ঘূর্ণিঝড় মোরা: আশ্রয়কেন্দ্রে কয়েক লাখ মানুষ

প্রবল ঘূর্ণিঝড় ‘মোরা’ ধেয়ে আসতে থাকায় মহাবিপদ সংকেত জারির পর দেশের উপকূলীয় জেলাগুলোর নিচু এলাকায় ঝুঁকিতে থাকা মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে চলছে মরিয়া চেষ্টা।

জ্যেষ্ঠ প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 29 May 2017, 04:26 PM
Updated : 29 May 2017, 07:47 PM

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব গোলাম মোস্তফা জানিয়েছেন, উপকূলীয় ১৯ জেলার মধ্যে দশটি জেলাকে তারা এই ঝড়ের ক্ষেত্রে সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বলে বিবেচনা করছেন।

সোমবার রাত ৯টা পর্যন্ত এসব জেলার প্রায় তিন লাখ মানুষকে তারা আশ্রয়কেন্দ্রে সরিয়ে নিতে পেরেছেন এবং প্রতিটি এলাকায় মাইকিং করে সবাইকে নিরাপদ আশ্রয়ে চলে যেতে বলা হচ্ছে। 

প্রায় ২০০ কিলোমিটার ব্যাসের এই ঘূর্ণিঝড় সোমবার সন্ধ্যায় বাংলাদেশ উপকূলের ৩০০ কিলোমিটারের মধ্যে পৌঁছে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ে পরিণত হলে চট্টগ্রাম ও কক্সবাজার সমুদ্র বন্দরের জন্য ১০ নম্বর এবং পায়রা ও মোংলা বন্দরের জন্য ৮ নম্বর মহাবিপদ সংকেত জারি করে আবহওয়া অধিদপ্তর।

আবহাওয়া অধিদপ্তরেরর পরিচালক সামছুদ্দিন আহমেদ জানান, ঘণ্টায় ৮৯ থেকে ১১৭ কিলোমিটার শক্তির ঝড়ো হাওয়া নিয়ে ঘূর্ণিঝড় মোরা মঙ্গলবার সকাল ৬টা নাগাদ কক্সবাজার-চট্টগ্রাম উপকূল অতিক্রম করতে পারে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় দুপুরে ঢাকায় সংবাদ সম্মেলন করে সন্ধ্যার মধ্যে ঝূঁকিপূর্ণ এলাকার বাসিন্দাদের আশ্রয়কেন্দ্রে আনার নির্দেশ দেয়। জেলায় জেলায় মাইকিং করে স্থানীয় বাসিন্দাদের সরে যাওয়ারও পরামর্শ দেওয়া হয় সে সময় থেকেই।

কিন্তু তখন সংকেত কম থাকায় এবং আবহাওয়া ততটা প্রতিকূল না হওয়ায় অনেকেই ঘরবাড়ি ছেড়ে আশ্রয় কেন্দ্রে যাওয়ার আগ্রহ দেখাননি বলে আমাদের জেলা প্রতিনিধিরা জানান।

সন্ধ্যায় মহাবিপদ সংকেত জারি হলে ঝুঁকিপূর্ণ এলাকাগুলো থেকে বাসিন্দারা ঘূর্ণিঝড় আশ্রয়কেন্দ্রে যেতে শুরু করেন। রাত ৮টার পর স্থানীয় প্রশাসনের তৎপরতায় বসিন্দাদের সরিয়ে নেওয়ার কাজ আর গতি পায়।

বাগেরহাটের জেলা প্রশাসক তপন কুমার বিশ্বাস জানান, রাত ১০টা নাগাদ শরণখোলা এবং মোংলা উপজেলার ১৫ হাজার মানুষ আশ্রয়কেন্দ্রে নিতে পেরেছেন তারা। এর মধ্যে শরণখোলার ৮২টি আশ্রয়কেন্দ্রে ১৩ হাজার এবং মোংলার ৩৪টি আশ্রয়কেন্দ্রে দুই হাজার মানুষ আশ্রয় নিয়েছেন।

 >> দেশের ১৯ জেলার ১৪৭টি উপজেলার ১৩ হাজার ৫০০ বর্গকিলোমিটার এলাকা উপকূলীয় এলাকা হিসেবে চিহ্নিত; সেখানে প্রায় ১ কোটি ৮০ লাখ মানুষের বসবাস।

>> এর মধ্যে কক্সবাজার, চট্টগ্রাম, নোয়াখালী, লক্ষ্মীপুর, ফেনী, চাঁদপুর, বরগুনা, পটুয়াখালী, ভোলা, বরিশাল ও পিরোজপুর- এই ১০ জেলাকে চিহ্নিত করা হয়েছে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে।

>>  দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের নিয়ন্ত্রণ কক্ষের কর্মকর্তা উপ পরিচালক ইশান আলী রাজা বাঙালি জানান, ঝুঁকিপূর্ণ এই দশ জেলার ২৫ লাখেরও বেশি লোকের মধ্যে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত উপজেলাগুলোর কয়েক লাখ মানুষকে নিরাপদ আশ্রয়ে সরিয়ে নিতে কাজ চলছে। প্রচার করা হচ্ছে সতর্কবার্তা।

>> উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে ঘূর্ণিঝড় প্রস্তুতি কমিটির (সিপিপি) ৫৫ হাজার স্বেচ্ছাসেবক ছাড়াও রেড ক্রিসেন্ট সোসাইটি, রোভার স্কাউট ও আনসার ভিডিপির কর্মীরা এই দুর্যোগ মোকাবিলায় কাজ করছেন একসঙ্গে।

>> দেশে সব মিলিয়ে সাইক্লোন শেল্টার রয়েছে সাড়ে ৩ হাজারের বেশি। এছাড়া আরও কয়েক হাজার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানকেও প্রস্তুত রাখা হয়েছে আশ্রয়কেন্দ্র হিসেবে ব্যবহারের জন্য।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা অধিদপ্তরের পরিচালক অতিরিক্ত সচিব আবু সৈয়দ মোহাম্মদ হাশিম বলেন, সম্ভাব্য দুর্যোগ মোকাবেলায় ‘সব ধরনের প্রস্তুতি’ তারা রেখেছেন। লোকজনকে সরিয়ে নিতে স্বেচ্ছাসেবীদের পাশাপাশি আইন শৃঙ্খলাবাহিনীর সদস্য ও জনপ্রতিনিধিদেরও কাজে লাগানো হচ্ছে।

উপকূলীয় এলাকার বিভাগীয় কমিশনার ও জেলা প্রশাসকদের শুকনো খাবার ও খাবার পানি প্রস্তুত রাখতে বলা হয়েছে। তাদের চাহিদা অনুযায়ী খাদ্যও বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ।

জেলা-উপজেলা-ইউনিয়ন পর্যায়ের দুর্যোগ মোকাবেলা সংক্রান্ত কমিটিকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দিতে কর্মকর্তাদের নিজ নিজ কর্মস্থলে থাকার নির্দেশনা দিয়েছে দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়। চিকিৎসা কর্মকর্তাদের ছুটি বাতিল করে উপকূলীয় জেলাগুলোতে প্রস্তুত রাখা হয়েছে মেডিকেল টিম।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, মন্ত্রণালয়ের সঙ্গ জেলা-উপজেলার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষার জন্য মন্ত্রণালয় ও অধিদপ্তরে নিয়ন্ত্রণ কক্ষ খোলা হয়েছে। উপকূলীয় এলাকায় উদ্ধার তৎপরতা চালানোর জন্য পর্যাপ্ত নৌযান প্রস্তত রাখতে বলা হয়েছে জেলা প্রশাসকদের।

আবহাওয়া অধিদপ্তরের সংকেত অনুযায়ী সমুদ্রে থাকা সব জাহাজ ও ট্রলারকে নিরাপদ আশ্রয়ে নিয়ে আসতে বলা হয়েছে।

চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (সার্বিক) মোহাম্মদ মাসুকুর রহমান সিকদার জানান, তার জেলার ১৪টি উপজেলার সব কটিতেই মাইকিং করা হচ্ছে; খুলে দেওয়া হয়েছে ৪৭৯টি আশ্রয়কেন্দ্র।

এছাড়া স্থানীয় চার শতাধিক স্কুল-কলেজ-মাদ্রাসা এবং উপজেলা ও ইউনিয়ন কমপ্লেক্স ভবনও প্রস্তুত রাখতে বলা হয়েছে। প্রয়োজনে সেখানেও মানুষ আশ্রয় নিতে পারবে।

“স্থানীয় ব্যবসায়ীদেরও বলা হয়েছে প্রয়োজনে দ্রুত খাদ্য পণ্য সরবরাহ করতে। আমরা মূল্য পরিশোধ করব। দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।”

মোট ৬ হাজার ৬০০ জন স্বেচ্ছাসেবীকে চট্টগ্রামের উপকূলীয় উপজেলাগুলোতে উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে।

জানিয়ে অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক মাসুকুর রহমান সিকদার বলেন, আশাকরি যত লোক আশ্রয় কেন্দ্রে আসবে তাদের আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা সম্ভব হবে।

কক্সবাজারের জেলা প্রশাসক মো. আলী হাসান জানান, তার জেলাতেও রেড ক্রিসেন্টের ১৫ হাজার স্বেচ্ছাসেবীর পাশাপাশি বিভিন্ন  বাহিনীর সদস্যদের উদ্ধার ও ত্রাণ তৎপরতার জন্য প্রস্তুত রাখা হয়েছে। আশ্রয়কেন্দ্রে যাওয়া মানুষের জন্য পর্যাপ্ত শুকনো খাবারের ব্যবস্থাও করা হয়েছে।

[আমাদের চট্টগ্রাম ব্যুরো ও সংশ্লিষ্ট জেলা প্রতিনিধিরা তথ্য দিয়ে এ প্রতিবেদন তৈরিতে সহযোগিতা করেছেন]