ফরহাদ মজহারের ‘উদ্ধারপর্ব’ বাসযাত্রীর বর্ণনায়

খুলনা থেকে হানিফ এন্টারপ্রাইজের বাসটি যশোরের নওয়াপাড়ায় এসে হঠাৎ থেমে গেল, তার আধা ঘণ্টার বেশি সময় পর র‌্যাব-পুলিশের গাড়ি এসে থামল, পেছনের একটি সিট থেকে নামিয়ে আনল ফরহাদ মজহারকে- বলছিলেন বাসটির যাত্রী শাহরিয়ার পলক।

প্রমিতি প্রভা চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 4 July 2017, 12:54 PM
Updated : 9 July 2017, 11:21 AM

সোমবার ভোরে ঢাকা থেকে নিখোঁজ হওয়ার পর মধ্যরাতে হানিফ এন্টারপ্রাইজের যে বাস থেকে ফরহাদ মজহারকে উদ্ধার করা হয়, তাতে খুলনা থেকে উঠেছিলেন চিত্রনির্মাতা শাহরিয়ার।

ডানপন্থি অধিকারকর্মী হিসেবে পরিচিত কবি ও প্রাবন্ধিক ফরহাদ মজহারের অন্তর্ধান এবং নাটকীয়ভাবে যশোরে হদিস মেলা নিয়ে আলোচনার মধ্যে ঘটনার বর্ণনা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে দেন শাহরিয়ার।

তিনি বলেন, “আমি খুলনা থেকে ঢাকা আসছিলাম। হানিফের এসি বাস। বাস ছাড়ার সময় ছিল ৯টা ১৫ মিনিট।”

খুলনা শহরে দুটি স্থানে হানিফ  এন্টারপ্রাইজের কাউন্টার রয়েছে। শাহরিয়ার ওঠেন শিববাড়ি মোড় থেকে। রয়্যাল হোটেল মোড় থেকে বাস ছাড়ে।

শাহরিয়ার বলেন, “আমি শিববাড়ি মোড় থেকে যখন উঠি, তখন উনাকে (ফরহাদ মজহার) দেখিনি। ধারণা করছি, তিনি আগের স্টপেজ থেকেই উঠেছিলেন।”

সোমবার উদ্ধারের পর পুলিশ ও র‌্যাব কর্মকর্তারা বলছিলেন, ফরহাদ মজহার শিববাড়ি মোড় থেকে বাসটিতে ওঠেন বলে তারা ধারণা করছেন।

যশোরের পুলিশ সুপার আনিসুর রহমান মঙ্গলবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ফরহাদ মজহার খুলনার শিববাড়ি কাউন্টার থেকে নিজেই বাসের টিকিট কেটে খুলনা থেকে ঢাকা যাচ্ছিলেন।

এই টিকেটটিই ফরহাদ মজহার কিনেছিলেন বলে দাবি হানিফ এন্টারপ্রাইজের

শিববাড়িতে হানিফ এন্টারপ্রাইজের কাউন্টার ব্যবস্থাপক নাজমুস সাদাতও একই কথা বলেন।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তিনি ‘মিস্টার গফুর’ নামে টিকেট কাটেন। সোয়া ৯টার দিকে কোচটি রয়্যাল মোড় ছেড়ে আসে। এখানে আসতে ৫ মিনিট সময় লাগে। এখান থেকে ফরহাদ মজহার গাড়িতে ওঠেন।”

টিকেট বিক্রির সময় ফরহাদ মজহারকে চেনেননি বলে জানান নাজমুস। তিনি বলেন, র‌্যাব সদস্যরা ছবি দেখানোর পর তিনি চিনতে পারেন।

তার আগে রাত ৮টার দিকে নিজের রেস্তোরাঁয় ফরহাদ মজহারকে দেখার দাবি করেছিলেন খুলনা নিউ মার্কেট এলাকার ‘নিউ গ্রীল হাউস’র মালিক আব্দুল মান্নান, যা তিনি র‌্যাবকে জানান।

খুলনার এই রেস্তোরাঁয় ফরহাদ মজহারকে দেখা গেছে বলে দাবি করেছেন এর মালিক আব্দুল মান্নান

র‌্যাব কর্মকর্তা খন্দকার রফিকুল ইসলাম সাংবাদিকদের বলেন, “গ্রীল হাউজের ওখানে তিনি খেয়েছেন, এ তথ্য পাওয়ার পর আমাদের মাথায় আসে উনি হয়ত ঢাকায় যেতে পারেন। পরে আমরা খোঁজখবর করে তাকে ফলো করে নওয়াপাড়ায় এসে তাকে পাই।”

বাসে সামনের দিকে ‘ডি-১’ সিটে ছিলেন শাহরিয়ার। ফরহাদ মজহারকে একদম পেছনের সিট থেকে র‌্যাব-পুলিশ নিয়ে আসে বলে জানান তিনি।

“রাত তখন পৌনে ১১টা, বাস থামিয়ে দিল নওয়াপাড়ায়। সুপারভাইজর বলল, ‘যাত্রী ফেলে এসেছি, ওয়েট করতে হবে’। তবে ড্রাইভারকে কিছুটা কনফিউজড মনে হচ্ছিল। ৪০ মিনিট যাওয়ার পর যাত্রীদের মধ্যে অস্থিরতা শুরু হল। তখন সুপারভাইজর বলল, উনি কিছু জানেন না, অর্ডার দেওয়া হয়েছে থামাতে।

“এর কিছুক্ষণ পর কয়েকটি গাড়ি আসল। কমপক্ষে দুইটা, একটা র‌্যাবের, একটা পুলিশের। বেশিরভাগই ছিল সাদা পোশাকে। ৭/৮ জন বাসে উঠে সার্চ শুরু করল। লাস্ট সিটে পাওয়া গেলে উনাকে।”

ফরহাদ মজহারকে র‌্যাব-পুলিশ ঘুম থেকে উঠিয়েছিল বলে দেখে মনে হয়েছিল শাহরিয়ারের।  

“উনি সম্ভবত ঘুমিয়ে ছিলেন। উনাকে নামানোর পর আশপাশের যাত্রীদের জিজ্ঞাস করল, উনার সঙ্গে আর কেউ আছেন কি না।”

কারও সাড়া না পেয়ে ফরহাদ মজহারকে নিয়ে র‌্যাব-পুলিশের দলটি বাস থেকে নেমে যায় বলে জানান শাহরিয়ার।

তিনি বলেন, “উনার সঙ্গে তারা (র‌্যাব-পুলিশ) খুব ভালো ব্যবহার করেছে। (নামার পর) আমি যতদূর দেখলাম, উনারা একটু কনফিউজড ছিলেন যে ফরহাদ মজহার কোন গাড়িতে যাবেন। র‌্যাবের, নাকি পুলিশের গাড়িতে।”

ফরহাদ মজহারের পরনে তখন সাদা পাঞ্জাবি, নীল চেকের লুঙ্গি এবং  মাথায় পাগড়ির মতো সাদা কাপড় প্যাঁচানো ছিল জানান শাহরিয়ার।

“উনি একটা কাপড়ের ব্যাগও ক্যারি করছিলেন।” 

মঙ্গলবার ফরহাদ মজহারকে ঢাকায় আনার পর তার একই পোশাকই দেখা গেছে।

নীল চেকের লুঙ্গি ও সাদা পাঞ্জাবি পরা ফরহাদ মজহার ঢাকায় পুলিশ হেফাজতে, এই পোশাকেই তাকে যশোরে দেখার কথা জানান বাসে তার সহযাত্রী শাহরিয়ার পলক

খোঁজ না পাওয়ার ফরহাদ মজহারের পরিবার অপহরণের অভিযোগ করেছিল। ফরহাদ মজহার ফোন করে অপহরণের কথা জানিয়ে মুক্তিপণের বিষয়ে কথাও বলেছিলেন বলে জানিয়েছিলেন তার স্ত্রী ফরিদা আখতার।

তবে উদ্ধারের পর পুলিশের খুলনা রেঞ্জের ডিআইজি দিদার আহম্মেদ এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, ফরহাদ মজহারকে অপহৃত হয়েছিলেন বলে কোনো ইঙ্গিত তারা পাননি। হয়ত ফরহাদ মজহার নিজেই ঘটনা সাজিয়েছিলেন।

“একজন সুস্থ মানুষ যেভাবে জার্নি করে, সেভাবেই তিনি ছিলেন। তার সঙ্গে একটি ব্যাগ ছিল, গেঞ্জি ছিল। কিছু টাকাও ছিল। এমনকি মোবাইল চার্জার নিতেও ভোলেননি তিনি।”

অন্যদিকে বিএনপি অভিযোগ তুলেছে, ফরহাদ মজহারকে সরকারি কোনো সংস্থাই ধরে নিয়ে এই নাটক করেছে।

পুরো ঘটনা দেখে নাটক মনে হয়েছে কি না- প্রশ্ন করা হলে চিত্রনির্মাতা শাহরিয়ার বলেন, “নো কমেন্টস। একজন যাত্রী হিসেবে যা দেখেছি, তাই বল্লাম।”