সরানো হল সুপ্রিম কোর্টের ভাস্কর্যটি

ইসলামী সংগঠনগুলোর দাবির মুখে সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে সরিয়ে নেওয়া হল ন্যায়বিচারের প্রতীক হিসেবে স্থাপিত ভাস্কর্যটি।

তপন কান্তি রায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিনিধিবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 May 2017, 07:02 PM
Updated : 26 May 2017, 05:34 AM

বৃহস্পতিবার মধ্য রাতে শুরু করে ভোরের আগেই ভাস্কর্যটি সরানোর কাজ শেষ করা হয়।

সুপ্রিম কোর্টের প্রবেশ মুখ থেকে সরিয়ে কাপড় মুড়িয়ে এটি এখন রাখা হয়েছে এনেক্স ভবনের পাশে। 

কাদের নির্দেশে ভাস্কর্যটি সরানো হল, সে বিষয়ে স্পষ্ট ভাষ্য মেলেনি কোনো কর্তৃপক্ষের।

ভাস্কর্যটির শিল্পী মৃণাল হক বলেছেন, ‘চাপের মুখে’ এটি সরিয়ে ফেলতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।

কারা চাপ দিয়েছে, সে বিষয়ে মুখ না খোলেননি তিনি। শুধু বলেছেন, ভাস্কর্যটি যাতে নষ্ট না হয়, সেজন্য অপসারণের সময় উপস্থিত ছিলেন তিনি।

অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেছেন, সুপ্রিম কোর্ট কর্তৃপক্ষ ভাস্কর্যটি অপসারণের পদক্ষেপ নিয়েছে।

ভাস্কর্যটি সরানোর সময় সুপ্রিম কোর্টের তালাবদ্ধ ফটকের বাইরে বিক্ষোভ করেছেন ছাত্র ও সংস্কৃতিকর্মীরা।

এটাকে মৌলবাদীরে কাছে নতি স্বীকার আখ্যায়িত করে শুক্রবার ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে বিক্ষোভের ডাকও দিয়েছেন ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গত মাসে ভাস্কর্যটি অপসারণের প্রতিশ্রুতি দেওয়ার পর রোজায় আগেই তা সরানোর দাবি জানিয়ে হরতালের হুমকি দিয়েছিল কয়েকটি ইসলামী সংগঠন।

রোজা শুরুর তিন দিন আগে বৃহস্পতিবার মধ্যরাতে আকস্মিকভাবে এক দল শ্রমিককে ভাস্কর্যটি অপসারণের কাজ শুরু করতে দেখা যায়।

ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

সুপ্রিম কোর্টের ফটক তালাবদ্ধ থাকায় বাইরে থেকে শুধু দেখা যাচ্ছিল, কিন্তু কারও সঙ্গে কথা বলার সুযোগ ছিল না সাংবাদিকদের।

পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলে তারা ‘আদালতের বিষয়’ বলে এড়িয়ে যান। সুপ্রিম কোর্টের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তার মোবাইল ফোনে কল করা হলেও সেগুলো বন্ধ পাওয়া যায়।

শ্রমিকরা যখন কাজ করছিল, তখন একটি ছোট ট্রাক এবং গাড়ির পাশে ছিল। কিছু সময় পর ভাস্কর্যটির শিল্পী মৃণাল হককেও সেখানে দেখা যায়। তিনি ফটকের কাছে এলে সাংবাদিকরা ছেঁকে ধরেন তাকে।

মৃণাল বলেন, “আমি কিছু জানি না, উপরের পেসারে সরাতে হচ্ছে। আমাকে বলা হয়েছে সরাতে, চাপ দেওয়া হয়েছে।”

কারা চাপ দিয়েছে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “অনেকের অনেক রকম ক্ষমতা আছে। আমি বানিয়েছিলাম, আমাকে সরাতে বাধ্য করা হচ্ছে।

“আমার হাত-মুখ বাঁধা। মাফ চাই, আমি কিছু বলতে পারব না।”

ছবি: তানভীর আহমেদ/বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম

অন্যরা সরালে ভার্স্কযটি ভেঙে কিংবা নষ্ট হতে পারে বলে আশঙ্কা থেকে নিজেই সরাতে এসেছেন বলে জানান মৃণাল হক।

তিনি বলেন, ভাস্কর্যটি সরিয়ে সম্ভবত সুপ্রিম কোর্টের এনেক্স ভবনের পাশে কোথাও বসানো হতে পারে।

রোমান যুগের ন্যায়বিচারের প্রতীক ‘লেডি জাস্টিস’র আদলে এই ভাস্কর্য বাংলাদেশের সর্বোচ্চ আদালত প্রাঙ্গণে স্থাপন করা হলে হেফাজতসহ কয়েকটি ইসলামী সংগঠন তার বিরোধিতায় নামে।

হেফাজত এই ভাস্কর্য সরানোর দাবি জানিয়ে সরকারকে ৫ মে মতিঝিলে ফের সমাবেশের হুমকি দেয়। ওলামা লীগও তা অপসারণের দাবি জানায়।

এরপর গত ১১ এপ্রিল হেফাজতের আমির শাহ আহমদ শফী নেতৃত্বাধীন এক দল ওলামার সঙ্গে গণভবনে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভাস্কর্যটি সরাতে পদক্ষেপ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন।

গণভবনে এই বৈঠকেই সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণ থেকে ভাস্কর্য অপসারণের প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন শেখ হাসিনা

ভাস্কর্য অপসারণের পক্ষে যুক্তি হিসেবে এর নান্দনিক ‘ত্রুটির’ পাশাপাশি জাতীয় ঈদগাহের কাছে অবস্থানের কথা বলেন প্রধানমন্ত্রী। ভাস্কর্যটি সরানোর পক্ষে যুক্তি হিসেবে এর নন্দনতাত্ত্বিক সমস্যার পাশাপাশি সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে ঈদ গাহের অবস্থানের কথা বলেছিলেন শেখ হাসিনা। গ্রিক দেবীকে শাড়ি পরানো নিয়েও প্রশ্ন তোলেন তিনি। 

এক হাতে তলোয়ার ও অন্য হাতে দাঁড়িপাল্লা ধরা নারীর ভাস্কর্যটির বিষেয় ভাস্কর মৃণাল হক বলেন, “গ্রিক দেবী ঠিক নয়, বলাও ঠিক হবে না। এটা গ্রিক ভাস্কর্য নয়, একটা বাঙালি মেয়ে, শাড়ি-ব্লাউজ পরা। গ্রিক হলে সেখানে মেজকি থাকতে। ভুল জিনিস মেনে নিতে খুব কষ্ট হয়।”

ভাস্কর্য অপসারণের খবর প্রকাশের পর রাত ২টার দিকে সুপ্রিম কোর্টের সামনের রাস্তায় সমবেত হয়ে বিক্ষোভ শুরু করে গণজাগরণ মঞ্চের একদল কর্মী। পরে ছাত্র ইউনিয়ন ও ছাত্র ফ্রন্টের নেতাকর্মীরাও তাদের সঙ্গে যোগ দেন।

ন্যায়বিচারের প্রতীক এই ভাস্কর্য আদালত প্রাঙ্গণ থেকে অপসারণের প্রতিবাদ জানান তারা। এক পর্যায়ে তারা সুপ্রিম কোর্টের ফটকে ধাক্কাধাক্কি শুরু করলে রাত ৩টার দিকে ভাস্কর্য সরানোর কাজ কিছুক্ষণ বন্ধ রেখে আশপাশের বাতিগুলো নিভিয়ে দেওয়া হয়।

ছবি: তানভীর আহমেদ

এরপর ভোররাত ৪টার দিকে ভাস্কর্যটি ক্রেইনের সাহায্যে ট্রাকটিতে তুলে নেওয়া হয়। মৃণাল হকও জানান, এটি সরানোর কাজ সম্পন্ন হয়েছে।

ভাস্কর্যটি হাই কোর্টের এনেক্স ভবনের সামনে পুনঃস্থাপন করা হতে পারে বলে জানিয়েছেন ভাস্কর মৃণাল হক।

ভাস্কর্য অপসারণের প্রতিক্রিয়ায় তিনি সাংবাদিকদের বলেন, কারও সন্তান হারালে যেমন লাগে তারও তেমন লাগছে।

ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

এর আগে কয়েকটি ইসলামী দলের দাবির মুখে সেনা নিয়ন্ত্রিত তত্ত্বাবধায়ক সরকার আমলে বিমানবন্দরের সামনে থেকে লালনের ভাস্কর্য অপসারণের প্রসঙ্গ তুলে মৃণাল বলেন, এরপর হয়ত অপরাজেয় বাংলা, রাজু ভাস্কর্য ও শেরাটনের সামনের ঘোড়ার গাড়ির ভাস্কর্য সরানোর নির্দেশ আসবে।

ভাস্কর্য অপসারণের প্রতিবাদে বিক্ষোভরতদের একজন ছাত্রমৈত্রীর নেতা তানভীর রুসমত বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এই ভাস্কর্য ন্যায়বিচারের প্রতীক। মৌলবাদীদের দাবির মুখে এটা সরানো যায় না।”

সুপ্রিম কোর্টে এই ভাস্কর্য পুনঃস্থাপনের দাবি জানিয়ে ছাত্র ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক লিটন নন্দী

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম বলেন, “সরকার মৌলবাদী হেফাজতের সঙ্গে আপস করেছে। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার মানুষ, মুক্তিযুদ্ধের শক্তি দেশের সাধারণ জনগণ ভাস্কর্যটি পুনরায় স্থাপনের দাবিতে আন্দোলন করবে।”

ছবি: তানভীর আহাম্মেদ

ভাস্কর্যটি পুনঃস্থাপনের দাবিতে শুক্রবার সকাল ১১টায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির রাজু ভাস্কর্য থেকে বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে সুপ্রিম কোর্ট অভিমুখে যাত্রা কর্মসূচি ঘোষণা দেন তিনি। সবাইকে এই প্রতিবাদ কর্মসূচিতে অংশ নেওয়ার আহ্বানও তিনি জানান।

এই সংক্রান্ত আরও খবর