মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে সুফিয়া কামাল-জাহানারা ইমাম স্মরণসভা

বেগম রোকেয়ার পর কবি সুফিয়া কামাল ও শহীদ জননী জাহানারা ইমামকে সমাজ পরিবর্তনে নিবেদিতপ্রাণ হিসেবে দেখছেন সাংস্কৃতিক সংগঠকরা।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 21 June 2017, 10:18 AM
Updated : 21 June 2017, 10:18 AM

মুক্তিযুদ্ধে পাক হানাদারদের দোসর রাজাকার-আলবদর-আলশামসদের বিচার ত্বরান্বিত করার আন্দোলনের দুই ‘মহিয়সী নারী’র জন্মদিন উপলক্ষে এক স্মরণসভায় এসে তাদের সহযোদ্ধারা বললেন, সমঅধিকার প্রতিষ্ঠার লড়াইয়ে দুজনের অনুপস্থিতি তারা গভীরভাবে উপলদ্ধি করেন।

বুধবার সকালে মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর মিলনায়তনে আয়োজিত হয় সুফিয়া কামাল ও জাহানার ইমাম স্মরণসভা।

এতে সুফিয়া কামাল ও জাহানারা ইমামের সঙ্গে আন্দোলনের স্মৃতি তুলে ধরেন সাংস্কৃতিক সংগঠক অভিনেতা সৈয়দ হাসান ইমাম ও মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সারোয়ার আলী।

সৈয়দ হাসান ইমাম বলেন, “বেগম রোকেয়ার পর কবি সুফিয়া কামাল ও শহীদ জননী জাহানারা ইমাম ছাড়া আর কাউকে সমাজ পরিবর্তনে নিবেদিতপ্রাণ হিসেবে দেখিনি আমরা। সমগ্র বাংলায় তাদের মতো সাহসী নারী আর কাউকে দেখিনি।”

সুফিয়া কামাল ‘ধর্মনিরপেক্ষ’ ছিলেন মন্তব্য করে তিনি বলেন, “তবে তিনি ধর্মপ্রাণ ছিলেন। বাংলাদেশের অধিকাংশ জনগণ ধর্মপ্রাণ। তিনি ধর্মীয় মূল্যবোধে বিশ্বাসী ছিলেন না। তিনি সব মানুষকে সমানভাবে ভালোবাসতেন। তিনি ছিলেন সাহসী , কিন্তু অত্যন্ত বিনয়ী। তার মধ্যে সাহসের উগ্রতা একেবারে ছিল না।”

পাকিস্তান শাসনামলে আমলাতন্ত্রের বিরুদ্ধে সুফিয়া কামালের সোচ্চার ভূমিকার প্রশংসা করেন সৈয়দ হাসান ইমাম।

আইয়ুব খানের একটি সভার উদাহরণ টেনে তিনি বলেন, “আইয়ুব খানের একটি সভায় অতিথি ছিলেন তিনি। আইযুব খান বাঙালিদের পশু বললেন। তখন সুফিয়া কামাল তাকে প্রত্যুত্তর দিলেন, ‘বাঙালিরা পশু হলে আপনি তাদের রাজা, আপনি পশুশ্রেষ্ঠ’। তখন শাসকদের বিরুদ্ধে কথা বলা তো দূরে থাক, ভয়ে কেউ ঘর থেকে বের হত না। তার মতো করে কথা বলার সাহস কারও ছিল না।”

সোভিয়েত ইউনিয়ন-পাকিস্তান মৈত্রী সমিতির সভাপতি হিসেবে সুফিয়া কামালের ভূমিকার কথা শোনান অভিনেতা হাসান ইমাম।

তিনি বলেন, “শত্রুকে ভালোবাসার অসম্ভব ক্ষমতা ছিল তার। যখন যেটা সঠিক মনে করতেন, সংগ্রামের পরিন্থি হলেও তিনি তা বলতেন। তিনি মানবিকতাকে সবার উপরে স্থান দিয়েছেন। মানুষের মনের বিশ্বাসকে তিনি শ্রদ্ধা করতেন।”

চল্লিশের দশকের প্রেক্ষাপটে জাহানারা ইমামকে ‘আধুনিক মহিলা’ হিসেবে অভিহিত করে হাসান ইমাম বলেন, “তখন নারীরা পর্দা করতেন, স্কুলগামী মেয়েরা পর্দায় ঢাকা ঘোড়ার গাড়িতে করে স্কুলে যেত। সেসময়ে জাহানারা ইমাম বব কাট করেছেন, নিজে গাড়ি চালাতেন। তিনি এতই সুন্দরী ছিলেন, লোকেরা তাকে সুচিত্রা সেন বলত।”

প্রথম জীবনে শিক্ষা ও সংস্কৃতির সঙ্গে ‍যুক্ত থাকলেও স্বাধীনতার পরে যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের দাবিতে সোচ্চার হয়ে উঠেন তিনি।

১৯৯১ সালে ২৯ ডিসেম্বর জামায়াতে ইসলাম গোলাম আজমকে আমির ঘোষণা করলে তার প্রেক্ষাপটে ১৯৯২ সালের ১৯ জানুয়ারি ১০১ সদস্যবিশিষ্ট একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটি গঠিত হয়। জাহানারা ইমাম ছিলেন এর আহ্বায়ক।

এর পাশাপাশি মুক্তিযুদ্ধের চেতনাবিরোধী প্রতিরোধ মঞ্চ, ১৪টি ছাত্র সংগঠন, প্রধান প্রধান রাজনৈতিক জোট, শ্রমিক-কৃষক-নারী এবং সাংস্কৃতিক জোটসহ ৭০টি সংগঠনের সমন্বয়ে পরবর্তীতে ওই বছরের ১১ ফেব্রুয়ারি ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাস্তবায়ন ও একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল জাতীয় সমন্বয় কমিটি’ গঠিত হয়। 

সৈয়দ হাসান ইমাম জানান, ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির আহ্বায়ক হিসেবে সুফিয়া কামালকে অনুরোধ করলে পরে তার অনুরোধে তারা জাহানারা ইমামকে আহ্বায়কের ভূমিকায় নিয়ে আসেন।

জাহানারা ইমামের লেখা ‘একাত্তরের ডায়েরি’কে একাত্তরে অবরুদ্ধ বাংলাদেশের এক ‘বাস্তবভিত্তিক দলিল’ হিসেবে উল্লেখ করেন তিনি।

জাহানারা ইমাম কণ্ঠনালীতে ক্যান্সার আর মেরুদণ্ডের সমস্যা নিয়ে ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির দাবিকে সারা দেশের মানুষের কাছে পৌঁছে দিতে নিবেদিতপ্রাণ ছিলেন জানিয়ে হাসান ইমাম বলেন, “প্রথমদিকে তিনি কী বলতেন বোঝা যেত না। তার উচ্চারণ জড়িয়ে যেত। সে অবস্থাতেই তিনি ঘণ্টাব্যাপী বক্তৃতা দিতেন।

“তাকে সারা দেশের মানুষ যেভাবে গ্রহণ করেছিলেন, তা এক ইতিহাস। গণআদালতের ব্যাপারে সারা দেশের মানুষকে তিনি উদ্বুদ্ধ করেছেন।”

১৯৯৪ সালে ২৬ জুন যুক্তরাষ্ট্রের মিশিগানের ডেট্টয়েট নগরীর সাইনাই হাসপাতালে ৬৫ বছর বয়সে জাহানারা ইমাম মারা যান।

জাহানার ইমামের ছেলে জামির সঙ্গে তার লাশ দেশে নিয়ে আসেন সৈয়দ হাসান ইমাম। সেদিনের স্মৃতি বলতে গিয়ে তিনি বলেন, “ঢাকায় তার জানাজায় অসংখ্য মানুষের উপস্থিতি প্রমাণ করে তারা অকৃতজ্ঞ নয়। তারা তাকে হৃদয়ের মণিকোঠায় ধরে রেখেছে।”

১৯৯৬ সালের ২২ মার্চ মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘর প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে সুফিয়া কামাল ও জাহানারা ইমাম ট্রাস্টিদের ‘প্রেরণার উৎস’ ছিলেন বলে জানান মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি সারোয়ার আলী।

“আমার বিবেচনায় সুফিয়া কামাল শ্রেষ্ঠ মানবাধিকার কর্মী। বাঙালির স্বাধিকার আদায়ের আন্দোলনে তারা সামনের কাতারে ছিলেন সবসময়। সুবিধাবঞ্চিত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সবার পাশেই তিনি সাহসের সঙ্গে দাঁড়িয়েছিলেন। তার মৃত্যুর পরেও আমি দেখেছি তার সর্বজনশ্রদ্ধেয় রূপ।”

যুদ্ধাপরাধীদের বিচারকে বাঙালির অসমাপ্ত কাজ হিসেবে দেখছেন সারোয়ার আলী। সেই অসমাপ্ত কাজকে ত্বরান্বিত করতে শহীদ জননী জাহানারা ইমাম আমৃত্যু কাজ করে গেছেন বলে মন্তব্য করেন তিনি।

পরে তিনি বলেন, “আজকে যখন ধর্মীয় জাতিগত গোষ্ঠী এ দেশকে আর নিরাপদ আশ্রয়স্থল ভাবে না, নির্বাচনী রাজনীতির কারণে মৌলবাদীদের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠে, কিংবা মানুষের স্বার্থে সমঅধিকারের রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার গড়ে তোলার প্রসঙ্গ আসে, তখন আমরা তাদের অনুপস্থিতি গভীরভাবে উপলদ্ধি করি।”

অনুষ্ঠানে এসেছিলেন সুফিয়া কামালের মেয়ে সুলতানা কামাল, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির অধ্যাপক এম এম আকাশ, মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরের ট্রাস্টি জিয়াউদ্দিন তারিক আলী।

জেকেএস/এমএম

সুফিয়া কামাল ও জাহানারা ইমামের ফাইল ছবি