বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে ভাস্কর্যটি অপসারণের কাজ শুরুর খবর প্রকাশের ঘণ্টা দেড়েকের মধ্যে সুপ্রিম কোর্টের তালাবদ্ধ মূল ফটকের বাইরে সমবেত হন অর্ধশতাধিক ছাত্র-জনতা।
‘ন্যায়বিচারের ভাস্কর্য অপসারণ করা যাবে না’, ‘রাজাকারের আস্তানা, ভেঙে ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও’, ‘মৌলবাদের আস্তানা, ভেঙে দাও জ্বালিয়ে দাও’, ‘বীর বাঙালির হাতিয়ার, গর্জে ওঠো আরেকবার’, ‘মুক্তিযুদ্ধের হাতিয়ার, গর্জে ওঠো আরেকবার’ ‘শেখ হাসিনা সরকার মৌলবাদের পাহারাদার’, ‘যে সরকার ভাস্কর্য সরায়, সেই সরকার চাই না’, ‘একাত্তরে বাংলায় হেফাজতের ঠাঁই নাই’ প্রভৃতি স্লোগান দিতে থাকেন তারা।
সরকারের শরিক দল ওয়ার্কার্স পার্টির ছাত্র সংগঠন ছাত্রমৈত্রীর সাবেক সাধারণ সম্পাদক তানভীর রুসমতসহ ১৫-২০ বিক্ষোভ মিছিল শুরু করে সোয়া ১টার দিকে।
অ্যাক্টিভিস্ট জীবনানন্দ জয়ন্তসহ গণজাগরণ মঞ্চের কর্মীরাও বিক্ষোভ মিছিল করেছে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি রাজু ভাস্কর্য থেকে রাত দেড়টার দিকে ছাত্র ইউনিয়ন ও সমাজতান্ত্রিক ছাত্র ফ্রন্টের নেতাকর্মীরা একটি বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে সুপ্রিম কোর্টের মূল ফটকে যায়।
রাত আড়াইটার দিকে সুপ্রিম কোর্টের সামনের সড়কের একপাশে যান চলাচল বন্ধ করে দেয় বিক্ষোভকারীরা।
এক পর্যায়ে তারা সুপ্রিম কোর্টের ফটক ধরে ধাক্কাধাক্কি শুরু করলে হ্যাজবল খুলে যায়। পরে পুলিশ ভেতরে থেকে গেইটে অবস্থান নেয়। কিছুক্ষণ বাদে শাহবাগ থানা থেকে দুই ভ্যান পুলিশ এসে অবস্থান নেয় ফটকের বাইরে।
বাইরে বিক্ষোভের মধ্যে আশপাশের বাতি নিভিয়ে চলে ভাস্কর্য অপসারণের কাজ। এর শিল্পী মৃণাল হকও সেখানে ছিলেন।
ভোররাত ৪টার দিকে ভাস্কর্যটি ক্রেইনের সাহায্যে একটি পিকআপ ভ্যানে তোলা হয়। তার ঠিক আগে আন্দোলনকারীদের মধ্য থেকে কাগজে আগুন জ্বালিয়ে মূল ফটকের ভেতরে ছুড়ে দেওয়া হয়।
রোমান যুগের ন্যায়বিচারের প্রতীক ‘লেডি জাস্টিস’র আদলে এই ভাস্কর্য বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত প্রাঙ্গণে স্থাপন করা হয়েছিল কয়েক মাস আগে।
তবে মৃণাল হক সাংবাদিকদের বলেছেন, “এটার কোন নাম দেওয়া হয়নি, এই ভাস্কর্যটি একটা বিচারিক প্রতীক।”
এরপর হেফাজতে ইসলামসহ কয়েকটি ইসলামী সংগঠন ভাস্কর্যটির বিরোধিতায় নামে। ভাস্কর্যকে মূর্তি আখ্যা দিয়ে তা সরানোর দাবি জানিয়ে সরকারকে ৫ মে মতিঝিলে ফের সমাবেশের হুমকি দেয়। ওলামা লীগও তা অপসারণের দাবি জানায়।
এই প্রেক্ষাপটে গত ১১ এপ্রিল হেফাজতের আমির শাহ আহমদ শফী নেতৃত্বাধীন এক দল ওলামার সঙ্গে গণভবনে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাস্কর্যটি সরাতে পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।
ভাস্কর্য অপসারণের পক্ষে যুক্তি হিসেব এর নান্দনিক ‘ত্রুটির’ পাশাপাশি জাতীয় ঈদগাহের কাছে অবস্থানের কথা বলেন তিনি।
তবে তার এই সিদ্ধান্তের সমালোচনাকারীরা বলছেন, এর মধ্য দিয়ে মৌলবাদীদের সঙ্গে আপস করছে সরকার এবং এতে ধর্মীয় মৌলবাদ আরও উৎসাহিত হবে।
ভাস্কর্য অপসারণের প্রতিবাদে বিক্ষোভরতদের একজন তানভীর রুসমত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই ভাস্কর্য ন্যায়বিচারের প্রতীক। মৌলবাদীদের দাবির মুখে এটা সরানোর সুযোগ নেই।”
জীবনানন্দ জয়ন্ত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, সর্বোচ্চ আদালত প্রাঙ্গণ থেকে সরকারে সহায়তায় মৌলবাদীগোষ্ঠীর দাবির মুখে ভাস্কর্য সরানো হলে হেফাযতকে কোথাও রুখে দেওয়া যাবে না।
ভাস্কর্যটি সরানোর বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের কোনো ভাষ্য পাওয়া যায়নি। মৃণাল হক বলেছেন, ‘চাপে পড়ে’ ভাস্কর্যটি সরাতে বাধ্য হয়েছেন তিনি। কিন্তু কারা চাপ দিচ্ছে, তা নিয়ে মুখ খোলেননি তিনি।
সুপ্রিম কোর্টে এই ভাস্কর্য পুনঃস্থাপনের দাবি জানিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী।
বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম বলেন, “সরকার মৌলবাদী হেফাজতের সঙ্গে আপস করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষ, মুক্তিযুদ্ধের শক্তি দেশের সাধারণ জনগণ ভাস্কর্যটি পুনরায় স্থাপনের দাবিতে আন্দোলন করবে।”
ভাস্কর্যটি পুনঃস্থাপনের দাবিতে শুক্রবার সকাল ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির রাজু ভাস্কর্য থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট অভিমুখে যাত্রা কর্মসূচি ঘোষণা দেন তিনি। সবাইকে এই প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার আহ্বানও তিনি জানান।
এই সংক্রান্ত আরও খবর