চট্টগ্রামে এসেছিলেন রবীন্দ্রনাথ, নেই কোনো স্মৃতিচিহ্ন

১১০ বছর আগের এই দিনে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর দুই দিনের সফরে চট্টগ্রাম এসেছিলেন, কবি-সাহিত্যিকদের সঙ্গে বসার পাশাপাশি সংবর্ধনায় গেয়েছিলেন গান।

মিঠুন চৌধুরীমিঠুন চৌধুরীবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 June 2017, 02:42 PM
Updated : 17 June 2017, 02:43 PM

তবে তার সেই সফরের কোনো স্মৃতি চিহ্নই এখন বন্দরনগরীতে নেই।

নোবেলজয়ী একমাত্র বাঙালি সাহিত্যিকের চট্টগ্রাম ভ্রমণে জড়িয়ে ছিল নগরীর দুটি বাড়ি, চট্টগ্রামের প্রথম থিয়েটার হল এবং চট্টগ্রাম পুরাতন রেল স্টেশন।

এরমধ্যে সদরঘাট এলাকার কমলবাবুর থিয়েটার (অধুনালুপ্ত লায়ন সিনেমা হল), জেনারেল হাসপাতাল পাহাড়ের উত্তর দিকের কমলকান্ত সেনের দ্বিতল বাড়ি এবং নগরীর পার্সিভিল হিলের ‘দি প্যারেড’ নামের বাড়িটির কোনো অস্তিত্বই এখন আর নেই।

রবীন্দ্রনাথের স্মৃতি বিজড়িত একমাত্র স্থাপনা চট্টগ্রাম বটতলী রেল স্টেশনেও নেই সেই সফরের কোনো স্মৃতি স্মারক।

চট্টগ্রামে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের স্মৃতি বিজড়িত স্থানগুলো চিহ্নিত করে স্মৃতি স্মারক স্থাপনের দাবি জানিয়েছেন অধ্যাপক অনুপম সেন ও অধ্যাপক ভূঁইয়া ইকবাল।

বিশ্বভারতী গ্রন্থনবিভাগ থেকে প্রকাশিত সালাম আজাদ রচিত ‘রবীন্দ্র ভুবনে বাংলাদেশ’ গ্রন্থে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চট্টগ্রাম সফরের বর্ণনা আছে।

এছাড়া চট্টগ্রাম থেকে প্রকাশিত দৈনিক আজাদীর ৩৫তম বর্ষপূর্তিতে ১৯৯৫ সালে প্রকাশিত ‘হাজার বছরের চট্টগ্রাম’ নামের সংকলনেও এর বিবরণ দেয়া হয়েছে।

হাজার বছরের চট্টগ্রাম-এ লেখা হয়েছে, রবীন্দ্রনাথ দুদিনের সফরে চট্টগ্রামে এসেছিলেন ১৯০৭ সালের ১৭ জুন সোমবার। তার সফর সঙ্গী ছিলেন ভাইপো সুরেন্দ্রনাথ ঠাকুর ও বন্ধু কেদারনাথ দাশগুপ্ত।

“রবীন্দ্রনাথের চট্টগ্রাম আসার উদ্দেশ্য ছিল বঙ্গীয় সাহিত্য পরিষদের শাখা খোলার জন্য চট্টগ্রামের কবি সাহিত্যিকদের উৎসাহিত করা ও সুহৃদ যামিনীকান্ত সেনের আমন্ত্রণ রক্ষা।”

কলকাতা হাই কোর্টের উকিল যামিনীকান্ত সেন ছিলেন চট্টগ্রাম হিতসাধনী সভার অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা। পরে শান্তিনিকেতনে শিক্ষকতা করা যামিনীকান্ত রবীন্দ্রনাথকে চট্টগ্রামে অভ্যর্থনা কমিটির প্রধান ছিলেন।

সমাজবিজ্ঞানী অনুমপস সেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, ১৯০৭ সালের ১৭ জুন ভোরে খুব বৃষ্টি হচ্ছিল। বৃষ্টি উপক্ষো করে চট্টগ্রামের অনেক গুণীজন ও জনসাধারণ কবিকে অভ্যর্থনা জানাতে চট্টগ্রাম রেল স্টেশনে জড়ো হয়েছিলেন।

‘রবীন্দ্র ভুবনে বাংলাদেশ’ এ উল্লেখ আছে, রবীন্দ্রনাথের আগমন উপলক্ষে চট্টগ্রাম রেল স্টেশন কর্তৃপক্ষকে অনুরোধ করে ত্রিপুরাচরণ চৌধুরী ও কাজেম আলী মাস্টার প্রমুখের উদ্যোগে রেল স্টেশনটি ফুল ও পাতা দিয়ে সাজানো হয়।

অনুপম সেন বলেন, স্টেশন থেকে ঘোড়ার গাড়িতে করে কবিকে জেনারেল হাসপাতালের পাহাড়ের উত্তর দিকে যামিনীকান্ত সেনের বাবা কমলাকান্ত সেনের দুইতলা বাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়।

“সেই বাড়ির সামনের মাঠে সেদিন কবিকে দেখতে ও কথা বলতে অনেকেই জড়ো হয়েছিলেন। সেই বাড়ি আর নেই। বর্তমান জেমিসন রেডক্রিসেন্ট হাসপাতালের পাশেই ছিল সেই বাড়িটি।”

১৭ জুন সন্ধ্যায় চট্টগ্রাম কলেজের আইনের অধ্যাপক সাহিত্যিক রজনীরঞ্জন সেনের বাসায় চট্টগ্রামে সাহিত্য পরিষদ স্থাপনের বিষয়ে স্থানীয় কবি-সাহিত্যিকদের সাথে এক বৈঠকে মিলিত হন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।

চট্টগ্রাম জেনারেল হাসপাতালের উত্তর দিকে বর্তমান জেমিসন রেডক্রিমেস্ট হাসপাতাল এলাকায় ছিল কমলাকান্ত সেনের দুই তলা বাড়ি

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের সাবেক অধ্যাপক ড. ভূঁইয়া ইকবাল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, পার্সিভিল হিলে ‘দ্যা প্যারেড’ নামের যে বাড়িতে সেই সভা হয়েছিল সেই বাড়িটিও এখন নেই।

১৯০৭ সালের ১৮ জুন মঙ্গলবার সকালে কবি কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে শহর দেখতে বের হন এবং কর্ণফুলী নদীর তীরে জাহাজঘাটে গিয়ে কয়েকজন জাহাজের মাঝি-মাল্লার সাথে কথা বলেছিলেন বলে উল্লেখ আছে ‘হাজার বছরের চট্টগ্রাম’ গ্রন্থে।

ওইদিন বিকেলে নগরীর সদরঘাট এলাকায় সেসময়ের কমলবাবুর থিয়েটার হলে রবীন্দ্রনাথের সংবর্ধনার আয়োজন করা হয়।

ড. অনুপম সেন বলেন, চট্টগ্রামবাসীর সংবর্ধনার জবাবে কবিগুরু সেখানে ভাষণ দেন।

“সভার শেষদিকে আমার ঠাকুর দাদা ব্রজমোহন সেন কবিকে একটি গান করতে অনুরোধ করেন।উত্তরে কবিগুরু বলেছিলেন,আমি কবির (কবি শশাঙ্কমোহন সেন) পিতার (ব্রজমোহন সেন) আবদার অগ্রাহ্য করতে পারি না।”

ওই সভায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর একটি গান গেয়েছিলেন বলে জানান অনুপম সেন।

তিনি বলেন, পরবর্তীতে এই থিয়েটার হলটি লায়ন সিনেমা হল হিসেবে টিকে ছিল।

নগরীর সদরঘাট সড়কের অধুনালুপ্ত লায়ন সিনেমা হলের স্থানে এখন বহুতল ভবন নির্মিত হয়েছে।

অনুপম সেন বলেন, “কবিগুরুর ভ্রমণের কোনো স্মৃতিই আমরা ধরে রাখতে পারিনি। এটা আমাদের দীনতা। স্থানগুলো সঠিকভাবে চিহ্নিত করে স্মৃতি স্মারক স্থাপন করা এখনো সম্ভব।”

অধ্যাপক ভুঁইয়া ইকবাল বলেন, অন্য স্থাপনাগুলো না থাকলেও পুরাতন রেল স্টেশন এখনো আছে। সেখানে একটি স্মৃতি স্মারক স্থাপনে তো লাখ টাকার প্রয়োজন নেই।

“রেলওয়ে বা সিটি করপোরেশন উদ্যোগ নিলেই সেখানে রবীন্দ্রনাথের চট্টগ্রাম সফরের তথ্য সম্বলিত একটি স্মৃতি ফলক স্থাপন সম্ভব।”

১৮ জুন রাতে সফরসঙ্গীদের নিয়ে ট্রেনে করে চট্টগ্রাম ত্যাগ করেন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর।