শক্তি কমেছে মোরার

ঘণ্টায় একশ কিলোমিটারের বেশি গতির বাতাস নিয়ে উপকূল অতিক্রম করার পর স্থলভাগে এসে কমতে শুরু করেছে প্রবল ঘূর্ণিঝড় মোরার শক্তি।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 30 May 2017, 07:41 AM
Updated : 30 May 2017, 07:41 AM

মঙ্গলবার ভোরে মোরা উপকূলে আঘাত হানার পাঁচ ঘণ্টা পর বেলা সাড়ে ১১টার দিকে আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক সামছুদ্দিন আহমেদ এ তথ্য জানান।

তিনি বলেন, “আগামী ১২ ঘণ্টায় ঘূর্ণিঝড়টি আরও দুর্বল হয়ে স্থল নিম্নচাপে পরিণত হতে পারে। পরিস্থিতির উন্নতি হলে মহাবিপদ সংকেত নামিয়ে সমুদ্রবন্দরে তিন নম্বর স্থানীয় সতর্ক সংকেত দেখাতে বলা হবে।

তবে ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ভোর থেকে কক্সবাজার ও চট্টগ্রাম অঞ্চলে ভারি বৃষ্টির সঙ্গে যে ঝড়ো হাওয়া চলছে, তা আরও ১২ ঘণ্টা অব্যাহত থাকতে পারে। আর সাগরের পরিস্থিতি স্বাভাবিক হতে ২৪ ঘণ্টা সময় লাগতে পারে বলে আভাস দেন তিনি।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব গোলাম মোস্তাফা জানিয়েছেন, প্রাথমিকভাবে কুতুবদিয়া, কক্সবাজার, টেকনাফ, সেন্টমার্টিন ও চট্টগ্রামে কাঁচা ঘরবাড়ি বিধ্বস্ত এবং গাছপালা ভেঙে পড়ার খবর পেয়েছেন তারা।

ঝড়ে প্রাণহানির কোনো খবর না এলেও কক্সবাজার শহরের একটি আশ্রয়কেন্দ্রে হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে এক বৃদ্ধর মৃত্যু হয়েছে বলে স্থানীয় প্রশাসন জানিয়েছে।

 

>> আবহাওয়া অফিস চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্র বন্দরে ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেত এবং মংলা ও পায়রা সমুদ্র বন্দরকে ৮ নম্বর মহাবিপদ সংকেত দেখিয়ে যেতে বলেছে।

>> উপকূলীয় জেলা কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর এবং অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলো ১০ নম্বর মহাবিপদ সংকেতের আওতায় রয়েছে।

>> ভোলা, বরগুনা, পটুয়াখালী, বরিশাল, পিরোজপুর, ঝালকাঠি, বাগেরহাট, খুলনা, সাতক্ষীরা এবং অদূরবর্তী দ্বীপ ও চরগুলোর ক্ষেত্রে ৮ নম্বর মহাবিপদ সংকেত প্রযোজ্য হবে।

>> সাগর উত্তাল থাকায় সব মাছ ধরার নৌকা ও ট্রলারকে পরবর্তী নির্দেশ না দেওয়া পর্যন্ত নিরাপদ আশ্রয়ে থাকতে বলেছে আবহাওয়া অধিদপ্তর।

মোরার প্রভাবে উপকূলীয় জেলাগুলোর নিম্নাঞ্চল স্বাভাবিক জোয়ারের চেয়ে ৪ থেকে ৫ ফুট বেশি উচ্চতার জলোচ্ছ্বাসে প্লাবিত হতে পারে বলে আভাস দিয়ে রেখেছিল আবহাওয়া অফিস। তবে ভাটার সময় ঝড়টি উপকূল অতিক্রম শুরু করায় জলোচ্ছ্বাস ভয়ঙ্কর হয়ে উঠতে পারেনি বলে কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের এনডিসি তাহমিদুর রহমান জানিয়েছেন।

তিনি বলেন, “সকাল থেকে প্রবল বেগে ঝড়ো হাওয়ার সঙ্গে বৃষ্টি হয়েছে। বেশ কিছু কাঁচাঘর ও গাছপালা বিধ্বস্ত হয়েছে।”

দুর্যোগপূর্ণ আবহাওয়ার কারণে চট্টগ্রাম বন্দরের সব কার্যক্রম বন্ধ রাখা হয়েছে। বিআইডব্লিউটিএ সোমবার বিকাল থেকেই সারা দেশে সব ধরনের নৌযান চলাচল বন্ধ রেখেছে। মঙ্গলবার সকাল থেকে চট্টগ্রামের শাহ আমানত ও কক্সবাজার বিমানবন্দরে উড়োজাহাজ ওঠা-নামাও বন্ধ।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তা জলিল উদ্দিন ভুঁইয়া জানান, ছয় জেলায় ৩ লাখ ১৭ হাজারের বেশি লোককে রাতেই নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। বেলা ১০টা পর্যন্ত হতাহতের কোনো তথ্য তারা পাননি।

গতিপথ

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক জানান, মঙ্গলবার ভোর ৬টার দিকে প্রবল ঘূর্ণিঝড় মোরা কক্সবাজার-চট্রগ্রাম উপকূল অতিক্রম শুরু করে। ওই সময় বাতাসের গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১০০ কিলোমিটারের বেশি।

আবহওয়ার সর্বশেষ বুলেটিনে বলা হয়, ঘূর্ণিঝড় কেন্দ্রের ৬৪ কিলোমিটারের মধ্যে বাতাসের একটানা সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘন্টায় ৮৯ কিলোমিটার, যা দমকা বা ঝড়ো হাওয়ার আকারে ১১৭ কিলোমিটার পর্যন্ত বৃদ্ধি পাচ্ছিল।

তবে জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ আবদুর রহমান খান জানিয়েছেন, ঘূর্ণিঝড়টির অগ্রভাগ ভোর ৬টার দিকে যখন সেন্টমার্টিন-টেকনাফ উপকূল স্পর্শ করে, সে সময় টেকনাফে বাতাসের সর্বোচ্চ গতিবেগ ছিল ঘণ্টায় ১৩৫ কিলোমিটার।

আর সেন্টমার্টিন ও কক্সবাজারে ১১৪ কিলোমিটার, চট্টগ্রামে ১২৮ কিলোমিটার এবং কুতুবদিয়ায় ৮৪ কিলোমিটার পর্যন্ত বাতাসের গতি রেকর্ড করা হয়।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের পরিচালক সামছুদ্দিন আহমেদ জানান, মোটামুটি ২০০ কিলোমিটার ব্যাসের ঘূর্ণিঝড়টি বেলা সাড়ে ১১টার দিকে ভোলা, হাতিয়া, সন্দ্বীপ, কুতুবদিয়া, নোয়াখালী, চাঁদপুর, চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার অঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকাজুড়ে অবস্থান করছিল। ঝড়ের কেন্দ্রে বা চোখ ততক্ষণে স্থলভাগে উঠে এসেছে।

“ঘূর্ণিঝড়টি এখন চট্টগ্রাম উপকূল অতিক্রম করছে। এটি আরও উত্তর দিকে অগ্রসর হবে। স্থলভাগে এটি নিম্নচাপে পরিণত হবে। এরপর ধীরে ধীরে দুর্বল হয়ে পড়বে।”

বর্তমানে মোরার যে গতিপথ, তাতে বাংলাদেশ পার হয়ে ত্রিপুরা, মনিপুর, মেঘালয় পর্যন্ত এর প্রভাব থাকতে পারে। আবার বাংলাদেশের সীমানার ভেতরেই এটি দুর্বল হয়ে যেতে পারে বলে সামছুদ্দিন আহমেদ জানান।

ভারতের আবহাওয়া অধিদপ্তরের পূর্বাভাসে বলা হয়েছে, বাংলাদেশ সময় সন্ধ্যা ৬টা নাগদ ঘূর্ণিঝড়টি দুর্বল হয়ে গভীর নিম্নচাপে পরিণত হতে পারে। আর মধ্যরাতের মধ্যেই তা পরিণত হতে পারে লঘুচাপে।

ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে ভারতের আসাম, মিজোরাম, মেঘালয় ও ত্রিপুরাতেও বৃষ্টির পূর্বাভাস রয়েছে।

প্রবল বৃষ্টি ঝরাবে মোরা

বুয়েটের ইন্সটিটিউট অব ওয়াটার অ্যান্ড ফ্লাড ম্যানেজমেন্ট (আইডব্লিউএফএম)-এর পর্যবেক্ষণে বলা হয়েছে, ঘূর্ণিঝড়ের প্রভাবে মঙ্গলবার সকাল থেকে পরবর্তী ২৪ ঘণ্টায় কক্সবাজার ও আশপাশের এলাকায় ১২৮ মিলিমিটার থেকে ২৫৬ মিলিমিটার পর্যন্ত বৃষ্টি হতে পারে।

ইনস্টিটিউটের সিনিয়র রিসার্চ ফেলো মোহন কুমার দাস বলেন, “সাগরে দক্ষিণ-পশ্চিম মৌসুমী বায়ু কার্যকর রয়েছে। সেই সঙ্গে ভারি জলীয় বাষ্প নিয়ে ঘূর্ণিঝড়টি উপকূল অতিক্রম করার পথে অতি ভারি বর্ষণ হতে পারে।”

৬৫ থেকে ১১৪ মিলিমিটার বৃষ্টিপাতকে তাকে ‘ভারি বর্ষণ’, ১১৫ থেকে ২০৫ মিলিমিটার পর্যন্ত ‘অতি ভারি বর্ষণ’ এবং ২০৫ মিলিমিটারের বেশি হলে তাকে ‘চরম ভারি বর্ষণ’ বলেন আবহাওয়াবিদরা।

প্রতিজেলায় ১০ লাখ টাকা বরাদ্দ

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব গোলাম মোস্তাফা জানান, ঘূর্ণিঝড় মোকাবেলায় রাতভর ব্যাপক প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে।

ভোর রাত পর্যন্ত তিন লাখের বেশি মানুষকে আশ্রয় কেন্দ্রে সরিয়ে নেওয়া হয়েছে। দুযোগ পরবর্তী পরিস্থিতি মোকাবেলায় প্রতি জেলায় ১০ লাখ টাকা করে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ কক্ষ সবসময় পরিস্থিতি জেনে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিচ্ছে এবং স্বেচ্ছ্বাসেবক দলের কাজ তদারক করছে।

“কোনোভাবেই জীবনের যাতে ক্ষতি না হয় সে চেষ্টা করছি আমরা। সাময়িকভাবে মালামালের ক্ষতি হলেও তা পুষিয়ে নেওয়ার চেষ্টা করা হবে।”