এর মধ্য দিয়ে মৌলবাদী শক্তিকে আরও প্রশ্রয় দেওয়া হয়েছে এবং তারা এখন রাজনৈতিক ইস্যু তৈরি করবে বলে শঙ্কা প্রকাশ করেছেন অনেকে।
ওই ভাস্কর্যটি সরিয়ে নিতে হেফাজতের দাবির প্রতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সায় দেওয়ার পর ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ জোট শরিক জাসদ যে প্রতিক্রিয়া জানিয়েছিল, তা থেকে সরে এসেছে দলটি। তবে সরকারের আরেক শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি তীব্র প্রতিবাদ জানিয়ে একে হেফাজতসহ মৌলবাদীদের কাছে ‘নির্লজ্জ আত্মসমর্পণ’ বলছে।
প্রতিবাদ জানিয়েছে বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি-সিপিবি, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদসহ বামপন্থি দলগুলো। বিক্ষোভ করেছেন গণজাগরণ মঞ্চ এবং ছাত্র ইউনিয়ন, ছাত্র ফ্রন্ট, ছাত্র মৈত্রীসহ বিভিন্ন ছাত্র ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের কর্মীরা।
সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে স্থাপিত রোমান যুগের ন্যায়বিচারের প্রতীক লেডি জাস্টিসের আদলে গড়া ভাস্কর্যটি সরানো হয়বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে ।
কয়েক মাস আগে সুপ্রিম কোর্টের উদ্যোগে ভাস্কর্যটি স্থাপনের পর তা অপসারণের দাবিতে আন্দোলনে নামে হেফাজতে ইসলাম। গত ১১ এপ্রিল গণভবনে হেফাজত আমির শাহ আহমদ শফীসহ একদল ওলামার সঙ্গে বৈঠকে তাদের দাবির প্রতি সমর্থন জানিয়ে ভাস্কর্য অপসারণে পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা।
তবে শুক্রবার জাসদ সভাপতি ও তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সুপ্রিম কোর্টের প্রাঙ্গণটি প্রধান বিচারপতির এখতিয়ারভুক্ত এলাকা। ভাস্কর্য অপসারণ নিয়ে সরকারের করার কিছুই নেই।”
এই বক্তব্যই দিয়েছেন ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এবং বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মওদুদ আহমদ।
কাদের বলেছেন, “গ্রিক দেবীর মূর্তি অপসারণের ক্ষমতা সরকারের কোনো এখতিয়ারে নেই। মূর্তি সরানো সুপ্রিম কোর্টের সিদ্ধান্ত।”
এই ঘটনায় ক্ষোভ প্রকাশ করে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন জোটের শরিক ওয়ার্কার্স পার্টি এক বিবৃতিতে বলেছে, “ভাস্কর্য অপসারণ হেফাজতসহ মৌলবাদীদের কাছে নির্লজ্জ আত্মসমর্পণ। দুর্ভাগ্যজনকভাবে বিতর্কটি ভাস্কর্য বনাম মূর্তিতে রূপান্তর করা হয়েছে।
“আসলে এর সাথে ধর্মের কোনো সম্পর্ক নেই। এই পশ্চাদপসারণ জাতির জন্য দুর্ভাগ্যজনক।”
বামপন্থি দল দুটি বলছে, “ক্ষমতায় টিকে থাকা এবং পুনরায় ক্ষমতায় ফিরে আসার জন্য সমর্থনের আশায় বর্তমান সরকার সাম্প্রদায়িক শক্তির সাথে আপসের যে পথে গেছে তা আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের জন্য ভয়ানক বিপর্যয় ডেকে আনছে।”
সরকারের সাম্প্রদায়িক শক্তির কাছে ‘নতি স্বীকারের’ রাজনীতি রুখে দিতে জনগণের প্রতি আহ্বান জানিয়েছে তারা।
ভাস্কর্য অপসারণের প্রতিবাদে প্রেস ক্লাবের সামনে এক সমাবেশে ‘ভোটের স্বার্থে মৌলবাদ তোষণনীতির’ ভয়াবহ পরিণতি সম্পর্কে সতর্ক করেছেন বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দলের (মার্কসবাদী) নেতারা।
এক বিবৃতিতে বাসদের সাধারণ সম্পাদক খালেকুজ্জামান বলেছেন, “হেফাজতে ইসলাম, আওয়ামী ওলামা লীগসহ ধর্মান্ধ ধর্মব্যবসায়ী ও রাজনৈতিক ফিকিরবাজ সংগঠন ও সংস্থার দাবি ও চাপে শাসক দল ভোটের সমীকরণে প্রতারণামূলক কৌশলে এ কাজ করিয়েছে।”
যুক্ত বিবৃতিতে তারা বলেন, “আমরা ক্ষুব্ধ এবং প্রগতিবিরোধী এহেন হীনকর্মে গভীর ক্ষোভ ও ঘৃণা প্রকাশ করছি। এই অপসারণ কর্মের মধ্য দিয়ে মুক্তিযুদ্ধে নেতৃত্বদানকারী রাজনৈতিক দল কর্তৃক গঠিত সরকার কার্যত ধর্মান্ধ মৌলবাদী অপশক্তির কাছে নতি স্বীকার করেছে।”
ভাস্কর্য অপসারণের দাবিকারী হেফাজতে ইসলামকে ইঙ্গিত করে বিবৃতিতে বলা হয়, “এই সাম্প্রদায়িক অপশক্তি মুক্তিযুদ্ধের গৌরবের প্রতীক ‘অপরাজেয় বাংলা’ ধ্বংসের উদ্দেশ্যে ব্যর্থ আক্রমণ করেছিল। এরাই ‘দুরন্ত শিশু’ ভাস্কর্য রাতের আঁধারে নিশ্চিহ্ন করেছিল।
“এরাই বর্তমানে মুক্তিযুদ্ধের অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশকে একটি ধর্মান্ধ মৌলবাদী রাষ্ট্র হিসেবে পরিণত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত।”
ভাস্কর্য অপসারণে ক্ষোভ প্রকাশ করে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বলেছেন, হেফাজত এখন রাজনৈতিক ইস্যু তৈরি করবে এবং তাদের চাপ আরও বাড়তে থাকবে।
এই ভাস্কর্যকে কেন্দ্র করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উপর আঘাত করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবিতে সোচ্চার শাহরিয়ার কবির।
ভাস্কর্যটি যে প্রক্রিয়ায় সরানো হয়েছে তার সমালোচনা করে চিত্রশিল্পী নিসার হোসেন বলেছেন, ভাস্কর্য বাংলাদেশের কোথায় থাকবে, কোথায় থাকবে না, তা যারা এদেশ চায়নি তাদের কথা মতো হবে না।
মধ্যরাতে ওই ভাস্কর্য অপসারণের কাজ চলার মধ্যেই সুপ্রিম কোর্টের ফটকের সামনে বিক্ষোভ করেন গণজাগরণ মঞ্চ ও কয়েকটি ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা।
শুক্রবার দিনভরও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিক্ষোভসহ নানা কর্মসূচি পালিত হয়।