দিন যায় অন্যের মালা গেঁথে, তবু ঈদ আসে না অভাবে

সন্তানকে কোলে নিয়েই সুতোয় একের পর এক ফুল জুড়ে মালা গাঁথছিলেন মুক্তা, অন্যের সৌন্দর্য্যের চাহিদা মেটাতে যার এত ব্যস্ততা, অভাবে ঈদের আনন্দও তাকে ছোঁয় না।

কাজী নাফিয়া রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 June 2017, 02:59 PM
Updated : 25 June 2017, 07:00 PM

শুধু মুক্তা নন, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকার সড়ক দ্বীপে দীর্ঘদিন ধরে মালা বিক্রি করে আসা ছিন্নমূলদের বাস্তবতা এমনই।শুধু দুবেলা খাবার জোগাড়ে আয়-ব্যয়ের হিসাবে ব্যস্ত এসব পরিবারে আনন্দের উপলক্ষ আর আসে না।

স্বজনদের সঙ্গে ঈদ করতে ছোট-বড় চাকরে, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী থেকে শিল্পপতি-সব ধরনের লাখ লাখ মানুষ গ্রামে ছুটলেও সেই ভাবনা তাড়া করেনি এদের। ঈদের নতুন পোশাকে ঘুরতে আসা আনন্দোচ্ছ্বল নারী-পুরুষের কাছে মালা বিক্রি করে সেই টাকা দিয়ে গ্রামে যাওয়ার চিন্তা করছেন কেউ কেউ, আবার কারও হিসাব ঈদের পরে গেলে তো খরচটা কমবে।   

গত এক দশক ধরে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি এলাকায় মালা বানানোর ঘর-বসতি চলছে মুক্তার, ৩২ বছর বয়সী এই নারীর সঙ্গী এখন তিন সন্তান।

মুক্তা মালা গেঁথে দেন, আর তা টিএসসিতে বিক্রি করে তার ছোট্ট ছেলে। সে আয় দিয়ে কোনো রকমে টেনেটুনে চলে সংসার। স্বামী আগে রিকশা চালালেও অসুস্থতার জন্য এখন বেকার, সংসারের পুরো ভার নিয়ে তাই মালা গেঁথে কেবল টিকে থাকার সংগ্রাম মুক্তার।

এক বালতি ফুল ৫০ টাকা দিয়ে কিনে মালা বানিয়ে দিনে সর্বোচ্চ ৩০০ থেকে ৩৫০ টাকা বিক্রি করা যায় বলে জানান মুক্তা।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পাঁচজন মানুষের খাইতেই তো সব খরচ হয়ে যায়। এমনি সময় তাও আপা বিক্রি হয় ভালোই। কিন্তু রোজায় বিক্রি নাই, ২০০ টাকার বিক্রি হয় কোন রকমে।”

মুক্তা সড়ক দ্বীপেই মালা গাঁথেন, তার মালা বিক্রিও হয় ওই এলাকায়। যখন যে ফুল পান, সে ফুল দিয়েই মালা তৈরি করেন তিনি। ৫ থেকে ১০ টাকায় বিক্রি হয় একেকটি মালা।

অন্যান্য ঈদে অবস্থাসম্পন্ন আত্মীয়দের কাছ থেকে কিছুটা সাহায্য পেলেও এবার তা না মেলায় নিরানন্দ ঈদ কাটবে বলে জানান মুক্তা।

“এখন পর্যন্ত বাচ্চাদের জন্যও কিছু কিনতে পারি নাই। যেই টাকা ইনকাম হয়, সেইটা দিয়ে তো একবেলা খাইলে আরেক বেলা না খাইতে হয় রে বইন। কাপড় কিনবো কী দিয়া?”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র-ছাত্রীদের কেউ কেউ এর আগের বিভিন্ন ঈদে সহায়তা করলেও এবার তা হয়নি বলে জানান মুক্তা। একটি সংগঠনের পক্ষ থেকে ঈদ উপহার দিলেও তা এত ছোট যে তার ছেলে-মেয়েদের কেউ পরতে পারবে না।  

“ছোট মাইয়ার বয়স ১৩ মাস, জামাটা ৬ মাসের বাচ্চার হইবো। আর কেউ যদি দেয় তাইলে বাচ্চাগো জামা হইব, নয়তো পুরান কাপড়েই ঈদ করব ওরা।”

তেজগাঁওয়ের উত্তর বেগুনবাড়িতে মুক্তার বাসা, কিন্তু টিএসসিতেই অধিকাংশ সময় থাকেন তিনি। টিএসসির বারান্দায়ই সন্তানদের নিয়ে রাতে ঘুমান মুক্তা।

“সপ্তাহে একদিন যাই। ৭-৮ দিনে কিছু টাকা হইলে, তারপর যাই। টিএসসিতে থাকলে তো মালা বিক্রি হইব, ওইখানে গেলে তো হইব না।”

অর্থাভাব ঘুচাতে ঈদে অতিরিক্ত বিক্রির আশায় থাকা মুক্তা বলেন, “ঈদের দিন তো অনেক মানুষ বেড়াতে আসব। তখন বিক্রি বেশি হইলে, কিছু টাকা পাইলে, ঈদের দুই দিন পর বাড়িতে যামু।”

যশোরে শ্বশুরবাড়ি যাবেন বলে জানান তিনি।

মুক্তার পাশেই মালা গাঁথছিলেন হনুফা, ১৭ বছর ধরে এই এলাকায় মালা বিক্রি করছেন তিনি।

চলিশোর্ধ্ব এই নারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, স্বামী রিকশা চালিয়ে যে টাকা আয় করেন, তা দিয়ে পাঁচ সন্তানকে নিয়ে চলতে না পেরেই মালা বিক্রি করেন তিনি। বড় ছেলে শরবতের দোকানে কাজ করলেও রোজায় তা বন্ধ থাকায় সংসার চালাতে হিমশিম খাচ্ছেন। তার গেঁথে দেওয়া মালা বিক্রি করে অন্য দুই ছেলে।

“পোলাপাইন মানুষ তো, অনেক সময় দেখা যায় বালতি রাইখ্যা খেলা শুরু করে দিছে। ঠিকমতো বেঁচলে ৩০০ থেকে ৪০০ টাকার বিক্রি হয়, কিন্তু রোজায় ১০০-২০০ টাকার বিক্রি হইতাছে।”

ঈদে সন্তানদের নতুন জামা কিনে দিয়েছেন কি না জানতে চাইলে হনুফা বলেন, “আজকে দেখি কিছু কিনতে পারি কি না, ওরা তো ছোট। ওগো তো নতুন কাপড় পরতে ইচ্ছা করে।”

হনুফার বাড়ি কিশোরগঞ্জের ভৈরবে। ঈদের পর ভাড়া কম লাগবে বলেই তখন বাড়িতে যাবেন বলে জানান তিনি।

“ঈদে গেলে তো ভাড়া বেশি। ঈদের দুই-তিন দিন পরে গেলে ভাড়াও কম, আবার ঈদে বিক্রি কইরা টাকাও আসবো কিছু। তাই ঈদের পরেই যামু।”

টিএসসিতে শুধু মুক্তা বা হনুফা নয়, মালা বানিয়ে বিক্রি করেন বিউটি, রনি, আয়শা, সালমা, রুমির মতো আরও অনেক শিশু। এদের অধিকাংশেরই নতুন জামা হয়নি এই ঈদে।