জাতীয় জাদুঘরে নতুন তিন গ্যালারি

সভ্যতার বিকাশে বিবর্তনের নানা পর্যায়, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের বিভিন্ন উপাদান এবং বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির উৎকর্ষতার প্রতীক নিয়ে যাত্রা শুরু করল জাতীয় জাদুঘরের তিনটি নতুন গ্যালারি।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 23 May 2017, 01:11 PM
Updated : 23 May 2017, 01:11 PM

মঙ্গলবার সকালে ‘বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাস’, ‘কাচ’ এবং ‘ভারতীয় সভ্যতা’ নামে গ্যালারি তিনটির উদ্বোধন করেন সংস্কৃতি মন্ত্রণালয়ের সচিব ইব্রাহীম হোসেন খান। সঙ্গে ছিলেন জাতীয় জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী।

সচিব ইব্রাহীম হোসেন খান বলেন, “আমরা এক সমৃদ্ধ অতীতের অধিকারী। হাজার হাজার বছর আগে আমরা এক উন্নত সভ্যতার অধিকারী ছিলাম।

“এই ইতিহাস, ঐতিহ্যকে নতুন প্রজন্মের সামনে আমাদের তুলে ধরতে হবে। তা না হলে আমরা এগিয়ে যেতে পারব না।”

জাদুঘরের মহাপরিচালক ফয়জুল লতিফ চৌধুরী বলেন, বিশ্ব সভ্যতার নানা নিদর্শন দিয়ে সাজানো এই গ্যালারিগুলোতে ঢুঁ মারলে পৃথিবীর গত সাত হাজার বছরের ইতিহাস খুব সহজেই জানা যাবে।

নতুন চালু করা গ্যালারিগুলোকে ধীরে ধীরে আরও সমৃদ্ধ করা হবে বলে জানান তিনি।

বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাস গ্যালারি

মেসোপটেমিয়া, ইনকা, হরপ্পা-মহেঞ্জোদারোর নগর কেন্দ্রিক সভ্যতা এবং মিশরীয় সভ্যতার ক্রমবিবর্তনের গল্প জানতে হলে ঢুঁ মারতে হবে জাদুঘরের চতুর্থ তলার বিশ্ব সভ্যতার ইতিহাস গ্যালারিতে।

যুদ্ধবিগ্রহ, বিপ্লব আর সংগ্রামের নানা ধারাপাতের পাশাপাশি এখানে ঠাঁই পেয়েছে ইতিহাসের বীর সেনাদের গল্প। ঠাঁই পেয়েছে হিটলার ও মুসোলিনির ধ্বংসযজ্ঞের গল্পগুলো।

প্রথম বিশ্বযুদ্ধ, দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের প্রেক্ষাপট, মারণাস্ত্রের ঝনঝনানি, গণহত্যা আর মানবতাবিরোধী অপরাধের ভয়াল চিত্র ঠাঁই পেয়েছে এই গ্যালারিটিতে।বিপরীতে শান্তি প্রতিষ্ঠায় নেলসন ম্যান্ডেলা, মার্টিন লুথার কিং, ঈশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, রাজা রামমোহন রায়, ফ্রান্সের বীরকন্যা জোয়ান অব আর্ক আর রোমের দাস বিদ্রোহের বিপ্লবী স্পার্টাকাস গ্ল্যাডিয়েটরের প্রতিকৃতি ঠাঁই পেয়েছে এই গ্যালারিতে।

বিজ্ঞানের উৎকর্ষতার নিদর্শন হিসেবে আছে স্যার টিম বার্নাস লির ওয়ার্ল্ড ওয়াইড ওয়েব (www) উদ্ভাবন, মার্কিন কুপারের মোবাইল ফোন আবিষ্কার, ফিলো টেইলর ফ্রান্সওয়ার্থের টেলিভিশন আবিষ্কার, চার্লস ডারউইনের ‘অরিজিন অব স্পিসিস, স্যামুয়েল মোর্সের তারবার্তা যন্ত্র, হান্স লিপার্শির টেলিস্কোপ এবং স্যামুয়েল হানিম্যানের হোমিও চিকিৎসা উদ্ভাবন।

এখানে এলে জানা যাবে ১৯৪৭ সালে ভারত ভাগের আদ্যোপান্ত। ভারতবর্ষের রাজনৈতিক ইতিহাস সংক্ষিপ্ত পরিসরে উঠে এসেছে এখানে।

ভারতীয় সভ্যতা

ভারতের দশটি সভ্যতার ইতিহাস, ঐতিহ্যের নানা নিদর্শন নিয়ে সাজানো হয়েছে এ গ্যালারিটি।

চতুর্থ তলার এই গ্যালারিতে ঢুকতেই ডান দিকে চোখে পড়বে মধ্যযুগের নির্দশন। ১২১২ খ্রিস্টাব্দে সুলতান সামসুদ্দীন ইলতুতমিশ এবং ১২২৫ খ্রিস্টাব্দে সুলতানা রাজিয়ার শাসনামলের গল্প উঠে এসেছে এই শাখায়। ১১৯১ খ্রিস্টাব্দে ঘটে যাওয়া তরাইনের যুদ্ধের ভয়াল চিত্রও দেখা যাবে এখানে। মধ্যযুগের নিদর্শনে ঠাঁই পেয়েছে আরবদের সিন্ধু অভিযান ও সুলতান মাহমুদের রাজসভার গল্প।

চোল, চালুক্য, চান্দেল ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে ঠাঁই হয়েছে চালুক্য লিপি ও স্থাপত্য, স্তম্ভলিপি, চোল রাজাদের মন্দির এবং রাজধানী গাদারকোন্ডা চোলপুরামের চিত্র।

গুপ্তত্তোর যুগ বিভাগে রয়েছে হর্ষবর্ধনের লিপি ও ভাস্কর্য, ভাস্কর বর্মার তাম্রলিপি ও হরপ্পা থেকে পাওয়া রঙিন মৃৎ পাত্রের টুকরা।

গুপ্ত যুগ বিভাগে আছে মহাস্থান থেকে পাওয়া পোড়ামাটির বিষ্ণু মূর্তি, মধ্য প্রদেশের দিওগড়ের দশাবতারের মন্দিরের স্থাপত্য, শূন্য ও দশমিকের আবিস্কারক আর্য ভট্টের ভাস্কর্য, উদয়গিরি গুহার বরাহ ভাস্কর্য, সাচী স্তুপ, প্রস্তর লিপি ও বুধগুপ্তের তাম্রলিপির প্রতিকৃতি। ছবিগুলোর নিচে কাচের বাক্সে রাখা হয়েছে প্লাস্টার অব প্যারিসে নির্মিত অশোক স্তম্ভ ও আবক্ষ পুরোহিতের ভাস্কর্য।

ইন্দো গ্রিক, ইন্দো সিথিয়ান ও ইন্দো পার্থিয়ান শাখায় দেখা মিলবে আলেকজান্ডারের সঙ্গে পুরুরাজের যুদ্ধের ছবি। পুরুর রৌপ্যমুদ্রা ও ইন্দো সিথিয়ান রাজা অ্যাজেসের রৌপ্যমুদ্রার পাশাপাশি এখানে ঠাঁই পেয়েছে মেঘাস্থিনিসেরে ইন্ডিকা গ্রন্থটির প্রচ্ছদ।

কুষাণ যুগের ইতিহাস পর্বে দেখা যায়, পুরুষপুরের (পেশোয়ার) ধ্বংসাবশেষ, সম্রাট কনিস্কের ভাস্কর্য ও বাসুদেবের স্বর্ণ মুদ্রার ছবি।

মৌর্য সাম্রাজ্যের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগে স্থান পেয়েছে সম্রাট অশোকের ভাস্কর্য এবং খ্রিস্টপূর্ব তৃতীয় শতকের মৌর্য সভ্যতার রৌপ্য মুদ্রা।

বৌদ্ধ ও জৈন ধর্মের উদ্ভব বিভাগে দেখা মিলবে গৌতম বুদ্ধের জন্মস্থান কপিলাবস্তুর লুম্বিনি গ্রাম, গয়ার বোধিবৃক্ষ, ধ্যানিবুদ্ধ ও বুদ্ধের বিয়ের ছবি। খ্রিস্টপূর্ব পঞ্চম শতকে পাওয়া ত্রিপিটকের প্রচ্ছদের দেখা মিলবে এখানে।

আর্য সভ্যতা শাখায় গিয়ে দেখা গেল চতুরাশ্রম, বর্ণপ্রথা ও মহাভারত যুদ্ধের চিত্রকলা। খ্রিস্টপূর্ব ১৪০০-১০০০ অব্দে পাওয়া ঋগবেদ, রামায়ণ ও মহাভারতের প্রচ্ছদও ঠাঁই পেয়েছে সেখানে।

সিন্ধু সভ্যতায় দেখা মিলবে- মহেঞ্জোদারো ও হরপ্পা সভ্যতার ধ্বংসাবশেষের ছবি। খ্রিস্টপূর্ব ২৫০০ অব্দের লোথাল সমুদ্র বন্দরের ছবির পাশাপাশি দুই সভ্যতার শিলালিপি, মৃৎ পাত্র ও অলঙ্কারেরর ধ্বংসাবশেষের ছবিরও ঠাঁই হয়েছে এখানে।

কাচের গ্যালারি

এ গ্যালারিটিতে ঠাঁই পাওয়া অধিকাংশ উপকরণ একুশ শতকের প্রথমভাগে পাওয়া নানা নিদর্শন।

বিকার, বোতল, মেজারিং সিলিন্ডার, ম্যাগনিফায়িং গ্লাস, সিসমোগ্রাফ ও অনুবীক্ষণ যন্ত্রের পাশাপাশি ঠাঁই পেয়েছে গৃহসজ্জার নানা উপকরণ।

একুশ শতকের প্রথমভাগে পাওয়া এই তৈজসগুলোর মধ্যে রয়েছে সুরাপাত্র, আতরদান, কালির দোয়াত, হ্যালোজেন লাইট, ছাইদান ও পানপাত্র।