‘পুরুষতান্ত্রিক শহর হিসেবে গড়ে উঠেছে ঢাকা’

গণপরিবহনে যৌন হয়রানি আর সীমিত সুযোগ-সুবিধার স্বল্প সংখ্যক পাবলিক টয়লেটে নিরাপত্তাহীনতার সঙ্গে রাস্তাঘাট, ফুটপাত ও পার্কের মতো গণপরিসরের ব্যবহার উপযোগিতা নারীদের জন্য সীমিত দাবি করে ঢাকা শহর ‘নারীবান্ধব নয়’ বলছে একশনএইড।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 20 May 2017, 01:36 PM
Updated : 20 May 2017, 01:58 PM

রাজধানীর রাস্তা, বাসস্ট্যান্ড, ফুটপাত, মার্কেট ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বিভিন্ন বয়সের ২০০ জন নারীর উপর জরিপ চালিয়ে তৈরি এক গবেষণা প্রতিবেদনে একথা বলছে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থাটি।

ঢাকা শহরের প্রায় ২২.৫ শতাংশ নারী বাইরে বের হয়ে বাস সহকারী, চালক বা সহযাত্রীর কাছ থেকে যৌন হয়রানির শিকার হন বলে একশনএইড বাংলাদেশ পরিচালিত ওই জরিপে উঠে আসে।

এছাড়া রাজধানীবাসী ৫৬ শতাংশ নারী ভালো পরিবহন ব্যবস্থা না থাকায় ঘরের বাইরে যেতে চান না বলে ওই জরিপভিত্তিক ‘নারী সংবেদনশীল নগর পরিকল্পনা’ শীর্ষক গবেষণাপত্রে জানানো হয়।

শনিবার একশনএইড বাংলাদেশ গুলশান কার্যালয়ে ‘বিশ্ব নিরাপদ নগরী দিবস’ উপলক্ষে গবেষণাপত্র তুলে ধরেন জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের নগর পরিকল্পনা বিভাগের অধ্যাপক আক্তার মাহমুদ।

তিনি বলেন, “নারীদের চাহিদা নগর পরিকল্পনায় প্রতিফলিত হতে দেখা যায় না। একটি নগর পরিকল্পনা যখন নারী বান্ধব হয় না, তখন স্বভাবতই নারীদের জন্য নগর ছোট হয়ে আসে ও অনিরাপদ হয়ে দাঁড়ায়। নিরাপত্তার অভাবে নারীরা তাদের চলাফেরা সীমিত করে ফেলে।”

ঢাকা শহর পুরুষতান্ত্রিক শহর হিসেবে গড়ে উঠেছে অভিযোগ করে এতে নারী ক্ষমতায়ন বাধাগ্রস্ত হওয়ার পাশাপাশি অর্থনৈতিকভাবে ক্ষতি হচ্ছে বলছেন অধ্যাপক আক্তার মাহমুদ।

“ঢাকা শহর পুরুষতান্ত্রিক শহর হিসেবেই গড়ে উঠেছে, যা মহিলা ও নারীদের অবাধ চলাচলে বাধার সৃষ্টি করে। এর ফলে নারীরা বাড়ির বাইরে যেতে চায় না কিংবা কর্মক্ষেত্রে পূর্ণ ক্ষমতা প্রয়োগ করে না; যা তাদের অধিকার ও দাবি থেকে বঞ্চিত করে, অর্থনৈতিকভাবেও ক্ষতির স্বীকার হয়।”

‘নারী সংবেদনশীল নগর পরিকল্পনা’ বিষয়ক গবেষণাপত্র উপস্থাপন করে একশনএইড।

এ অবস্থার পেছনে নগরের কাঠামোগুলো নারী বান্ধব না হওয়াকে দায়ী করে গবেষণাপত্রে বলা হয়, গণপরিবহন, রাস্তাঘাট, ফুটপাত, পাবলিক টয়লেট, পার্কের মতো গণপরিসরে নারীদের ব্যবহার উপযোগিতা সীমিত। ফলে শঙ্কা, নিরাপত্তাহীনতা ও সহিংসতার ভয়ে গণপরিসর এড়িয়ে চলতে হয় নারীদের।

ভাল পরিবহন ব্যবস্থা না থাকায় ঢাকা শহরের ৫৬ শতাংশ নারী ঘরের বাইরে যেতে চান না বলার পাশাপাশি ২৬ শতাংশ নারী বলেছেন, নিরাপত্তার অভাবে তাদের পরিবার ঘরের বাইরে যেতে দেয় না।

অতিরিক্ত ভিড়ের কারণে ৫৮ শতাংশ নারী গণপরিবহনে উঠতে পারেন না। ৬১ দশমিক ৫ শতাংশ নারী মনে করেন, ফুটপাতগুলো যথেষ্ট প্রশস্ত নয়। তাই চলাচলে সমস্যা হয়।

৯৩ দশমিক ৫ শতাংশ উত্তরদাতা পাবলিক টয়লেট ব্যবহার করেন না নিরাপত্তা ও সুবিধার অভাবে।

জরিপে ৮৭ শতাংশ নারী বলেছেন, ঢাকা শহরে নেই পর্যাপ্ত পার্ক ও উদ্যান; যেগুলো আছে সেগুলো নিরাপদ নয় বলে মনে করেন ৪২ শতাংশ নারী।

রাজধানীর গণপরিবহন সম্পর্কে ৮৬ শতাংশ উত্তরদাতা যানজট নিয়ে হতাশ। ৭৮ দশমিক ৫ শতাংশ নারী বলেছেন বাসের সংখ্যা অপ্রতুল।

এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে নিরাপত্তাহীনতা ও নগর উন্নয়ন পরিকল্পনায় নারীকে বাদ দিয়ে কাঠামো তৈরি করা।

গণপরিবহনে এরকম অনিরাপদ অবস্থায় যাতায়াতের পাশাপাশি ভিড়ের মধ্যে যৌন হয়রানির শিকারও হতে রাজধানীবাসী নারীদের

ঢাকা নগরীতে পর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেট না থাকার কারণে নারীরা নানা ধরনের শারীরিক সমস্যায় ভুগছেন বলে উঠে আসে গবেষণাপত্রে।

এ বিষয়ে একশনএইড বাংলাদেশের নির্বাহী বোর্ডের সদস্য ডা. খলিলুর রহমান বলেন, “শহরে পর্যাপ্ত পাবলিক টয়লেট না থাকায় নারীরা পানি খেতে ভয় পান। আবার প্রয়োজন হলে টয়লেটে যেতে পারেন না নারীরা।

“ফলে ঢাকা শহরের নারীরা নানা শারীরিক সমস্যায় ভোগেন। এতে পরিবারে নারীদের জন্য স্বাস্থ্য ব্যয় বাড়ছে। নগর কাঠামো যদি নারী বান্ধব হত, তবে নারীর শারীরিক ও মানসিক পরিস্থিতির আরো উন্নয়ন হত।”

গবেষণাপত্রটি তুলে ধরার আগে এ গবেষণার প্রেক্ষাপট তুলে ধরেন একশনএইড বাংলাদেশের কান্ট্রি ডিরেক্টর ফারাহ্ কবির।

তিনি বলেন, “নগরের অর্ধেক জনসংখ্যা নারী হলেও নগর পরিকল্পনা ও উন্নয়নে নারীর চাহিদা ও আকাঙ্ক্ষার বিষয়টি সক্রিয়ভাবে বিবেচনায় আসে না।

“নগর উন্নয়নে সিদ্ধান্ত গ্রহণ, পরিকল্পনা প্রণয়ন, প্রকল্প ডিজাইন, বাস্তবায়ন ইত্যাদি বেশিরভাগ কাজে নারীদের সংখ্যা কম থাকায় নারী ব্যবহার বান্ধব নগর কাঠামো তৈরি হয় না। ফলে রাস্তাঘাট, ফুটপাত, মার্কেট, শপিংমল, পরিবহন ব্যবস্থা, পাবলিক টয়লেট, পার্ক, উন্মুক্ত স্থানসহ সকল গণপরিসরে নারীদের ব্যবহার উপযোগিতা সীমিত ও ঝুঁকিপূর্ণ।”

গবেষণার ফলাফলের উপর কথা বলতে গিয়ে স্থপতি ইকবাল হাবিব বলেন, “সত্যিকার অর্থেই আমাদের এই নগরী শুধুমাত্র সবলের জন্য। আর এই সবল হল যারা সামাজিকভাবে, অর্থনৈতিকভাবে ও রাজনৈতিকভাবে সবল।

“আমরা আমাদের ফুটপাতগুলো জনসাধারণের জন্য উন্মুক্ত করতে পারিনি। নারীদের খেলাধুলার জন্য আমরা একটি জায়গাও তৈরি করিনি। নারীকে আমরা বন্দি করে রাখি, আবার মা দুর্গা রূপেও দেখি।”

নারীবান্ধব নগর তৈরিতে সরকারকে উদ্যোগী হওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি বলেন, “পথে-প্রান্তরে টয়লেট তৈরিতে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানকে প্রয়োজনে বাধ্য করতে হবে। তা না হলে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। প্রকল্প নারী বান্ধব, শিশু বান্ধব ও প্রতিবন্ধী বান্ধব হয়েছে কিনা তা অবশ্যই পরিকল্পনা কমিশনকে দেখতে হবে। আর তা নিশ্চিত না হলে প্রকল্পে অর্থায়ন বন্ধ করতে হবে।”

গবেষণায় দেশে বিদ্যমান নীতি ও আইনের প্রেক্ষাপট বিশ্লেষণ করে বেশ কিছু সুপারিশ তুলে ধরা হয়।

জাতিসংঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য-এসডিজির ৫ ধারায় লিঙ্গ সমতা এবং নারী ক্ষমতায়নের কথা বলা হয়েছে। এ লক্ষ্য অর্জনের মাধ্যমে নারীদের সকল বৈষম্য ও সহিংসতা দূরীকরণ, গৃহস্থালি কাজের স্বীকৃতি প্রদান, রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক ও সামাজিক জীবনে নারীদের সক্রিয় অংশগ্রহণ ও নেতৃত্বের সমান সুযোগ নিশ্চিত করার লক্ষ্যে উপযুক্ত ও প্রয়োগযোগ্য আইন প্রণয়নের কথা বলা হয়।

আর দেশে খসড়া জাতীয় নগরায়ন নীতিমালা, স্থানীয় সরকার আইন ২০০৯, ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যান (২০১৬-৩৫), জাতীয় গৃহায়ন নীতিমালা, মহানগর ইমারত নির্মাণ বিধিমালা, জাতীয় বহুমাত্রীয় পরিবহন নীতিমালা, জাতীয় নারী নীতিমালা, বাংলাদেশ ন্যাশনাল বিল্ডিং কোডে জেন্ডার সংবেদনশীল নগর পরিকল্পনা প্রণয়ন ও বাস্তবায়ন করার কৌশল প্রণয়নের উপর জোর দেওয়া হলেও বিষয়গুলো কাগজেই আটকে রয়েছে। বাস্তবায়নেই মূল সমস্য।

গবেষণাপত্রের সুপারিশে বলা হয়, যে কোনো প্রকল্প প্রণয়নের ধারণাপত্র থেকে শুরু করে বাস্তবায়ন পর্যন্ত সকল পর্যায়ে নারী সংবেদনশীল ধ্যান-ধারণার প্রতিফলন থাকতে হবে; নারী বান্ধব শহর এবং কমিউনিটি/নেইবারহুড উন্নয়নের পরিকল্পনা নীতি তৈরির সময় নারী সংগঠনের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।

এছাড়া ঢাকা স্ট্রাকচার প্ল্যানের ডিটেইল এরিয়া প্ল্যানে নারী সংবেদনশীল কৌশলনীতি ব্যাখ্যা করার দাবিও জানানো হয়।

অন্যান্য সুপারিশের মধ্যে রয়েছে, মূলধারার পরিবহন পরিকল্পনা ও প্রস্তাবনায় নারী সংবেদনশীল নীতি গ্রহণ করা; নারী ও শারীরিক প্রতিবন্ধীদের ব্যবহার উপযোগী রাস্তা, ওয়েটিং স্টেশন, টার্মিনাল ও স্টপেজ নির্মাণ করা; পার্ক, উদ্যান ও খেলার মাঠে অবৈধ দখলদারিত্ব প্রতিহত করা।

শহর ও গ্রামে নারীর চলাচলের জন্য যৌন হয়রানির ভীতি ও সহিংসতামুক্ত পরিবেশ নিশ্চিতসহ জেন্ডার সংবেদনশীল কাঠামো গঠনের লক্ষ্যে একশনএইড বাংলাদেশ ২০১১ সাল থেকে একশনএইড ফেডারেশনের সঙ্গে প্রকাশ করে নারীর জন্য নিরাপদ শহর বিষয়ক প্রচারণা এবং কার্যক্রম গ্রহণ করে।

দেশের সাতটি বিভাগীয় শহরে প্রাথমিক গবেষণার কাজ সম্পাদন করে ২০১৪ সালে সেই গবেষণার ফল প্রকাশের মাধ্যমে ‘নিরাপদ নগরী, নির্ভয় নারী’ ক্যাম্পেইন ঘোষণা করে বেসরকারি এ সংস্থা।

এরই প্রেক্ষাপটে একশনএইড ফেডারেশন ২০১৫ সালের ২০ মে-কে ‘বিশ্বব্যাপী নারীর জন্য নিরাপদ শহর দিবস’ নির্ধারণ করে প্রচারণা চালিয়ে আসছে। বর্তমানে বিশ্বের ১৭টি দেশ একযোগে এ দিবসটি পালন করছে।