৬০৮টি ফ্ল্যাটের জন্য প্রকল্পের নকশা অনুযায়ী তিনটি টুইন টাওয়ার নির্মাণের কথা থাকলেও প্রতিটি ভবন পৃথক পৃথকভাবে নির্মাণ করা হচ্ছে।
এই নির্মাণের পাইলিং কার্যক্রম এলাকাবাসীর জানমালের নিরাপত্তার জন্য হুমকি হওয়ায় নির্মাণ কাজ স্থগিত করার সুপারিশ করেছে সরকারের প্রকল্প বাস্তবায়ন পরীবিক্ষণ ও মূল্যায়ন বিভাগ (আইএমইডি)।
একনেকে অনুমোদিত প্রকল্প এলাকার লে-আউট প্ল্যানের এ ধরনের পরিবর্তন গ্রহণযোগ্য নয় বলেও অভিমত দিয়েছে তারা।
গত মাসে চলমান প্রকল্পটি পরিদর্শন করে দেওয়া প্রতিবেদনে গণপূর্ত ও গৃহায়ণ অধিদপ্তরকে কাজ বন্ধের নির্দেশ দেওয়া হলেও তা মানা হচ্ছে না।
প্রকল্প এলাকার একপাশে প্রধান সড়ক। বাকি তিন দিকে রয়েছে আবাসিক ভবন ও মসজিদ।
প্রকল্পের দক্ষিণ পশ্চিমে অবস্থিত নয়তলা ভবন ‘দারুল আমান’র বাসিন্দা অধ্যাপক মোহাম্মদ ইসলাম গণি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “সরকারের চলমান প্রকল্পের পাইলিংয়ের সময় এমন কম্পনের সৃষ্টি হয় যে, বাচ্চারা ভয় পেয়ে যায়। এত বেশি কম্পন ও বিকট আওয়াজের সৃষ্টি হয় যে, আমাদের স্বাভাবিক জীবনযাপনে বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।”
এই প্রকল্পের কাজ শুরুর পর কুয়েতি মসজিদের দেওয়ালে ফাটল ধরার কথা উল্লেখ করে তিনি বলেন, “আমাদের ভবনেও যে কোনো ফাটল দেখা দিতে পারে বলে ভয়ে আছি।”
২০১৫ সালের ২৯ অক্টোবর জাতীয় অর্থনৈতিক পরিষদের নির্বাহী কমিটির (একনেক) সভায় সরকারি কর্মকর্তা/কর্মচারীদের জন্য ৬০৮টি আবাসিক ফ্ল্যাট নির্মাণে প্রকল্পটি অনুমোদন দেওয়া হয়। এরপর গত ১৬ এপ্রিল প্রকল্পের অগ্রগতি পরিদর্শন করে আইএমইডির পরিদর্শক দল।
তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, সরেজমিন পরিদর্শনে ৭ নম্বর ভবনের প্রি-কাস্ট পাইল ড্রাইভ করতে দেখা যায়। অটোমেটিক ডিজেল ইঞ্জিনের মাধ্যমে ৫ টনের ওয়েট দিয়ে পাইল ড্রাইভিংয়ের জন্য হ্যামারিং করা হচ্ছিল। এতে করে বিকট শব্দের সাথে সাথে ব্যাপকহারে ভূকম্পন অনুভূত হয়।
“হ্যামারিংয়ের এ ধরনের বিকট শব্দে ভূ-কম্পনে পুরো এলাকা প্রকম্পিত হচ্ছে। সকাল ৭টা থেকে বিকাল ৫টা পর্যন্ত এরকম চলতে থাকায় এলাকাজুড়ে আতঙ্ক ও অসন্তোষ বিরাজ করছে।
“প্রকল্প এলাকার পাইলিংয়ের কারণে চারতলা স্টাফ কোয়ার্টার জামে মসজিদের বিভিন্ন অংশে উপর-নীচ এবং পাশাপাশি ফাটল দেখা দিয়েছে।”
আইএমইডির মহাপরিচালক (স্বাস্থ্য ও গৃহায়ণ) আল মামুন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “২৪ এপ্রিলের মধ্যে গৃহায়ণ অধিদপ্তরকে পরবর্তী করণীয় সম্পর্কে আইএমইডিকে জানানোর অনুরোধ করা হলেও এখনও পর্যন্ত আমরা তাদের কোনও জবাব পাইনি।”
এ বিষয়ে জানতে চাইলে প্রকল্প পরিচালক প্রকৌশলী মোহাম্মদ শামসুজ্জোহা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আইএমইডির প্রতিবেদনের পর আমাকে বাদ দিয়ে নতুন একজনকে প্রকল্প পরিচালক নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। আমি এখন আর ওই প্রকল্পের পরিচালক নই।
“ওই প্রতিবেদনের পর পাইলিংয়ের ত্রুটির জন্য গণপূর্ত অধিদপ্তরের অধীনে উচ্চ ক্ষমতার একটি তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ওই কমিটি কী প্রতিবেদন দিয়েছে তা আমি জানি না।”
নকশা পরিবর্তনের কারণ জানতে চাইলে তিনি বলেন, “নকশা পরিবর্তনের জন্য আমি নই, গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান স্থপতি কাজী গোলাম নাসির এর জন্য দায়ী। তার নকশা অনুযায়ী আমি প্রকল্প বাস্তবায়ন শুরু করি।
গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. রফিকুল ইসলাম বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আইএমইডির প্রতিবেদনের পর আমরা তাৎক্ষণিকভাবে কয়েকজন বিশেষজ্ঞ প্রকল্প এলাকায় গিয়ে সমস্যার সমাধান করেছি।”
হ্যামারিংয়ের আওয়াজের জন্য প্রকল্প বন্ধ করে দেওয়ার নির্দেশনা কতটুকু যৌক্তিক তা নিয়ে প্রশ্ন তোলেন তিনি।
প্রকল্পের সর্বশেষ পরিস্থিতি আইএমইডিকে জানানো হয়েছে বলে দাবি করেন গণপূর্তের এই প্রকৌশলী।
তবে আইএমইডির ভারপ্রাপ্ত সচিব মো. মফিজুল ইসলাম সোমবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আইএমইডি সাধারণ প্রকল্প যথাযথভাবে বাস্তবায়ন হচ্ছে কি না বা কোনও অনিয়ম হচ্ছে কি না তা সরেজমিন পরিদর্শন শেষে প্রতিবেদন দাখিল করে।
“এ প্রকল্পেও আমার প্রতিনিধি দল পরিদর্শনে যা পেয়েছে, তাই প্রতিবেদনে দিয়েছে। এখন বাস্তবায়নকারী সংস্থা তা মানবে কি না সেটা তাদের বিষয়।”
দ্বিতীয় প্যাকেজের মাধ্যমে প্রতি তলায় ১ হাজার বর্গফুটের চারটি ইউনিট বিশিষ্ট ২০তলা ভবন নির্মাণের কথা। এ প্যাকেজের মাধ্যমে ৬ ও ৭ নম্বর ভবন দুটি একত্রে করে একটি টুইন টাওয়ার হিসেবে নির্মাণের নির্দেশনা থাকলেও সরেজমিন গিয়ে তা পৃথক পৃথকভবন তৈরি করতে দেখা গেছে।
আইএমইডির প্রতিবেদনে বলা হয়, ভবন দুটির মধ্যে ৭ নম্বর ভবনের ২৭৮টি পাইলের কাস্টিং শেষ হয়েছে। প্রতিদিন গড়ে ১২ থেকে ১৪টি পাইল ড্রাইভ করা হচ্ছে। ৬ নম্বর ভবনেও ৭৮টি পাইলিং কাস্টিং শেষ হয়েছে। অগ্রগতি ৪ দশমিক ৩ শতাংশ।
একইভাবে তিন নম্বর প্যাকেজেও ৪ ও ৫ নম্বর ভবন এক করে টুইন টাওয়ার নির্মাণের কথা থাকলেও তা না করে পৃথক পৃথক ভবন তৈরি করা হচ্ছে। এটিও ২০ তলা ভবন হবে, যার প্রতি তলায় ১ হাজার বর্গফুটের চারটি ইউনিট হবে।
৪ নম্বর প্যাকেজের মাধ্যমে ১ হাজার ২৫০ বর্গফুটের চার ইউনিট বিশিষ্ট দুটি ২০তলা ভবন পৃথক পৃথকভাবে নির্মাণের কথা জানিয়েছে প্রকল্প কর্তৃপক্ষ। অর্থাৎ এক্ষেত্রেও টুইন টাওয়ার নির্মাণের নির্দেশনা অবহেলিত হয়েছে।
৫ নম্বর প্যাকেজের মাধ্যমে প্রতি তলায় ১ হাজার ২৫০ বর্গফুটের চার ইউনিট বিশিষ্ট ২০তলা ভবন দুটি টুইন টাওয়ার তৈরী করার নির্দেশনা থাকলেও এটিও পৃথক পৃথক ভবন তৈরী করা হবে বলে তদন্ত দলকে জানানো হয়েছে।
মামলাজনিত সমস্যা থাকায় এখনও কাজ শুরু হয়নি। তবে মামলা নিষ্পত্তি হওয়ায় অবৈধ দখল উচ্ছেদ করে জমি বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে গৃহায়ণ ও গণপূর্ত অধিদপ্তরের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন।