মহাসড়কে ধীরগতিতে কাউন্টারেই ঘণ্টার পর ঘণ্টা

টাঙ্গাইলে বিচ্ছিন্ন জট আর সিরাজগঞ্জে ২১ কিলোমিটার সড়কে যান চলাচলে ধীরগতির কারণে গাড়ি না ফেরায় ঢাকার গাবতলী, কল্যাণপুর ও গাজীপুর থেকে উত্তরের পথের যাত্রীদের বাসের জন্য দীর্ঘ সময় অপেক্ষায় থাকতে হয়েছে।

নিজস্ব প্রতিবেদক গাজীপুর, সিরাজগঞ্জ, টাঙ্গাইল, কুমিল্লা ও ফেনী প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 24 June 2017, 05:51 AM
Updated : 24 June 2017, 08:33 PM

তবে কুমিল্লা-চট্টগ্রামমুখী এবং যশোর-খুলনামুখী পথে উত্তরের থেকে ভিন্ন চিত্র দেখা গেছে। ঠিক সময়ে গাড়ি এসে ছেড়েও গেছে নির্ধারিত সময়ে।

শনিবার সকালে রাজশাহী ও রংপুর বিভাগের বিভিন্ন জেলার বাস কাউন্টারগুলোয় কথা বলে জানা যায়, টাঙ্গাইল, গাজীপুর ও সিরাজগঞ্জ এলাকায় যানজটের কারণে তাদের বাসগুলো সময়মত ঢাকায় পৌঁছাতে পারেনি। সে কারণেই ঢাকা ও গাজীপুর থেকে নির্ধারিত সময়ে বাসগুলো ছাড়া যায়নি।

হানিফ পরিবহনের একজন চালকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গাইবান্ধা থেকে ঢাকা আসতে সময় লাগে সাধারণত সাত ঘণ্টা। কিন্তু শুক্রবার সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় তাদের যে গাড়ি ছেড়েছে, সেটি পৌঁছেছে সকাল ৭টার দিকে।

কাউন্টার ও যাত্রীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, শনিবার সকালের বাসগুলো ছাড়তে তিন থেকে চার ঘণ্টা দেরি হয়।

কল্যাণপুর থেকে জয়পুরহাটগামী শ্যামলী পরিবহনের ৭টার বাস ছাড়ে ৯টায়। আর নওগাঁগামী সকাল ৭টার বাস সাড়ে ৯টায়ও ঢাকায় আসতে পারেনি।

নওগাঁর যাত্রী আব্দুর রহমান সুমন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সকাল সাড়ে ৬টা থেকে কাউন্টারে অপেক্ষা করছি, বলছে জ্যাম। অপেক্ষা ছাড়া আর কি করব?”

হানিফ পরিবহনের সকাল সাড়ে ৯টার গাড়ির জন্য অপেক্ষা করতে দেখা যায় রফিকুল ইসলামকে, তার গন্তব্য গাইবান্ধা।

কাউন্টার ম্যানেজার একেএম রইসুল আলম সবুজ সকাল ১০টার দিকে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ওই গাড়ি গাজীপুরের চন্দ্রায় জটে আটকে আছে।

“আমাদের নন-এসি বাসগুলো ম্যানেজ করে ছাড়ার চেষ্টা করছি। এসি গাড়ি সময়মত না পৌঁছানোর কারণে রাতের চারটি গাড়ি সকালে ছেড়েছি। বিভিন্ন জায়গায় জ্যাম থাকায় এই বিলম্ব হচ্ছে।”

তিন ঘণ্টা ধরে অপেক্ষায় থাকা শ্যামলী পরিবহনের জয়পুরহাটের যাত্রী কুদ্দুস খান বলেন, “ছাড়ার কথা ছিল ৭টায়, গাড়ি এসেছে পৌনে ৯টার দিকে।”

পাবনা এক্সপ্রেসের সকাল সাড়ে ৭টার বাস রাজধানীর টেকনিক্যাল মোড়ের কাউন্টার ছাড়ে সাড়ে ১০টার পর; এরপর সিরাজগঞ্জ এলাকায় গিয়ে দীর্ঘ যানজটে পড়ে।

ওই বাসে বাড়ির পথ ধরা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের প্রধান অর্থনৈতিক প্রতিবেদক আবদুর রহিম হারমাছি বলেন, “মহাসড়কে যানজটের কারণে ফিরতে দেরি হওয়ায় বাস ছেড়েছে তিন ঘণ্টা পর। বিভিন্ন স্থানে যানজটের কারণে থেমে থেমে চলার পর বেলা ২টার দিকে সিরাজগঞ্জে এসে বড় রকমের জটে আটকা পড়ে।”

সিরাজগঞ্জের হাটিকুমরুল হাইওয়ে পুলিশের সার্জেন্ট আবদুল গনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, বঙ্গবন্ধু সেতু থেকে হাটিকুমরুল পর্যন্ত ২১ কিলোমিটার রাস্তা দুই লেইনের। রাজশাহী ও রংপুর বিভাগসহ খুলনা বিভাগের কয়েকটি জেলার গাড়ি ওই পথে যায়। ঈদ উপলক্ষে গাড়ির সংখ্যা বেশি থাকায় সেখানে ২১ কিলোমিটার সড়কে গাড়ি চলে থেমে থেমে।

এদিকে টাঙ্গাইলের মির্জাপুরে ধেরুয়া রেলক্রসিং, রসুলপুর, এলেঙ্গা, গোড়াই, সুভল্লা, করটিয়া, পাকুল্লায় খানাখন্দের কারণে যানবাহনের গতি কম থাকে।

ভোরের দিকে এলেঙ্গা-ভুয়াপুর লিংকরোডে বাসের সঙ্গে ট্রাকের সংঘর্ষ, সকাল ৯টায় চরভাবলাসহ মোট ছয় জায়গায় ছয় ঘটনায় ছয়টি গাড়ি বিকল হয়। এতে এসব এলাকায় ওই মুহূর্তে জট সৃষ্টি হলেও কিছুক্ষণের মধ্যেই বিকল গাড়ি সরিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করা হয় বলে টাঙ্গাইলের পুলিশ সুপার মাহবুব আলম জানান।

মহাসড়কে অন্য বছরের তুলনায় এবার পুলিশের নানামুখী ব্যবস্থার কারণে কোনো যানজটের সৃষ্টি হয়নি বলে দাবি করেন এ পুলিশ কর্মকর্তা।

বঙ্গবন্ধু সেতুর পশ্চিম থানার ওসি মোহাম্মদ দাউদ রাত ৮টার দিকে বলেন, “বিকাল থেকে যানবাহনের অতিরিক্ত চাপ কমতে শুরু করেছে। এখন অনেকটা স্বস্তিতে আছি “

হাটিকুমরুল হাইওয়ে থানার ওসি আব্দুল কাদের জিলানী রাতে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, হাটিকুমরুলে সেতুর দিকের পাঁচ কিলোমিটার মহাসড়কে যানবাহনের অতিরিক্ত চাপ থাকলে মহাসড়কে তেমন সমস্যা নেই। অল্প কিছুটা ধীরে যানবাহন চলছে।

এদিকে তিন মাসের বকেয়া বেতনের দাবিতে বেলা দেড়টার দিকে ঢাকার কল্যাণপুরে পোশাক শ্রমিকদের বিক্ষোভের কারণে ওই এলাকায় যানজটের সৃষ্টি হয়।

বাসে উঠা ঘরমুখী অনেক যাত্রীর আটকে পড়ার মধ্যে বিকাল ৩টায় মালিকপক্ষের সঙ্গে সমঝোতার আশ্বাসে রাস্তা ছাড়েন শ্রমিকরা।

গাজীপুরে কাউন্টারে দীর্ঘ অপেক্ষা

গাজীপুরে উত্তরের পথের যাত্রীদের শনিবার সকালেও বাসের অপেক্ষায় কাউন্টারগুলোয় ভিড় করতে দেখা গেছে। কাউন্টারগুলো থেকে যথাসময়ে বাস ছাড়েনি।

ভোগড়া বাইপাস সড়কে তানজিলা ট্রাভেলসের কাউন্টার ব্যবস্থাপক মো. ইব্রাহিম বলেন, উত্তরের পথে সিরাজগঞ্জের সড়কের রেস্তোরাঁগুলোয় বাস ঢুকতে ও বের হতে গিয়ে যানজট সৃষ্টি হয়। এর প্রভাব পড়ে টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা পর্যন্ত।

তানজিলা ট্রাভেলসের একটি বাসের চালক দুলাল মিয়া বলেন, সিরাজগঞ্জে জটের কারণে পঞ্চগড় থেকে গাজীপুরে পৌঁছাতে ৮ ঘণ্টার পথে প্রায় দ্বিগুণ সময় লাগে।

ভোগড়া ফাহমিদা হক পরিবহনের টিকিট বিক্রেতা মো. মিনারুল ইসলাম বলেন, যান্ত্রিক ত্রুটি বা যানজটের কারণে গাড়ি ছাড়তে বিলম্ব হলে অসদাচরণ করা যাবে না - এমন নোটিশ টাঙিয়ে টিকিট বিক্রি করেন তারা।

উত্তরবঙ্গে যাত্রী নামিয়ে ফিরতি পথে বগুড়ার মোকামতলা থেকে সিরাজগঞ্জের কড্ডা, যমুনা সেতু, টাঙ্গাইলের এলেঙ্গা ও গোড়াইয়ে যানজটে পড়তে হয় বলে জানান মিতালি স্পেশাল ও ফাইভ স্টার পরিবহনের কাউন্টার ব্যবস্থাপক মুক্তার হোসেন।

সকালে তিনি বলেন, “গাড়ি কখন পৌঁছাবে তার কোনো নিশ্চয়তা নেই। তাই আগাম টিকিট বিক্রি করছি না। গাড়ি এলে টিকিট বিক্রি করছি।”

হানিফ পরিবহনের কাউন্টার ব্যবস্থাপক শাহদত হোসেনও একই তথ্য জানান।

তিনি বলেন, দূরপাল্লার নিয়মিত গাড়িগুলোর এই বিলম্বের কারণে টাউন সার্ভিসের কিছু বাস এসে যাত্রী নিয়ে রওনা হয়।

সময় বেশি লাগছে বলে এসব টাউন সার্ভিসের বাস অতিরিক্ত ভাড়া নেয় বলে জানান কয়েকজন চালক।

বগুড়ার যাত্রী রমজান আলী দুপুরে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “স্ত্রী-সন্তান নিয়ে গাড়ির জন্য পাঁচ ঘণ্টা ধরে অপেক্ষা করছি। তার পরও বাস না পেয়ে টাউন সার্ভিসের একটি বাসে গন্তব্যের উদ্দেশে রওনা হচ্ছি।

“এতে মাথাপিছু ১০০০ টাকা গুনতে হচ্ছে। অন্য সময় এ ভাড়া ২৫০ থেকে ৩০০ টাকা।”

এদিকে ঢাকা-ময়মনসিংহ মহাসড়কে শনিবার সকাল থেকে গাড়ির চাপ বাড়ে বলে জানান নাওজোর পুলিশ ফাঁড়ির ওসি আব্দুল হাই।

কোনাবাড়ি হাইওয়ে থানার ওসি মোহাম্মদ হোসেন সরকার বলেন, “শনিবার সকাল সাড়ে ১১টার দিকে এ পথে গাড়ির সংখ্যা বেড়ে যায়। চন্দ্রা, শফিপুর, কোনাবাড়ি ও আশপাশের এলাকায় ঢাকা-টাঙ্গাইল মহাসড়কে গাড়ির চাপ বেশি দেখা গেছে।”

গাজীপুরগামী বলাকা পরিবহনের যাত্রী জয়নাল আবেদিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সকাল সাড়ে ৮টার দিকে টঙ্গী থেকে শিববাড়ি যাওয়ার জন্য গাড়িতে উঠেছি। চান্দনা-চৌরাস্তায় ১০-১৫ মিনিটের পথে যানজটে পড়ে সময় লেগেছে দেড় ঘণ্টা।”

সরেজমিনে স্টেশনে স্টেশনে ঘরমুখো মানুষের ভিড় দেখা যায়। অনেকেই বাস না পেয়ে ট্রাক, পিকআপ বা বিকল্প পরিবহনে গন্তব্যের উদ্দেশ্যে যাত্রা করেন।

তবে রাতে মহাসড়কে যানজট কিছুটা কমে আসে বলে এসআর ট্রাভেলসের এজিএম টি আর প্লাবন জানান।

রাত সাড়ে ৯টায় তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এখন মোটামুটি ভালো। মোটামুটিভাবে গাড়ি ফিরতেছে।

“কালকে রাতের চেয়ে একটু জ্যাম কম। দেখা গেছে গতকাল গাইবান্ধায় ছেড়ে যাওয়া গাড়ি কিছু সময় আগে পৌঁছাইছে। জয়পুরহাটের গাড়ি সন্ধ্যায় পৌঁছাইছে। আমরা সে অনুযায়ী ব্যবস্থা নিয়েছি।”

দক্ষিণমুখী চিত্র ভিন্ন

উত্তরবঙ্গের গাড়ির জন্য কল্যাণপুর ও গাবতলীর কাউন্টারে যাত্রীদের দীর্ঘ অপেক্ষা করতে দেখা গেলেও দক্ষিণাঞ্চলের জন্য সেই চিত্র ছিল ভিন্ন; সেখানে বাস ছিল পর্যাপ্ত, ঠিক সময়ে এসে বাড়ির পথ ধরতে পেরেছেন যাত্রীরা।

পূর্বাশা পরিবহনের বেলা আড়াইটার গাড়ি ধরতে ছোটভাইকে নিয়ে গাবতলীর কাউন্টারে আসেন বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তা আফরিন আফরোজ; ঢাকায় যানজটের কথা বিবেচনা করে আগে বাসা থেকে বেরিয়ে কাউন্টারে পৌঁছে যান দুই ঘণ্টা আগেই।

আফরিন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আসছি কেরানিগঞ্জ থেকে। যানজট হবে ভেবে আগেই রওনা করছিলাম, কিন্তু পৌঁছে গেছি ৪৫ মিনিটেই। এখন বাসের জন্য অপেক্ষা করছি। অন্য গাড়ি ঠিক সময়ে যাচ্ছে, আমারটাও যাবে।”

ফেরিতে ঘাটে ঝামেলা না থাকলে নির্বিঘ্নে পৌঁছে যাওয়ার প্রত্যাশার কথা জানান তিনি।

আফরিনের কথার মিল পাওয়া যায় গাবতলীতে যশোর-খুলনাগামী ঈগল পরিবহনের কাউন্টার মাস্টার মিজানুর রহমানের কথায়ও।

বেলা ২টায় বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “পাটুরিয়া ফেরিঘাটে কোনো ঝামেলা না থাকায় আমাদের কোনো ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে না। বাস ঠিক সময়ে যাচ্ছে, ঠিক সময়ে ফিরছে। টিকেট থাকায় আমরা তাৎক্ষণিকভাবে বিক্রিও করতে পারছি।”

বরিশালমুখী শাপলা ট্রান্সপোর্টের এক কর্মীও একই ধরনের তথ্য দেন।

স্বস্তি ছিল কুমিল্লার পথেও

আগের দিন কুমিল্লায় যেতে যানজটে পড়তে হলেও শনিবার ভিন্ন চিত্র ছিল বলে জানান কুমিল্লা হাইওয়ে পুলিশের এসআই মো. সফিকুল ইসলাম।

তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন,  ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কুমিল্লার দাউদকান্দিতে মেঘনা-গোমতী টোল প্লাজা থেকে রাজারহাট পর্যন্ত চার কিলোমিটারে যানজট প্রবণ এলাকা।

“যেখানে শুক্রবার সকালে কিছুটা যানজট ছিল, যা বিকালের পর থেকে কমতে শুরু করে। শনিবার সেই পয়েন্টসহ ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়কে কোথাও যানজট নেই।”

আগের দিনের মতো এই মহাসড়কে যান চলাচলে ধীর গতি ছিল না বলেও জানান তিনি।

রোকসানা বেগম নামে এক যাত্রী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিকালে ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে দেড় ঘণ্টায় কুমিল্লায় এসেছি। কোনো প্রকার যানজট ছাড়াই।”

দাউদকান্দির প্রাইভেটকার চালক রাসেল বলেন, “সড়কে যেহেতু ট্রাক,কভার্ডভ্যান নেই, তাই যানজটও নেই।”

রাত সাড়ে ১০টার দিকে ফেনী জেলা ট্রাফিক পুলিশের ওসি মীর গোলাম ফারুক বলেন, মহাসড়কের ফেনী অংশে যানজট হত সরু রাস্তা ও ট্রাকের কারণে। এখন ট্রাক চলাচল নেই, পুলিশও বেশ তৎপর।

 “শনিবার সারাদিন ও রাতে মহাসড়কে যান চলাচলে তেমন ধীর গতি নেই, যানজটও নেই।”