পরমাত্মায় জীবাত্মার মিলনকে ‘চিরমুক্তি’ বলে বিশ্বাস করে হিন্দুরা, সেই পারলৌকিক মুক্তি কামনায় ভগবানের কৃপা প্রার্থণা করে রথযাত্রার অনুষ্ঠান পালন করছে তারা।
রোববার আষাঢ় মাসের শুক্লা দ্বিতীয়া তিথিতে শুরু হল এ উৎসব, আর একাদশী তিথিতে হবে প্রত্যাবর্তন; অর্থাৎ রথটি প্রথম দিন যেখান থেকে টেনে নিয়ে যাওয়া হয়, আটদিন পরে আবার সেখানেই ফিরিয়ে আনা হয়। একে বলে ‘উল্টো রথ’।
মানভঞ্জনের পর শ্রীকৃষ্ণের বৃন্দাবন ফেরার তিথিকে হিন্দুরা রথযাত্রা উৎসব হিসেবে উদযাপন করে।
সারা দেশের মতো রাজধানীতেও নানা স্থানে উদযাপিত হয়েছে রথযাত্রা উৎসব। প্রধান রথযাত্রাটি অনুষ্ঠিত হয় স্বামীবাগের আন্তর্জাতিক কৃষ্ণ ভাবনামৃত সংঘে (ইসকন)। সকাল ৮টা থেকে শুরু হয় রথযাত্রার মূল আচার-অনুষ্ঠান।
ইসকনের অধ্যক্ষ চারুচন্দ্র দাস ব্রহ্মচারী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আজকের এই রথযাত্রায় আমরা ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে জগতের সকল প্রাণীর কল্যাণ কামনা করব। বিশ্বশান্তির জন্য ভক্তরা আজ সম্মিলিত প্রার্থণায় ভগবান জগন্নাথের আরাধনা করছেন। আমরা চাইছি, সাম্প্রদায়িক শক্তিও চেতনার বিনাশ হোক, এ জগৎ যেন সকলের জন্য সুখকর হয়।”
রাশেদ খান মেনন বলেন, “অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয়ে আমরা বাংলাদেশ স্বাধীন করেছিলাম। আজ বলা হচ্ছে, হিন্দুরা নানা অত্যাচারের শিকার হয়ে দেশান্তরী হচ্ছে। আমি সব গণতান্ত্রিক শক্তির পক্ষ থেকে আপনাদের আশ্বস্ত করতে চাই, এ দেশটি যেমন আমার, তেমন আপনারও। রাষ্ট্র সবাইকে এ দেশে বাস করার সমান অধিকার দিচ্ছে। আসুন সকলে মিলে আমরা অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের পথ মসৃণ করি।”
বাংলাদেশে সাম্প্রদায়িক শক্তি যেন কখনও মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে না পারে সেদিকে সকলকে সতর্ক থাকার আহ্বান জানান খাদ্যমন্ত্রী কামরুল ইসলাম।
তিনি বলেন, “বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর সাম্প্রদায়িক দুষ্টগ্রহ রাষ্ট্রক্ষমতায় এসে বাঙালিদের মধ্যে সাম্প্রদায়িক বিভেদ সৃষ্টি করেছিল। তবে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর সেই অসাম্প্রদায়িক চেতনার অটুট বন্ধন পুনরুজ্জীবিত হয়েছে। আমরা বিশ্বাস করি, প্রতিটি ধর্মই সম্প্রীতির কথা বলে। এখানে ধর্ম যার যার উৎসব সবার।”
সংখ্যালঘুদের দেশত্যাগের বিষয়ে তিনি বলেন, “আমাদের উপর অনেক অত্যাচার নিপীড়ন হয়েছে, আমরা দেশ ছেড়ে যাইনি। আমরা দুই হাত দিয়ে লড়াই করেছি। আপনারা এই দুই হাত দিয়ে নিজেদের অধিকারের জন্য অশুভ শক্তির বিরুদ্ধে লড়াই করুন।”
ভারতের হাই কমিশনার হর্ষবর্ধন শ্রিংলা বলেন, “এ নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো আমি বাংলাদেশের রথযাত্রায় অংশ নিচ্ছি। গত বছর হলি আর্টিজানের ঘটনার পরও রথযাত্রা উৎসব পালিত হয়েছে। সে কথা ভুলিনি। রথযাত্রা উৎসব জনগণের মধ্যে পারস্পরিক বিশ্বাস ও সমঝোতা বাড়ায়।”
আলোচনার পর হর্ষবর্ধন শ্রিংলা রথযাত্রার উদ্বোধন করেন।
বেলা ২টায় জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলরামকে নানা উপচারে সাজিয়ে বের হয় তিনটি রথ। এই রথের রশি ধরে টেনে নিয়ে চলেন ভক্তরা। ভক্তদের বিশ্বাস এই রশি টানলে তাদের আর পুনর্জন্ম হবে না।
ভক্ত সুনন্দ ভট্টাচার্য বলেন, “এর আগে কখনও এমন নিরাপত্তা বলয় দেখিনি। সাম্প্রদায়িক শক্তির ভয়ে এই রথযাত্রা উৎসবে নিরাপত্তার কড়াকড়ি বেশ ভালো। কিন্তু এতে উৎসবে কিন্তু ভাটা পড়ল।”
আগামী ৩ জুলাই উল্টো রথ, জগন্নাথ, সুভদ্রা ও বলরাম আবার ফিরে আসবেন ইসকন মন্দিরে। তখনই শেষ হবে রথযাত্রার আনুষ্ঠানিকতা। এই আট দিনে ইসকন ও ঢাকেশ্বরী মন্দিরে ধর্মীয় আলোচনা ও ভক্তিমূলক সংগীত আসরের আয়োজন করা হয়েছে বলে জানিয়েছেন বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের নেতারা।
বাংলাদেশে বহুকাল আগে থেকেই রথযাত্রার অনুষ্ঠান ও মেলা হয়ে আসছে। ঢাকা, ধামরাই, খুলনা, বরিশাল, গোপালগঞ্জ, কুমিল্লা, চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ, রংপুর প্রভৃতি স্থানেও আজ রথযাত্রা হয়।
ধামরাই অঞ্চলে যশোমাধবের রথযাত্রাও খুব প্রসিদ্ধ। যশোমাধবের মন্দিরে ঊনিশ শতকের মধ্যবর্তী সময়ে সাটুরিয়া বালিয়াটির জমিদাররা ৬০ ফুট উঁচু যে রথ নির্মাণ করেছিলেন, স্বাধীনতা যুদ্ধের সময় পাকিস্থানী বাহিনী তা পুড়িয়ে দেয়। তিনতলা রথটি টানতে ২৭ মণ শনের দড়ি ব্যবহৃত হত বলে জনশ্রুতি রয়েছে।
সমগ্র দেশ, এমনকি ভারত-নেপাল থেকেও ভক্তদের সমাগম হতো রথের দড়ি টানার জন্য। বর্তমানে নতুন নির্মিত রথ টেনে এ অনুষ্ঠান পালন করা হয়।