ভালোবাসার ফুলে নজরুল স্মরণ

জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাম্য ও মানবতাবোধের চেতনায় উজ্জ্বীবিত হয়ে অসাম্প্রদায়িক সমাজ প্রতিষ্ঠার আহ্বান নিয়ে উদযাপিত হচ্ছে তার ১১৮তম জন্মবার্ষিকী।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 25 May 2017, 06:06 AM
Updated : 25 May 2017, 06:06 AM

বৃহস্পতিবার ভোরে জাতীয় কবির সমাধিসৌধে শ্রদ্ধা নিবেদনের মধ্য দিয়ে সেই আয়োজনের সূচনা হয়।

১৮৯৯ সালের ২৪ মে (১১ জ্যৈষ্ঠ ১৩০৬ বঙ্গাব্দ) পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমান জেলার চুরুলিয়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন কাজী নজরুল ইসলাম। শৈশবেই স্বজন হারানো ‘দুখু মিয়া’ দারিদ্র্য আর সব বাধা ঠেলে একসময় বাংলা সাহিত্যের অন্যতম পুরোধা হয়ে ওঠেন।

বাংলা ভাষার কবিতাপ্রেমিদের কাছে নজরুল প্রেমের কবি, চির যৌবনের দূত; সেইসঙ্গে তিনি বিদ্রোহী, গৃহত্যাগী বাউণ্ডুলে।

সকালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদের পাশে সমাধিসৌধে ফুল দিয়ে কবিকে স্মরণ করে বিভিন্ন রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠন।

কবি পরিবারের পক্ষে শ্রদ্ধার্ঘ্য নিবেদন করেন তার দুই নাতনী খিলখিল কাজী ও মিষ্টি কাজী।

পরে খিলখিল কাজী বলেন, “বিশ্বজুড়ে চলমান এই নাশকতা, সহিংসতার সময়ে দাদুর মতো নির্লোভ, নির্ভীক ও সাহসী এক নায়কের দরকার ছিল। মানুষকে ভালোবাসাই ছিল দাদুর প্রধান আদর্শ। তিনি গোটা বাঙালি জাতির শির চির উন্নত করে গেছেন। গান, কবিতা বা রচনায় তিনি মানুষকে আলোকিত করতে চেয়েছেন।”

নজরুলের আদর্শকে জাতীয় জীবনে সঠিকভাবে ধারণ বা চর্চা করা হচ্ছে না বলেও অভিযোগ করেন তিনি।

“দাদু অন্যায়ের বিরুদ্ধে আমাদের প্রতিবাদ করতে শিখিয়ে গেছেন। কিন্তু আমরা কি তাকে সত্যি অনুধাবন করতে পেরেছি? চোখের সামনে ঘটে যাওয়া নানা অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদী হয়ে উঠে আমরা কি তার উত্তরসূরী হতে পেরেছি?”

সারা বিশ্বে নজরুলের রচনা ছড়িয়ে দিতে তার রচনাবলীর যথাযথ অনুবাদর উপর গুরুত্ব আরোপ করেন খিলখিল কাজী। স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের পাঠ্যসূচিতে নজরুল রচনা পাঠ আবশ্যক করার দাবি জানান তিনি।

ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে দলটির সাধারণ সম্পাদক সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, “বঙ্গবন্ধু, রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের মতো কবি নজরুলও বাঙালির নিঃশ্বাসে, বিশ্বাসে মিশে আছেন। তিনি প্রাত্যহিক জীবনে ভীষণ প্রাসঙ্গিক।”

নজরুলের দেখানো অসাম্প্রদায়িক চেতনাবোধে উজ্জীবিত হয়ে সাম্প্রদায়িকতার বিষবৃক্ষ উপড়ে ফেলতে পারলেই জাতীয় কবির প্রতি যথাযথ শ্রদ্ধা দেখানো হবে বলেও মনে করেন তিনি।

সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর বলেন, “মুক্তিযুদ্ধ কিংবা আমাদের রাজনৈতিক ও সামাজিক আন্দোলনে কবি কাজী নজরুল ইসলাম আমাদের নিরন্তর প্রেরণার উৎস। সাম্প্রদায়িকতা ও জঙ্গিবাদের উত্থানের এই প্রেক্ষাপটে নজরুলকে আরও বেশি জানা-বোঝা ও অনুভব করার প্রয়োজন রয়েছে।”

নজরুলের সাম্রাজ্যবাদবিরোধী চেতনার দিকটি উল্লেখ করে তিনি বলেন, “নজরুল কেবল লেখনীতেই এই চিন্তাকে সীমাবদ্ধ রাখেননি। তিনি হাতে অস্ত্র নিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে প্রত্যক্ষ অংশগ্রহণ করেছেন। তার কর্মজীবনে, চিন্তাচেতনায় আমরা সেই চিন্তার বহিঃপ্রকাশ দেখতে পাই।”

কবি কাজী নজরুলের সৈনিক জীবনে যোগদানের শত বছর পূর্তি হচ্ছে এ বছরই। কবি পরিবারের দাবি অনুযায়ী শিক্ষাক্ষেত্রে নজরুল পাঠ আরও বিস্তৃত করতে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে আলোচনা করার প্রতিশ্রুতি দেন সংস্কৃতিমন্ত্রী।

বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব রুহুল কবির রিজভী ও চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা গাজী মাজহারুল আনোয়ার সকালে নজরুলের সমাধিতে শ্রদ্ধা জানাতে আসেন।  

রিজভী বলেন, “বিদ্যমান সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে বঞ্চিত মানুষের অধিকার আদায়ের সংগ্রামে নজরুলের শব্দমালা আমাদের প্রেরণার উৎস। আজকে যখন আমরা বাকরুদ্ধ, কথা বলতে আতঙ্কিত হই, ভয় পাই, তখন নজরুল আমাদের প্রতিবাদের প্রেরণা যোগান।”

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষ থেকে শ্রদ্ধা নিবেদন শেষে উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক বলেন, “ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সত্য লড়াইয়ে কবি নজরুল আমাদের প্রেরণার উৎস হয়ে আছেন সবসময়।”

বাংলা একাডেমি, শিল্পকলা একাডেমি, জাতীয় জাদুঘর, জাতীয় আর্কাইভস ও গ্রন্থাগার, নজরুল ইনস্টিটিউট, শিশু একাডেমি, নজরুল একাডেমি ছাড়াও বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক সংগঠনের পক্ষ থেকে সকালে শ্রদ্ধা জানানো হয় নজরুল সমাধিতে।

সমাধিসৌধের পাশে ছিল আলোচনা পর্বের আয়োজন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা সেখানে আলোচনায় অংশ নেন। সংগীত পরিবেশন করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সংগীত বিভাগের শিল্পীরা।

‘উন্নত মম শির’

শৈশবে পিতৃহারা নজরুলের প্রাথমিক শিক্ষার হাতেখড়ি হয় গ্রামের মক্তবে। পরিবারের ভরণ-পোষনের জন্য মক্তব থেকে নিম্ন মাধ্যমিক পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হওয়ার পর সেখানেই শিক্ষকতা শুরু করেন। পাশাপাশি গ্রামের মসজিদে মুয়াজ্জিনের কাজ নেন।

রাঢ় বাংলা (বর্ধমান-বীরভূম) অঞ্চলের কবিতা, গান ও নৃত্যের মিশ্র আঙ্গীক লোকনাট্য লেটো দলে যোগ দেওয়ার কিছু দিনের মধ্যে নজরুলের শিক্ষকতার সমাপ্তি ঘটে। ওই সময়ই তাৎক্ষনিক কবিতা ও গান লেখার দক্ষতার জন্য পরিচিত হয়ে ওঠেন তিনি।

১৯১০ সালে লেটো গানের দল ছেড়ে দিয়ে প্রথমে রানীগঞ্জ সিয়ারসোল স্কুল এবং পরে মাথরুন স্কুলে (নবীনচন্দ্র ইন্সটিটিউশন) ভর্তি হলেও আর্থিক অনটনের কারণে আবারও আসানসোলে চা-রুটির দোকানে কাজ নিতে হয় নজরুলকে। সেখানেই আসানসোলের দারোগা রফিজউল্লার সঙ্গে তার পরিচয় হয়।

রফিজউল্লার আগ্রহে ময়মনসিংহ জেলার ত্রিশালে দরিরামপুর স্কুলের সপ্তম শ্রেণিতে ভর্তি হন নজরুল। সেখানে এক বছর ছিলেন তিনি। সেই ত্রিশালেই নজরুলের নামে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে একটি বিশ্ববিদ্যালয়।

প্রবেশিকা শেষ না করেই ১৯১৭ সালের শেষ দিকে স্কুল ছেড়ে সেনাবাহিনীতে যোগ দেন নজরুল। ১৯২০ সালের এপ্রিল পর্যন্ত প্রায় আড়াই বছর চলে তার সেই সামরিক জীবন।

১৯২২ সালে প্রকাশিত হয় নজরুলের বিখ্যাত কবিতা 'বিদ্রোহী'। ব্রিটিশ রাজের ভিত কেঁপে উঠেছিল তার অগ্নিগর্ভ কবিতার বজ্রনির্ঘোষে। ব্রিটিশবিরোধী লেখার জন্য বেশ কয়েকবার কারারুদ্ধ হতে হয় তাকে।

একে একে প্রকাশিত হতে থাকে তার গ্রন্থ অগ্নিবীনা, প্রলয়োল্লাস, আগমনী, খেয়াপারের তরণী, ছায়ানট, বিষের বাঁশি, বাউন্ডুলের আত্মকাহিনী, ব্যাথার দান, ঘুমের ঘোরে, মৃত্যুক্ষুধা।

নজরুল প্রতিভার আরেকটি দিক প্রভা ছড়িয়েছে সংগীতে। শ্যামা সংগীত ও ইসলামী গজল- দুই ধারাতেই সমান দখল দেখানো নজরুলের লেখা গানের সংখ্যা চার হাজারের বেশি।

সংগীত বিশিষ্টজনদের মতে রবীন্দ্রনাথ -পরবর্তী নজরুলের গান অনেকটাই ভিন্ন ধাঁচের নির্মাণ।

সৈনিক জীবনের সমাপ্তির পর নজরুলের সঙ্গে পরিচয় ঘটে ভারতীয় কমিউনিস্ট পার্টির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা কমরেড মুজাফফর আহমদ এর সঙ্গে। সে সময় তিনি সাপ্তাহিক লাঙ্গল, গণবানী, ধূমকেতু, সওগাত ও সান্ধ্য দৈনিক নবযুগ পত্রিকা সম্পাদনার সঙ্গে যুক্ত হন।

নজরুল বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম বলেন, “নজরুল ইতিহাস ও সময় সচেতন মানুষ ছিলেন যার প্রভাব তার লেখায় স্পষ্টভাবে পাওয়া যায়। তুরস্কে কামাল পাশার নেতৃত্বে প্রজাতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা, রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব আর ভারতবর্ষে ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলনের তরঙ্গকে নজরুল তার সাহিত্যে বিপুলভাবে ধারণ করেছেন।”

নজরুল ছিলেন একাধারে কবি, সংগীতজ্ঞ, ঔপন্যাসিক, গল্পকার, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, সাংবাদিক, চলচ্চিত্রকার, গায়ক ও অভিনেতা। তিনি ছিলেন অসাম্প্রদায়িক চেতনার পথিকৃৎ লেখক। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধেও তার গান ও কবিতা ছিল প্রেরণার উৎস।

১৯২১ সালে কুমিল্লায় প্রমীলা দেবীর সঙ্গে পরিচয়ের তিন বছর পর পরিণয়। কবি পরিবারে আসেন কাজী সব্যসাচী ও কাজী অনিরুদ্ধ।

১৯৪২ সালে দুরারোগ্য রোগে আক্রান্ত হয়ে ক্রমশ বাকশক্তি হারান নজরুল। স্বাধীনতার পরপরই জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান অসুস্থ কবিকে ভারত থেকে বাংলাদেশে নিয়ে আসেন। নজরুল হন বাংলাদেশের জাতীয় কবি।

১৯৭৬ সালের ২৯ আগস্ট হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় মৃত্যু হয় কবি নজরুল ইসলামের।

নজরুল জন্মজয়ন্তীর আয়োজন

এবার জাতীয় কবির জন্মবার্ষিকীর মূল অনুষ্ঠান হবে ঢাকার ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে। বিকাল ৩টায় এর উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি থাকবেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ।

সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূরের সভাপতিত্বে অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি থাকবেন নজরুল ইনস্টিটিউট ট্রাস্টি বোর্ডের সভাপতি ইমেরিটাস অধ্যাপক রফিকুল ইসলাম। শুভেচ্ছা বক্তব্য দেবেন জাতীয় কবির পৌত্রী খিলখিল কাজী।

জাতীয় কবির ১১৮তম জন্মবার্ষিকী উদযাপনের প্রতিপাদ্য ঠিক হয়েছে ‘সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদবিরোধী সৈনিক নজরুল’। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে এ বিষয়ে স্মারক বক্তব্য দেবেন অধ্যাপক সৌমিত্র শেখর।

আলোচনার পর বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমি ও নজরুল ইন্সটিটিউটের আয়োজনে ৩০ মিনিটের একটি সাংস্কৃতিক পর্ব থাকবে।

শুক্রবার বিকাল সাড়ে ৪টায় জাতীয় জাদুঘরে নজরুল ইনস্টিটিউটের নজরুল জন্মজয়ন্তীর আয়োজনে প্রধান অতিথি থাকবেন এমিরেটাস অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী। আলোচক হিসেবে থাকবেন আর্টস ডট বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম সম্পাদক কবি মুহম্মদ নূরুল হুদা।

এছড়া ময়মনসিংহের ত্রিশাল, কুমিল্লার দৌলতপুর ও চট্টগ্রামে স্থানীয় প্রশাসনের ব্যবস্থাপনায় নজরুলজয়ন্তীর নানা অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে।