বিচারকদের বিদেশযাত্রা নিয়ে নির্বাহী ও বিচার বিভাগের পাল্টাপাল্টি

আইন মন্ত্রণালয়ের উদ্যোগে অধঃস্তন আদালতের বিচারকদের প্রশিক্ষণের জন্য বিদেশে পাঠানোর ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের অনুমতি না নেওয়ায় উচ্চ আদালত ও মন্ত্রণালয়ের দ্বন্দ্ব প্রকাশ্য রূপ নিয়েছে।

তাবারুল হকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 19 May 2017, 01:57 PM
Updated : 15 June 2017, 10:53 AM

মন্ত্রণালয়ের একটি প্রকল্পের আওতায় বিচারকদের বিদেশে যাওয়া নিয়ে পাল্টা-পাল্টি সার্কুলার ঝুলছে আইন মন্ত্রণালয় ও সুপ্রিম কোর্টের ওয়েব সাইটে।

অধঃস্তন আদালতের বিচারকদের ওপর সুপ্রিম কোর্টের নিয়ন্ত্রণ নিয়ে নির্বাহী বিভাগের সঙ্গে বিচার বিভাগের দ্বন্দ্বের একটি নতুন মুখ প্রকাশ্য হয়েছে এর মধ্যে দিয়ে।  

নিম্ন আদালতের ৫৪০ জন বিচারককে প্রশিক্ষণ দিতে গত ২৮ মার্চ ঢাকার হোটেল সোনারগাঁওয়ে আইন ও বিচার বিভাগের সঙ্গে অস্ট্রেলিয়ার ওয়েস্টার্ন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের এক সমঝোতা স্মারক সই হয়।

‘আদালত ব্যবস্থা শক্তিশালীকরণে আইন ও বিচার বিভাগের সক্ষমতা বৃদ্ধিকরণ’ শীর্ষক প্রকল্পের আওতায় এ উদ্যোগ নেওয়া হয় বলে জানানো হয় মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে।

এ প্রকল্পের প্রথম ধাপে প্রেষণে ১২ জন বিচারককে বিভিন্ন মেয়াদে ২৮ মে অস্ট্রেলিয়া পাঠানোর জন্য গত ৩ মে একটি অফিস আদেশ জারি করে আইন মন্ত্রণালয়।

এরপর ৯ মে ‘বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাগণের বিদেশ গমনের ক্ষেত্রে আবশ্যিকভাবে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ গ্রহণ সংক্রান্ত’ একটি সার্কুলার জারি করে সুপ্রিম কোর্ট। হাই কোর্ট বিভাগের রেজিস্ট্রার আবু সৈয়দ দিলজার হোসেন স্বাক্ষরিত সার্কুলারটি সুপ্রিম কোর্টের ওয়েব সাইটে আসে ১১ মে।

সেখানে বলা হয়, সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী বিচার বিভাগে নিযুক্ত ব্যক্তি ও ম্যাজিস্ট্রেটদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধানের বিষয়টি রাষ্ট্রপতির উপর ন্যস্ত এবং সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করে তার বাস্তবায়ন হয়।

“ফলে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তার কর্মস্থল নির্ধারণ, পদোন্নতি, ছুটি মঞ্জুরি, নিয়ন্ত্রণ, শৃঙ্খলা বিধান, বিদেশ গমন ও চাকরির অন্যান্য শর্তসহ সকল বিষয় ‍সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শক্রমে নির্ধারণ করা অনস্বীকার্য।”

আইন মন্ত্রণালয়, জাতীয় সংসদ সচিবালয়, নির্বাচন কমিশন সচিবালয় বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষের অফিসে প্রেষণ বা অন্যভাবে নিয়োগ পাওয়া বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ ছাড়া বিদেশ গমন না করার নির্দেশ দেওয়া হয় এই সার্কুলারে।

নির্দেশে বলা হয়, সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ ছাড়া বিচারিক পদে কর্মরত, প্রেষণ বা অন্যভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা কেউ বিদেশে গেলে তাদের বিরুদ্ধে শৃঙ্খলা ভঙ্গের জন্য বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়া হবে।

সুপ্রিম কোর্টের ওই সার্কুলারের পাল্টায় গত ১৬ মে আইন মন্ত্রণালয় থেকে আরেকটি সার্কুলার জারি করা হয় জ্যেষ্ঠ সহকারী সচিব তৈয়বুল হাসানের স্বাক্ষরে।

রাষ্ট্রপতির অনুমোদন নিয়ে গতবছর ১১ এপ্রিল মন্ত্রণালয় থেকে জারি করা একটি পত্রের বরাতে সেখানে বলা হয়, ২০১৬ সালের ১৪ ফেব্রুয়ারি সুপ্রিম কোর্টের একটি স্মারকপত্রের প্রেক্ষিতে অধস্তন আদালতের বিচারকরা প্রেষণে কর্মরত থাকাকালে বিদেশ যাত্রার ক্ষেত্রে সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ গ্রহণের আবশ্যকতা নেই। ওই পত্রের অনুলিপি সুপ্রিম কোর্টকেও পাঠানো হয়েছিল।

ওই পরিপত্র জারির পর প্রেষণে বা অন্যভাবে নিযুক্ত বিচার বিভাগীয় অনেক কর্মকর্তা সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ ছাড়াই সরকারি আদেশে বিদেশে গেছেন এবং কেউ কেউ এখনও বিদেশে অবস্থান করছেন বলে মন্ত্রণালয়ের ভাষ্য।

অন্যদিকে সুপ্রিম কোর্টের সার্কুলারে বলা হয়, সংবিধানের ১০৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী জুডিশিয়াল সার্ভিস সদস্যদের তত্ত্বাবধান ও নিয়ন্ত্রণ-ক্ষমতা সুপ্রিম কোর্টের হাই কোর্ট বিভাগের উপর ন্যস্ত। বিচার বিভাগ ও বিচার বিভাগের কর্মকর্তারা সব ক্ষেত্রে এবং সব অবস্থায় প্রজাতন্ত্রের অন্য সব কর্মকর্তা-কর্মচারী বা সার্ভিস থেকে ভিন্নভাবে বিবেচিত। কারণ এই বিভাগের সদস্যদের নিয়ন্ত্রণ ও শৃঙ্খলা বিধান রাষ্ট্রপতির ওপর ন্যস্ত এবং সুপ্রিম কোর্টের সঙ্গে পরামর্শ করে তা করতে হয়।

“সংবিধানের ১০৯, ১১৬ ও ১১৬ (ক) অনুচ্ছেদ ও সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের সিভিল আপিল নম্বর ৭৯/১৯৯৯ মামলার রায়ে বিচার বিভাগ ও বিচার বিভাগের সদস্যদের অন্য বিভাগ থেকে পৃথক ও স্বতন্ত্র মর্যাদা দিয়েছে। ফলে বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের বিদেশ ভ্রমণের ক্ষেত্রে সংবিধানের ১১৬ অনুচ্ছেদ ও প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় থেকে ২০১১ সালের ১৯ জুন জারি করা পরিপত্র পৃথকভাবে নয়, বরং একত্রে পাঠ করতে হবে।”

বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তারা সুপ্রিম কোর্টের পরামর্শ ছাড়া বিদেশে গেলে তাদের বিরুদ্ধে উচ্চ আদালত থেকে শৃঙ্খলা ভঙ্গের ব্যাবস্থা নেওয়ার যে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে, তাকে ‘অশোভন ও অনভিপ্রেত’ বলা হয়েছে আইন মন্ত্রণালয়ের সার্কুলারে।

সেখানে বলা হয়েছে, “রাষ্ট্রপতি যে অনুশাসন দিয়েছেন, তা প্রজাতন্ত্রের সকল প্রতিষ্ঠানের জন্য বাধ্যতামূলক। ফলে প্রেষণে বা অন্যভাবে নিয়োগপ্রাপ্ত বিচার বিভাগীয় কর্মকর্তাদের বিদেশ যাত্রার বিষয়ে রাষ্ট্রপতির অনুশাসনের বিপরীতে অন্য কোনো অনুশাসন বা সার্কুলার কার্যকর নয়।”

অবশ্য পাল্টা-পাল্টি এই সার্কুলার জারিকে বিচার বিভাগের সঙ্গে নির্বাহী বিভাগের দ্বন্দ্ব বলতে রাজি নন আইন মন্ত্রণালয়ের সচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হক।

বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেন, “সুপ্রিম কোর্টের সাথে কোনো ধরনের গোলমাল নেই। গোলমালের কোনো কারণও নেই। গোলমালের কিছু নেই।”

তিনি বলেন, “মহামান্য রাষ্ট্রপতির অনুশাসন অনুযায়ী প্রেষণে নিয়োজিত কর্মকর্তারা, শুধু আইন মন্ত্রণালয় নয়, যে কোনো মন্ত্রণালয়ে যারা প্রেষণে আছেন, তারা যদি বিদেশে যান, তাহলে যে মন্ত্রণালয়ের অধীনে রয়েছেন, সেই মন্ত্রণালয়ের অনুমতিতে তারা যাবেন। এটা হল রাষ্ট্রপতির অনুশাসন। রাষ্ট্রপতির যা অনুশাসন তা হল সর্বশেষ, এর উপরে কিছু থাকতে পারে না।”

অন্যদিকে হাই কোর্টের রেজিস্ট্রার আবু সৈয়দ দিলজার হোসেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “মন্ত্রণালয় থেকে এ বিষয়ে পাঠানো চিঠি আমরা পেয়েছি। কিন্তু যেদিন আমরা চিঠি পেয়েছি সেদিন স্যার (প্রধান বিচারপতি) টাঙ্গাইলে ছিলেন। আমি এ বিষয়ে কোনো মন্তব্য করব না। স্যার রোববার আসবেন, স্যারই এই চিঠির জবাব দেবেন।”

অধস্তন আদালতের বিচারকদের প্রশিক্ষণের বিষয়ে গত ২৮ র্মাচ সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি ছিলেন আইনমন্ত্রী আনিসুল হক।

আইন ও বিচার বিভাগের পক্ষে সচিব আবু সালেহ শেখ মো. জহিরুল হক এবং অস্ট্রেলিয়ার ওয়েস্টার্ন সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের পক্ষে এর উপাচার্য অধ্যাপক বার্নি গ্লোবার ওই সমঝোতা স্মারকে সই করেন।

দুই বছর মেয়াদী এ প্রকল্পের আওতায় অধস্তন আদালতের ৫৪০ জন বিচারকের প্রশিক্ষণ নিতে বিদেশে পাঠানোর কথা রয়েছে।