জরুরি অবস্থায় বেআইনিভাবে অর্থ নিয়েছিল ডিজিএফআই: সুপ্রিম কোর্ট

জরুরি অবস্থার সময় প্রতিরক্ষা গোয়েন্দা সংস্থা ডিজিএফআই তার এখতিয়ারের বাইরে গিয়ে ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে অর্থ নিয়েছিল এবং তখন তা দেখেও নীরব ছিল তত্ত্বাবধায়ক সরকার।

নিজস্ব প্রতিবেদকবিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 17 May 2017, 05:43 PM
Updated : 17 May 2017, 06:34 PM

তখন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির কাছ থেকে নেওয়া ৬১৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা ফেরত দিতে হাই কোর্টের রায় বহাল রেখে আপিল বিভাগের দেওয়া রায়ে একথা বলা হয়েছে।

প্রধান বিচারপতি এস কে সিনহার নেতৃত্বাধীন আপিল বিভাগের চার বিচারপতির বেঞ্চের দেওয়া পূর্ণাঙ্গ রায়টি মঙ্গলবার প্রকাশের পর সুপ্রিম কোর্টের ওয়েবসাইটে তোলা হয়েছে।

হাই কোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে বাংলাদেশ ব্যাংকের করা আপিল খারিজ করে গত ১৬ মার্চ সর্বোচ্চ আদালত রায়টি দিয়েছিল।

বিচারপতি সিনহার লেখা ৮৯ পৃষ্ঠার এই রায়ে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে সামরিক বাহিনীর উপর বেসামরিক প্রশাসনের কর্তৃত্ব বজায় রাখার বিষয়েও কয়েকটি পর্যবেক্ষণ দেওয়া হয়।

বাংলাদেশে রাজনৈতিক বিশৃঙ্খলার মধ্যে ২০০৭ সালে জরুরি অবস্থা জারির পর সাবেক গভর্নর ফখরুদ্দীন আহমদের নেতৃত্বে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার দায়িত্ব নিলেও পেছন থেকে তা চালাচ্ছিল সেনাবাহিনী।

তখন ব্যাপক ধরপাকড়ের মধ্যে বিভিন্ন ব্যবসায়ীদের কাছ থেকে বিপুল সংখ্যক টাকা নিয়ে সরকারি কোষাগারে রাখা হয়েছিল।

২০১০ সালে জাতীয় সংসদের প্রশ্নোত্তরে অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত বলেছিলেন, এই অর্থের পরিমাণ প্রায় ১ হাজার ২৩২ কোটি টাকা।

দেশে গণতন্ত্র ফেরার পর ১১টি প্রতিষ্ঠান তাদের কাছ থেকে বাজেয়াপ্ত অর্থ ফেরতে আদালতের দ্বারস্ত হলে হাই কোর্ট তিন মাসের মধ্যে ওই প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে নেওয়া ৬১৫ কোটি ৫৫ লাখ টাকা তিন মাসের মধ্যে ফেরতের রায় দেয়। হাই কোর্টের ওই রায়ই বহাল রাখে আপিল বিভাগ।

সর্বোচ্চ আদালতের রায়ে ডিজিএফআই গঠনের ইতিহাস, তাদের কর্মপরিধি তুলে ধরে বলা হয়, দেশের আইন অনুযায়ী সরকারের পক্ষে এই সংস্থাটির এভাবে অর্থ নেওয়ার কোনো এখতিয়ার নেই।

রায়ে বলা হয়, কোন ক্ষমতাবলে এবং কীভাবে তারা এই টাকা উদ্ধার করে বা জোর করে নেয়, তার ব্যাখ্যা দেওয়ার দায়িত্ব ছিল সরকারের। সরকার নীরব থেকেছে। বাংলাদেশ ব্যাংক বেআইনি কাজকে সমর্থন জুগিয়েছে।

রায়ে বলা হয়, বিশেষ পরিস্থিতি কিংবা সংবিধানের ক্ষমতাবলে জরুরি অবস্থা জারির মাধ্যমে কিংবা অন্য কোনো পরিস্থিতিতে সরকারি সংস্থা বিশেষ করে ডিজিএফআইকে আইন বহির্ভূতভাবে জনগণের জীবন, সম্পদ ও ব্যবসায় হস্তক্ষেপ করার ক্ষমতা দেওয়া হয়নি।

রায়ে আদালত বলেছে, রিট আবেদনকারীদের কাছ থেকে নেওয়া অর্থ ফেরত দিতে আইনগত কোনো বাধা নেই। ব্যবসায়ী ও বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে জোর করে আদায় করা এসব অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকে জমা রাখা যেমন ঝুকিপূর্ণ, তেমনি বিপজ্জনকও।

জরুরি অবস্থা প্রত্যাহারের পর বাংলাদেশ ব্যাংক ওই টাকা সংশ্লিষ্টদের ফেরত দিতে পারত। কিন্তু কী কারণে তা আটকে রেখেছে তা বোধগম্য হচ্ছে না আদালতের কাছে।

এ্ই মামলার শুনানিতে বাংলাদেশ ব্যাংকের পক্ষে ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম বলেছিলেন, দুটি কারণে ওই টাকা ফেরত দিতে হাই কোর্ট নির্দেশ দিতে পারে না।

এর প্রথমটি হলো, ওই টাকা সরকারের বিভিন্ন একাউন্টে চলে গেছে। সেটা বিতরণ হয়ে গেছে। তাই সেই টাকা আর ফেরত দেওয়ার সুযোগ নেই। দ্বিতীয়ত, এ টাকা ফেরত দিতে হলে সংসদে আইন পাস করতে হবে।

এ যুক্তি খণ্ডন করে আদালত রায়ে বলেছে, এটা গ্রহণযোগ্য নয়। কারণ জোর করে আদায় করা ওই অর্থ বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি অ্যাকাউন্টে জমা রয়েছে।

“কোনো আইনি প্রক্রিয়া ছাড়া জনগণের কাছ থেকে অবৈধভাবে নেওয়া টাকা ফেরত দিতে আদালতের নির্দেশনা দেওয়ার এখতিয়ার রয়েছে। হাই কোর্ট যথাযথভাবেই টাকা ফেরতের নির্দেশ দিয়েছে। এ টাকা ফেরত দেওয়ার জন্য জাতীয় সংসদে আইন করার প্রয়োজন নেই।”

কে কী পরিমাণ অর্থ ফেরত পাচ্ছে

# ইস্ট ওয়েস্ট প্রপার্টি ডেভেলপমেন্ট লিমিটেড- ১৮৯ কোটি টাকা

# বসুন্ধরা পেপার মিল লিমিটেড- ১৫ কোটি টাকা

# মেঘনা সিমেন্ট ইন্ড্রাস্ট্রিজ- ৫২ কোটি টাকা

# এস আলম স্টিল লিমিটেড- ৬০ কোটি টাকা

# ইস্টার্ন হাউজিং লিমিটেড- ৩৫ কোটি টাকা

# ইউনিক হোটেল অ্যান্ড রিসোর্ট লিমিটেড- ১৭ কোটি ৫৫ লাখ টাকা

# বোরাক রিয়েল এস্টেট প্রাইভেট লিমিটেড-৭ কোটি ১০ লাখ টাকা

# ইউনিক ইস্টার্ন প্রাইভেট লিমিটেড- ৯০ লাখ টাকা

# ইউনিক সিরামিক ইন্ডাস্ট্রিজ প্রাইভেট লিমিটেড- ৭০ লাখ টাকা

# ইউনিক গ্রুপের মালিক নূর আলী- ৬৫ লাখ টাকা

# দি কনসোলিডেটেড টি অ্যান্ড ল্যান্ডস কোম্পানি লিমিটেড ও বারাউরা টি কোম্পানি লিমিটেড- ২৩৭ কোটি ৬৫ লাখ টাকা

সামরিক বাহিনী বেসামরিক কর্তৃত্বে

আপিল বিভাগের রায়ে মুক্তিযুদ্ধের সময়ে গঠিত বাংলাদেশ সশস্ত্র বাহিনীর বিভিন্ন কাজের প্রশংসা করার পাশাপাশি জাতির জনক হত্যাকাণ্ডসহ অবৈধভাবে ক্ষমতা দখলে এই বাহিনীর কিছু কর্মকর্তার তৎপরতার সমালোচনাও করা হয়।

২০০৭ সালের ১১ জানুয়ারি জরুরি অবস্থা জারিতে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজউদ্দিন আহম্মেদকে বাধ্য করার বিষয়টিও একই দৃষ্টিতে দেখেছে আদালত।

তৎকালীন রাষ্ট্রপতি ইয়াজ উদ্দিন আহম্মেদ সংবিধান লঙ্ঘন করে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধানের পদ নিলেও ওই ধরনের পদক্ষেপ নেওয়ার দায়িত্ব সেনাবাহিনীর নয় বলে মন্তব্য করেছে আদালত।

রায়ে বলা হয়েছে, উচ্চাভিলাষী কিছু সেনা কর্মকর্তা তখন রাজনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীদের গ্রেপ্তার করার মধ্য দিয়ে দেশকে অর্থনৈতিকভাবে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে গিয়েছিল। আইন বহির্ভূতভাবে কিছু সেনা কর্মকর্তা নির্বাহী বিভাগের ক্ষমতা প্রয়োগ করে। এর ফলে জনসাধারণের কাছে সশস্ত্র বাহিনীর ভাবমূর্তি নষ্ট হয়। 

গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় রাষ্ট্রে সেনাবাহিনীর ভূমিকা ব্যাখ্যা করে দুটি বিপদের কথা রায়ে বলা হয়; একটি হচ্ছে রাজনৈতিক নেতৃত্বের সামরিক উচ্চাভিলাষ এবং অন্যটি হচ্ছে সামরিক বাহিনীর রাজনৈতিক উচ্চাভিলাষ।

গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রে সেনাবাহিনীর ভূমিকা কী হবে, তার একটি সুস্পষ্ট রূপরেখা থাকার কথা বলেছে সুপ্রিম কোর্ট।

প্রতিরক্ষা ও নিরাপত্তা বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে সংসদের গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখার কথা উঠে এসেছে রায়ে; এতে এ বিষয়ে জাতীয় কৌশল প্রণয়ন, তাতে স্বচ্ছতা আনা, বাজেট বরাদ্দ দেওয়ার ক্ষেত্রে সংসদের ভূমিকার কথা বলা হয়েছে।

সরকারের কাছে সামরিক বাহিনীর জবাবদিহির জন্য বেসামরিক প্রশাসনের অঙ্গ হিসেবে বিভাগের কথা বলা হয়েছে রায়ে, যারা সামরিক বাহিনীকে নির্দেশনা দেবে এবং তাদের কাজ তদারক করবে।

সামরিক বাহিনীতে প্রশিক্ষিত এবং অভিজ্ঞ নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠিত করার কথা বলা হয়েছে রায়ে, যাদের বেসামরিক প্রশাসনের কর্তৃত্বের নীতির বিষয়ে ধারণা থাকবে, যারা বাহিনীকে রাজনৈতিকভাবে নিরপেক্ষ এবং দলীয় প্রভাবমুক্ত রাখবেন।

রাষ্ট্রে সুসংহত একটি নাগরিক সমাজের উপস্থিতির উপরও জোর দিয়েছে আদালত, যাদের গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠান ও মূল্যবোধের বোঝাপড়াটা ভালো হবে। সামরিক বাহিনীর ভূমিকা ও কাজের পরিধি নিয়ে জনগণের মধ্যে মতৈক্য থাকার কথাও বলা হয়েছে রায়ে।

প্রতিরক্ষা নীতিসহ সামরিক বিষয়াদিতে বৈচিত্র্যপূর্ণ মতের সন্নিবেশ ঘটাতে সামরিক ঘরানার মধ্যে বেসরকারি একটি গ্রুপের সক্রিয় উপস্থিতির সুযোগ রাখার কথাও বলেছে সর্বোচ্চ আদালত।

রায়ে সংবিধানের পঞ্চম সংশোধনী বাতিল সংক্রান্ত রায়ের কথা তুলে ধরে বলা হয়, ওই রায়ে আদালত সামরিক আইন জারিকে অনুমোদন দেয়নি। আদালত এদের বেআইনি কাজের জন্য শাস্তি নিশ্চিত করতে বলেছে, যাতে অন্যায়কারীরা জনগণের অধিকার খর্ব করার সাহস না দেখায়।

ওই রায়ের ধারাবাহিকতায় সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনীতে ৭ (ক) অনুচ্ছেদ যোগ হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, যদি কেউ সংবিধান বহির্ভূতভাবে এ জাতীয় ক্ষমতা গ্রহণ করে বা সংবিধান স্থগিত করে, তবে তাকে সর্বোচ্চ শাস্তির মুখোমুখি হতে হবে।

রায়ে আশা প্রকাশ করা হয়, সশস্ত্র বাহিনী এমনভাবে কাজ করবে, যাতে তাদের নিয়ে দেশের নাগরিকরা গর্ব করবে, তাদের প্রতি আস্থা অটল থাকবে।