নতুন পাড়ায়ও পাহাড় ন্যাড়া করে ঢালে তৈরি করা হয়েছিল ঘর, সেখানে মাটিচাপায় মারা গেছেন ছয়জন। ওই এলাকায় অধিকাংশ বাড়িই পাহাড়ের পাদদেশে; সবগুলোতে এখন পাহাড় ভেঙে মাটি ঢুকেছে।
পোস্ট অফিস কলোনিতেও ঘরগুলো পাহাড়ের গোড়াতেই; সেখানে মারা গেছেন তিনজন।
গত মঙ্গলবার ভূমিধস যেসব এলাকায় ঘটেছে, তার প্রায় প্রতিটি স্থানেই পাহাড় কাটা এবং গাছ উজারের চিহ্ন হিসেবে ন্যাড়া পাহাড় দেখা গেছে।
রাঙামাটির প্রবীণ সাংবাদিক সত্তরোর্ধ্ব সুনীল কান্তি দে বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “যেখানে পাহাড় ন্যাড়া হয়েছে, সেখানেই দুর্যোগ এসেছে। গাছ কেটে ফেলায় টিলা ধসেছে, ভেঙেছে।”
গত ৬০ বছর ধরে পার্বত্যাঞ্চলে বাস সুনীল দে’র। তবে এবারের মতো প্রাণহানি আর কখনও দেখতে হয়নি তাকে।
প্রবল বর্ষণে পাহাড় ধসে শুধু রাঙামাটিতেই মারা গেছেন ১১৩ জন। চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, কক্সবাজার মিলিয়ে এই সংখ্যা ১৬০ ছাড়িয়েছে।
রাঙামাটিতে নিহতদের মধ্যে ৬৬ জন সদর উপজেলার, এর মধ্যে ৩৬ জন মারা গেছেন পৌর সদরের ভেদভেদি এলাকায়।
রাঙামাটি সদরের মোট ১৯টি স্থানে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে। এর মধ্যে ভেদভেদি এলাকাতেই ১০টি স্থানে দুর্ঘটনা ঘটে। এছাড়া পৌর সদরের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের নতুন পাড়া, সনাতন পাড়া, শিমুলতলী, যুব উন্নয়ন, পোস্ট অফিস কলোনি, কিনা মনি পাড়া, পশ্চিম মুসলিম পাড়া, লোকনাথ মন্দির সংলগ্ন মুসলিম পাড়া ও মাবুদ পাড়ায় পাহাড় ধসে মানুষ মারা গেছে।
রাঙামাটিতে নিহতদের মধ্যে ৫৩ জন বাঙালি, বাকি ৬০ জন পাহাড়ি।
সুনীল দে বলেন, “সদরে পাহাড়ি-বাঙালি যারা পাহাড়ে বসতি করেছে, তাদের অধিকাংশই বিভিন্ন উপজেলা থেকে আসা। কম টাকায় জায়গা কিনে অথবা অবৈধভাবে দখল করে শহরের বিভিন্ন অঞ্চলে তারা বসতি করেছে।”
২০১১ সালের আদমশুমারি তথ্য অনুযায়ী রাঙামাটি জেলায় মোট জনসংখ্যা ৬ লাখ ২০ হাজার ২১৪ জন। এর ১ লাখ ২৪ হাজার ৭২৮ জন সদর উপজেলার বাসিন্দা; এর মধ্যে ৪৯ শতাংশ পাহাড়ি।
২০০১ সালের পর ১০ বছরে রাঙামাটির জনসংখ্যা বেড়েছে ২ লাখ ৭১ হাজার ৪২৪ জন। জনসংখ্যা বৃদ্ধির এই হার জাতীয় হারের চেয়ে বেশি। বিভিন্ন স্থান থেকে গিয়ে পাহাড়ে বসত গড়া বাঙালিরা এই হার বৃদ্ধিতে ব্যাপক ভূমিকা রেখেছে।
বিপর্যয়ের পর সরেজমিন ঘুরে রাঙামাটি শহরের পাবলিক হেলথ, তবলছড়ির বিএডিসি, কলেজ গেইট, আমানত বাগসহ বেশকিছু এলাকায় পাহাড় কেটে বসতি তৈরি হতে দেখা গেছে। এছাড়া কাপ্তাই লেক সংলগ্ন এলাকা ধরে তৈরি হচ্ছে বিভিন্ন স্থাপনা।
পাহাড় কেটে ঘর বানিয়ে থাকলে সেখানে মৃত্যুঝুঁকি আছে এমন ধারণাই নেই বসবাসকারীদের।
রাঙামাটি শহরে অপরিকল্পিত বসতির কথা স্বীকার করেছেন চাকমা রাজা দেবাশীষ রায়।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “শহরে জমি সঙ্কট। লোকসংখ্যা বাড়াতে অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কাটা হয়।”
তবে এবারের বিপর্যয়ের জন্য শুধু পাহাড় কাটাকে দায়ী করছেন না চাকমা রাজা দেবাশীষ।
তিনি বলেন, “রাঙামাটিতে এত বৃষ্টি স্বাভাবিকভাবে হয় না। অতীতে পাহাড় ধসও সেভাবে হয়নি। যেসব পাহাড়ে বসতি নেই, তাও এবার ধসেছে।”
রাঙামাটির জেলা প্রশাসক মানজারুল মান্নানও একই কথা বলেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “রেকর্ড বৃষ্টিপাতে বসতি আছে তেমন ছাড়াও প্রায় সব ন্যাড়া পাহাড়ের চূড়াও ভেঙেছে।”
এবারের দুর্যোগের প্রেক্ষাপটে পরিকল্পিত বসতি করতে এখন থেকে পরিকল্পনা নেওয়ার উপর জোর দেন দেবাশীষ রায়।
“সংশ্লিষ্ট বিষয়ে বিশেষজ্ঞদের নিয়ে গবেষণা করে সমন্বিত উদ্যোগ নিতে হবে। নইলে ভবিষ্যতে এর চেয়েও বড় ধস হতে পারে।”
আইন অনুযায়ী পাহাড় কাটার কোনো সুযোগ নেই এবং তা ঘটলে পরিবেশ অধিদপ্তরের ব্যবস্থা নেওয়ার কথা।
পরিবেশ অধিদপ্তর চট্টগ্রামের আঞ্চলিক পরিচালক মাসুদ করিম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “পাহাড় কাটলে পরিবেশ অধিদপ্তর ব্যবস্থা নেবে। যে কোনো ধরনের পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে আমরা কঠোর অবস্থানে আছি।”
তিনি পাহাড়ের গাছ কাটাকে প্রধানত দায়ী করে বলেন, “পাহাড়ের মাটি সাধারণ বালিমাটি। গাছের শিকড়ের মাধ্যমে মাটি আটকে থাকে। গাছ উপড়ে গেলে অথবা কেটে ফেললে বালিমাটিতে পানি প্রবেশ করে বন্ডিং নষ্ট হওয়ায় পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটেছে।”
চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের ইনস্টিটিউট অব ফরেস্ট্রি অ্যান্ড এনভায়রনমেন্টাল সায়েন্সের পরিচালক অধ্যাপক দানেশ মিয়া মনে করেন, পাহাড় কাটার সময় সুরক্ষার ব্যবস্থা না থাকা এবং অপরিকল্পিভাবে গাছ কাটার ফলে পাহাড় ধসের ঘটনা ঘটছে।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, বসতি, “স্থাপনা ও সড়ক নির্মাণের প্রয়োজনে পাহাড় কাটা হচ্ছে। কিন্তু সুরক্ষার কোনো উদ্যোগ নেয়া হয় না। এক্ষেত্রে ঝুঁকি থাকে।”
রাঙামাটি, চট্টগ্রামে পাহাড় ধস ঠেকানোর জন্য পাহাড় সুরক্ষার নীতি করার উপর জোর দেন তিনি।
স্থানীয়রা বলছেন, রাঙামাটি পুরো জেলাই পাহাড়ি এলাকা। আর একারণে এখানে বসতি গড়তে গেলে পাহাড় কিংবা টিলা কাটাই পড়ে। কিন্তু কীভাবে তা হচ্ছে, তা তদারকির জন্য কোনো প্রতিষ্ঠান নেই।
চট্টগ্রাম শহরে পরিবেশ অধিদপ্তরের আঞ্চলিক কার্যালয় থাকলেও তিন পার্বত্য জেলা রাঙামাটি, খাগড়াছড়ি ও বান্দরবানে তাদেও কোনো কার্যালয় নেই। কিছু ঘটলে চট্টগ্রাম থেকে কর্মকর্তারা গিয়ে কাজ করে থাকেন।
প্রবীণ সাংবাদিক সুনীল দে বলেন, গত এক দশকে রাঙামাটিতে পাহাড় কাটার বিরুদ্ধে পরিবেশ অধিদপ্তরের কোনো পদক্ষেপ তিনি দেখেননি।
অপরিকল্পিত বসতি গড়ে তোলা প্রসঙ্গে জানতে চাইলে পরিবেশ অধিদপ্তরের আঞ্চলিক পরিচালক মাসুদ করিম বলেন, “বাড়িঘর আছে কি না এবং ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড়ের তালিকা করার দায়িত্ব স্থানীয় প্রশাসনের।”
প্রশাসনের কাছে নেই পরিসংখ্যান
অতীতে বড় কোনো বিপর্যয়ের অভিজ্ঞতা না থাকায় ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় এবং পাহাড়ে বসতিকারীদের চিহ্নিত করা হয়নি বলে জানান রাঙামাটি জেলা প্রশাসনের কর্মকর্তারা।
এক দশকেরও বেশি সময় ধরে পাহাড় এবং গাছ কেটে ন্যাড়া করা হলেও প্রশাসন বা সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এ বিষয়টিকে গুরুত্ব দেয়নি বলে বলেও অভিযোগ রয়েছে।
জেলা প্রশাসক মানজারুল মান্নান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, যুগ যুগ ধরে এখানে পাহাড়ি-বাঙালিরা ঢালে প্রকৃতির সঙ্গে মিলেমিশে থাকছে। কখনও এত বড় দুর্যোগ আসেনি।
সে কারণে ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় এবং বসতি স্থাপনকারীদের তালিকা করা হয়নি জানিয়ে তিনি বলেন, “৫-১০ বছর আগেও কোনো ঘটনা ঘটলে হয়ত করা যেত। এবারের ধসে ঝুঁকির মাত্রা বোঝা গেছে এবং ব্যবস্থা নেওয়া হবে।”
প্রশাসন আগে থেকে উদ্যোগী হলে হয়ত বড় বিপর্যয় এড়ানো যেত বলে মনে করেন স্থানীয় বাসিন্দারা।
সুনীল দে বলেন, পাহাড় যে সংরক্ষণ করতে হবে এ নিয়ে প্রশাসন বা পাহাড় মালিক কারোরই কোনো মাথাব্যথা নেই।
ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় এবং বসতিকারীদের তালিকা তৈরি করে নিয়মিত তদারকির ব্যবস্থা নেওয়ার দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, অপরিকল্পিতভাবে পাহাড় কর্তনকারীদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিয়ে পাহাড় ও পাহাড়ের মানুষের সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।