আনন্দে-সংকোচে ঈদ আসে ওদেরও ঘরে

ওদেরও বাবা-মা, ভাই-বোন আর আত্মীয়-পরিজন রয়েছে। সমাজের আর দশজন মানুষের মতো ওদেরও আছে হাসি-কান্না, সুখ-দুঃখ। কিন্তু তারপরও ঈদ এলে কোথায় যেন একটা শূন্যতা ভর করে। সাধারণের বাঁকা চাহনিতে ফিরতে পারে না পরিবারের কাছে। বাধ্য হয়েই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষগুলোকে নিজেদের মধ্যে ভাগাভাগি করতে হয় ঈদের আনন্দ।

কাজী নাফিয়া রহমানবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 June 2017, 01:53 PM
Updated : 26 June 2017, 06:25 PM

রাজধানীর তেজগাঁও ও মগবাজার এলাকার হিজড়ারা জানালেন, ঈদে নিজেরাই নিজেদের উপহার কিনে দেন। কেউ কেউ এ সময়টাতে পরিবারের কাছে ফিরতে পারলেও অনেকের সেই আনন্দ ফিকে হয়ে যায় প্রতিবেশীদের বক্র চাহনিতে। যন্ত্রণা এড়াতে তারা থেকে যান ঢাকাতেই।

তৃতীয় লিঙ্গের মর‌্যাদা দেওয়া হলেও এখনো সমাজে অবহেলিত এই মানুষরা ঢাকায় থাকেন ‘যৌথ আস্তানা’ করে। একজন ‘গুরু মা’ এর অধীনে বেশ কয়েকজন শিষ্য মিলে তাদের বসবাস রাজধানীর বিভিন্ন এলাকায়।

রাজধানীর তেজগাঁওয়ের পূর্ব তেজকুনিপাড়ার ফকিন্নী বাজারে এমন এক আস্তানার ‘গুরু মা’ ছলনা। ৩৫ জন শিষ্যকে নিয়ে তার নিজস্ব ভুবন, কিন্তু ঈদ এলে পরিবারে ফিরে যেতে ভোলেন না কখনই। প্রতি বছরই রোজার ঈদে গ্রামের বাড়ি বগুড়ায় যান বাবা-মা, ভাই-বোনের সাথে ঈদ করতে।

কিন্তু এবারের ঈদ এসেছে তার সামনে দুই দুর্গতি নিয়ে। বাসা ছাড়ার তাড়ার সঙ্গে যোগ হয়েছে নিজের জমানো সম্বল চুরি যাওয়া। এই চাপ নিয়ে অন্য শিষ্যদের সামান্য ঈদ উপহার দিয়ে বিদায় করলেও নিজে এবার বাড়ি যাচ্ছেন না, কেনাকাটায়ও টেনেছেন লাগাম।

ছলনা বলেন, “টাকা নাই হাতে, মনডা খারাপ; শেষের দুইটা রোজাও ভেঙে ফেলছি। ভাই-বোন, মা-বাবার জন্য কেনাকাটা ছাড়া বাড়িতে যাওয়ার ইচ্ছাও নাই। নিজের জন্যও কিছু কিনি নাই।”

নিজের জন্য কিছু না কিনলেও চুরির ধাক্কা সামলে শিষ্যদের সবাইকে সামর্থ্য অনুযায়ী প্রতিবারের মতো এবারও উপহার দিয়েছেন। নিজেও শিষ্যদের কাছ থেকে পেয়েছেন শাড়ি, থ্রি-পিসসহ নানা উপহার।

“আমার শিষ্যরা তো আমার সন্তান। আমিই ওদের বাবা, আবার আমিই ওদের মা। বাপ-মায়ের কষ্ট থাকলেও সন্তানদের তো কষ্টে রাখা যায় না।”

আরও এক কারণে এবারের ঈদ ফিকে হয়ে গেছে ছলনার। ফকিন্নি বাজারে ফ্লাইওভারের নীচে সরকারি জায়গায় এতদিন সাত হাজার টাকায় ৮-১০ জন শিষ্য নিয়ে থাকতেন তিনি। সেই বাসা ভেঙে ফেলার তোড়জোড় শুরু হওয়ায় অন্য শিষ্যদের মাধ্যমে কাঁঠালবাগানে নতুন বাসা ঠিক করেছেন, যেখানে ভাড়া বেড়ে খরচ পড়বে ১৪ হাজার টাকা।

নিজেদের পুনর্বাসনের দাবি জানিয়ে ছলনা বলেন, “সরকার তো চাইলে সবই পারে। কতবার তো প্রেস ক্লাবে আন্দোলন করলাম, সরকার যাতে আমাদের জন্য কোনো ব্যবস্থা করে। কিন্তু কই? কিছুই তো হল না।”

অনেকেই হিজড়াদের বাসা ভাড়া দিতে চায় না জানিয়ে তিনি বলেন, “আমরা তো মানুষের কাছে চেয়ে চলি। যে টাকা পাই তা দিয়ে তো চলা মুশকিল। তার উপর এত টাকা বাড়ি ভাড়া, সরকার থাকার একটা জায়গা দিলেও অনেক উপকার হত।”

৪২ বছর বয়সী ছলনার মন ছুঁয়েছে বাড়ি না ফেরায় তার মায়ের মন খারাপের অনুভূতিও।

“মায়ের মন তো....সে তার সন্তানকে তো কাছে চাইবেই। টাকা-পয়সা নাই তো কী হইছে? চলে যেতে বলছে মা।”

এর আগে বাড়ি গিয়ে কেমন লেগেছে জানতে চাইতেই তিনি শোনালেন আনন্দ আর বিদ্রুপের স্মৃতি।

“মেয়ে মায়ের বাড়িতে গেলে যেমন আচরণ করে, বাবা-মা, ভাই-বোনেরা তেমনই করে। অনেক মায়া করে, আশপাশের মানুষও আদর করে। যারা আমাকে চেনে, তারা হিজড়া বলে বিদ্রুপ করে না আর। যারা চেনে না তারা তো হাসি-ঠাট্টা করবেই। আমাদের জীবনটাই তো হাসি-তামাশার।”

ফকিন্নি বাজারে ছলনারই এক শিষ্য তমা ঈদ করবেন বাবার বাড়ি নারায়ণগঞ্জে। বাবা-মার ‘সম্মান বাঁচাতে’ ঘর ছাড়লেও ঈদ আসে তার কাছে পুনর্মিলনের আনন্দ নিয়ে।

শনিবার তমা বলেন, “একটু পরেই চলে যাবে বাড়িতে। বছরে তো এই এক-দুইবারই যাওয়া হয়। আমরা হিজড়া বলেই তো নিজের পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন। আমাদের কি বাবা-মা, ভাই-বোনের সাথে থাকতে ইচ্ছা করে না? কিন্তু আমার কারণে তারা যাতে ছোট না হয়, মানুষের কাছে কথা না শুনে, সেজন্য তো ওদের ছেড়ে চলে আসছি। আমার জন্য আমার মা-বাবা কথা শুনবে কেন? এর চেয়ে আমিই দূরে থাকি।”

বাবা-মা, ভাই-বোনের জন্য ঈদের নতুন জামা কিনেছেন বলে জানান তমা। 

“মাকে তো খুব দেখতে ইচ্ছা করে। একসাথে তো থাকতে পারি না, বছরে একটাবারই কয়েকদিনের জন্য পরিবারের সাথে থাকা। সব সন্তানই মায়ের সাথে থাকতে চায়। মার সাথে থাকতে পারাটাই তো ঈদ।”

মগবাজারের পেয়ারাবাগে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষদের আরেকটি আস্তানার ‘গুরু মা’ নিশাত। গ্রামের বাড়ি মুন্সীগঞ্জে বাবা-মা, ভাই-বোন থাকলেও সামাজিক ‘তিরস্কার’ এড়াতে ঢাকায়ই ঈদ করবেন তিনি।

“বাড়িতে যাব না, ঢাকাতেই থাকব শিষ্যদের সাথে। বাড়িতে গেলে কে কীভাবে নেয়, আমরা তো আর দশটা মানুষের মতো না।”

ঈদে নিজের জন্য নতুন সালোয়ার-কামিজ কিনেছেন নিশাত।

ঈদের দিন কীভাবে কাটাবেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “ঈদের দিন বাসাতেই থাকব। ভালো লাগলে বাইরে ঘুরতে যাব। শিষ্যরা আছে, ওরাই তো এখন আমাদের আপনজন। যাদের সাথে রক্তের সম্পর্ক...অনেক আগেই তো তাদের ছেড়ে চলে আসছি।”

বড় মগবাজারে আরেকটি ‘আস্তানায়’ থাকেন রাত্রি। অনেক দিন ধরেই ভুগছেন শ্বাসকষ্টসহ নানা রোগে। অসুস্থতার কারণে আর অর্থাভাবে ঈদে কোনো কেনাকাটাই হয়নি বলে জানান তিনি।

আক্ষেপ নিয়ে রাত্রি বলেন, “আমাদের আবার ঈদ! ঈদে একটা সুতাও কিনি নাই। অসুস্থতার জন্য তো কালেকশনেও বের হইতে পারি না। যে টাকা পাই, তা দিয়ে চলাটা তো সম্ভব না। ওষুধ কেনারই টাকা থাকে না। খুব কষ্ট করে চলতে হয়।”

কুমিল্লার রাত্রি ঈদ করবেন ঢাকাতেই।