হেফাজতের চাপ ‘আরও বাড়বে’

হেফাজতে ইসলামের দাবির মুখে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ভাস্কর্য অপসারণে ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন শীর্ষস্থানীয় চারজন লেখক, অধ্যাপক ও সংস্কৃতিকর্মী।

জয়ন্ত সাহাবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 26 May 2017, 05:52 PM
Updated : 26 May 2017, 07:46 PM

হেফাজত এখন রাজনৈতিক ইস্যু তৈরি করবে এবং তাদের চাপ আরও বাড়তে থাকবে বলে মনে করছেন লেখক-অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী।

এ ঘটনায় উদ্বেগ জানিয়ে সংস্কৃতিকর্মী কামাল লোহানী বলেছেন, দেশ কোন পথে এগোচ্ছে সে বিষয়ে এখন ভাবার সময় হয়েছে।

এই ভাস্কর্যকে কেন্দ্র করে মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উপর আঘাত করা হয়েছে বলে মন্তব্য করেছেন যুদ্ধাপরাধের বিচার দাবিতে সোচ্চার শাহরিয়ার কবির।

ভাস্কর্যটি যে প্রক্রিয়ায় সরানো হয়েছে তার সমালোচনা করে চিত্রশিল্পী নিসার হোসেন বলেছেন, ভাস্কর্য বাংলাদেশের কোথায় থাকবে, কোথায় থাকবে না, তা যারা এদেশ চায়নি তাদের কথা মতো হবে না।

বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে স্থাপিত রোমান যুগের ন্যায়বিচারের প্রতীক লেডি জাস্টিসের আদলে গড়া ভাস্কর্যটি সরানো হয়।কয়েক মাস আগে সুপ্রিম কোর্টের উদ্যোগে ভাস্কর্যটি স্থাপনের পর তা অপসারণের দাবিতে আন্দোলনে নামে হেফাজতে ইসলাম।

তাদের দাবিতে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সমর্থন প্রকাশের পর রোজার তিন দিন আগে ভাস্কর্যটি সরিয়ে নেওয়া হল।

মধ্যরাতে ওই ভাস্কর্য অপসারণের কাজ চলার মধ্যেই সুপ্রিম কোর্টের ফটকের সামনে বিক্ষোভ করেন গণজাগরণ মঞ্চ ও কয়েকটি ছাত্র সংগঠনের নেতাকর্মীরা।

ভাস্কর্য অপসারণের প্রতিবাদে শুক্রবার দিনভর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় বিক্ষোভসহ নানা কর্মসূচি পালিত হয়।

সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ভাস্কর্য অপসারণের প্রতিবাদে শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় মশাল মিছিল করেন গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরা।

এ বিষয়ে প্রতিক্রিয়া জানতে চাইলে অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “কোনোভাবেই সুপ্রিম কোর্টের সামনে থেকে ভাস্কর্য অপসারণ করা ঠিক হয়নি। ভাস্কর্য যেমন একটি প্রতীক, এর অপসারণও একটি প্রতীক।”

অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী

হেফাজতে ইসলামের চাপের কারণে এই ভাস্কর্য অপসারণের কথা তুলে ধরে তিনি বলেন, “এর ফলে তাদের চাপ আরও বাড়বে এবং হেফাজত রাজনৈতিক ইস্যু তৈরি করবে। এটা করতে দেওয়া ঠিক হবে না। তারা দর কষাকষি করতেই থাকবে। এক দলের কাছ থেকে সুযোগ নিয়ে, আরেক দলের কাছ থেকেও সুযোগ নিতে চাইবে। তারা এভাবেই নিজেদের শক্তি সংহত করছে। এ ভাস্কর্য অপসারণ করা গ্রহণযোগ্য নয়, এটা দুঃখজনক।”

মধ্যরাতে ভাস্কর্য অপসারণ লজ্জাজনক মন্তব্য করে কামাল লোহানী বলেন, “মুক্তিযুদ্ধের চেতনার পক্ষ দাবি করা সরকার এখন মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক অপশক্তির সঙ্গে আপস করছে।

কামাল লোহানী

“আমরা কোন পথে যাচ্ছি, সেটা ভাবতে হবে। বঙ্গবন্ধু বাহাত্তরের সংবিধানে যে ধর্মনিরপেক্ষতার কথা রেখেছিলেন, সেটির সুযোগ থাকা সত্ত্বেও এ সরকার ফিরিয়ে আনেনি।হেফাজতে ইসলামের দাবির প্রেক্ষিতে এই ভাস্কর্য অপসারণের পূর্বে পাঠ্যপুস্তকেও পরিবর্তন আনা হয়েছে।”

হেফাজতে ইসলামের দাবিতে সরকার প্রধান সায় দেওয়ার পর আইনজীবীদের মতামত নিয়েই সুপ্রিম কোর্টের মূল প্রাঙ্গণ থেকে ভাস্কর্য সরানোর সিদ্ধান্ত নেন প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহা।

তার এই সিদ্ধান্তের সমালোচনা করে একাত্তরের ঘাতক দালাল নির্মূল কমিটির ভারপ্রাপ্ত সভাপতি শাহরিয়ার কবির বলেছেন, “কাজটাতো করেছেন প্রধান বিচারপতি। তার নির্দেশনা ছাড়াতো সুপ্রিম কোর্টের ভাস্কর্যের গায়ে হাত দেওয়ার ক্ষমতা কারও নেই। তিনি কেনইবা এটা বসালেন কেনইবা এটা সরালেন? এটা সরিয়ে তিনি যেটা করলেন হেফাজতের দাবির কাছে নতি স্বীকার করলেন।”

এসকে সিনহা প্রধান বিচারপতি হওয়ার পর হিন্দু বলে তার বিরোধিতা করেছিল হেফাজতে ইসলাম।

সে কথা স্মরণ করিয়ে দিয়ে শাহরিয়ার কবির বলেন, “হেফাজত ভবিষ্যতে দাবি করবে শরিয়া আইন চালু করতে হবে। হিন্দু প্রধান বিচারপতি থাকতে পারবে না। প্রধান বিচারপতি কি তাহলে এরপর তার পদ থেকে পদত্যাগ করবেন? এটাওতো তাদের দাবি।

“কেন তিনি এটা করতে গেলেন? রাজনৈতিক দল তাদের রাজনৈতিক মতলবে বিভিন্ন সময় মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক অপশক্তির সঙ্গে আপস করে- বিএনপি করেছে, এখন আওয়মী লীগও করছে। সেটার জন্য তাদের জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হবে। কিন্তু প্রধান বিচারপতি যদি হেফাজতের দাবির কাছে নতি স্বীকার করেন, তাহলে আমরা যাব কোথায়?”

শাহরিয়ার কবির বলেন, “সৌদি আরব থেকে মিশর, ইরাক, ইরান সবখানেই ভাস্কর্য আছে। এখানে ভাস্কর্যটাই উপলক্ষ না। ভাস্কর্যকে কেন্দ্র করে তারা যেটা করছে আমাদের মুক্তিযুদ্ধের চেতনার উপর আঘাত করছে। আমাদের বাংলাদেশের স্বাধীন সার্বভৌম অস্তিত্বের উপর আঘাত হানছে। কারা এরা? হেফাজত হচ্ছে সেই সংগঠন একাত্তরে যাদের বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের সম্পৃক্ততা রয়েছে, তাদের নেতা আহমেদ শফিসহ।

“তারা এখানে জঙ্গি মৌলবাদীদের গডফাদার। এরকম সন্ত্রাসী মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক, গণহত্যাকারীদের সংগঠনের দাবি মেনে নিয়ে প্রধান বিচারপতি এটা সরালেন। আমাদের প্রধান বিচারপতির দায়িত্ব কি হেফাজতের এজেন্ডা বাস্তবায়ন করা?”

অধ্যাপক নিসার হোসেন

এভাবে ভাস্কর্য অপসারণের নিন্দা জানিয়ে চারুকলা অনুষদের ডিন অধ্যাপক নিসার হোসেন বলেন, “শিল্পের দিক থেকে সুপ্রিম কোর্টের সামনের ভাস্কর্যটি কুরুচিপূর্ণ, সেজন্য সেখানে এটি থাকা আমি নিজেও সমর্থন করি না। কিন্তু যে প্রক্রিয়ায় অপসারণ করা হয়েছে, সেটি কাম্য নয়।

“আমরা ভেবেছিলাম একটি কমিটি করে সুন্দর ভাস্কর্য তৈরি করে অপসারণ করা হবে। কিন্তু আদতে সেটি হয়নি। আমি এ দেশের রাস্তার মোড়ে মোড়ে ভাস্কর্য দেখতে চাই। কিন্তু কোথায় থাকবে, কোথায় থাকবে না, তা যারা এদেশকে চায়নি তাদের কথা মতো হবে না।

“যে কারণে সরকার পাঠ্যপুস্তকে সাম্প্রদায়িকীকরণ করেছে, একইভাবে এ ভাস্কর্য অপসারণ করা হয়েছে।”