর শুনানি নিয়ে সরকারের ‘এই খুশি’ বাংলাদেশের জন্য ‘বড় ট্রাজেডি’ বলে মন্তব্য করেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির আনু মুহাম্মদ।

তিনি বলেন, “বন ধ্বংস করে এত বড় দেশধ্বংসী প্রকল্প করার জন্য জনগণের টাকা খরচ করে দেন দরবার কারছে, লবিং করছে, বারবার লোক পাঠাচ্ছে। তাদের পেছনে কতো টাকা খরচ হচ্ছে, সেটাও আমাদের হিসাব করা দরকার।”

ইউনেসকো যদি রামপাল নিয়ে তাদের অবস্থান বদলে থাকে, তাহলে আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান হিসাবে তারা ‘দায়িত্বপালনে ব্যর্থতার পরিচয় দিয়েছে’ বলেও মন্তব্য করেছেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির এই শিক্ষক।

“এটা যদি নেয়, তাহলে ইউনেসকো লবিংয়ের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। এটা যদি নেয়, তাহলে বলতে হবে, ইউনেসকো তার বৈজ্ঞানিক অবস্থান থেকে সরে এসে কোনো না কোনো প্রভাবের কারণে বাংলাদেশের কিছু গোষ্ঠী স্বার্থের কাছে আত্মসমর্পণ করেছে। এটা যদি হয়, তাহলে সেটা কেবল বাংলাদেশ নয়, সারা পৃথিবীর জন্য দুর্ভাগ্যজনক।”

‘আন্দোলন চলবে’

রামপালে কয়লাভিত্তিক বিদুৎ কেন্দ্রের বিরোধিতায় সুন্দরবন ‘রক্ষার আন্দোলন’ অব্যাহত থাকবে বলে জানিয়েছে সুন্দরবন রক্ষা জাতীয় কমিটি।

শুক্রবার রাতে কমিটির সদস্য সচিব মো. আব্দুল মতিন স্বাক্ষরিত এক বিবৃতিতে বলা হয়, “রামপাল কয়লা বিদ্যুৎ প্রকল্প নিয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নামে একটি বিবৃতি প্রচার করা হচ্ছে। আমাদের জানা মতে ইউনেসকোর সিদ্ধান্ত পরিবর্তন বিষয়ক চূড়ান্ত প্রস্তাব এখনও ঘোষিত হয়নি।

“আমরা জেনেছি, এ প্রকল্পে যে ব্যাপক বায়ুদূষণ, পানি দূষণ, কয়লা পরিবহন ও ড্রেজিংজনিত ঝুঁকি রয়েছে তা ইউনেসকো গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করছে। ইউনেসকোর বৈজ্ঞানিক সমীক্ষা মোটেও ভুল বা অপ্রয়োজনীয় বলে বাতিল হয়নি।”

সুন্দরবনের নদী ড্রেজিংয়ের আগে পুঙ্খানুপূঙ্খভাবে পরিবেশগত সমীক্ষা নিশ্চিত করার দাবি জানিয়ে বিবৃতিতে বলা হয়, “সরকারের ব্যাপক লবিংয়ের মুখে ইউনেসকোর মূল কমিটিতে রাজনৈতিক বিবেচনা কিছুটা প্রাধান্য পেলেও বন বিষয়ে বিশ্ব সংস্থার সঠিক বৈজ্ঞানিক মূল্যায়ন কোনো অংশেই ম্লান হয়নি।... সরকারকে এ স্থান থেকে শেষ পর্যন্ত ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্র সরাতেই হবে।