ভিন্ন কারণে তাকে ‘ফাঁসাতে’ এই অভিযোগ আনা হয়েছে বলে দাবি করেছেন রিয়াজুল হক। তার পক্ষে দাঁড়িয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ে তার বেশ কয়েকজন সহকর্মী ও শিক্ষার্থী।
একই বিষয় পড়িয়ে আসা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক সাদেকা হালিম বলেছেন, সবগুলো স্লাইড দেখে তিনি আপত্তিকর কিছু পাননি। জেন্ডার ইস্যুর ‘প্রাসঙ্গিক ও প্রয়োজনীয়’ আলোচনাগুলোই সেখানে এসেছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের ১০ জন শিক্ষকও ওই স্লাইডগুলোতে ‘অশ্লীল কিছু নেই’ উল্লেখ করে উপাচার্যকে চিঠি দিয়েছেন।
অভিযোগকারীর বিষয়ে লুকোছাপা চলছে উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগে। ‘বিভাগ থেকে অভিযোগ এসেছে’ বলার পর ‘তদন্তাধীন বিষয়’ বলে মুখে কুলুপ এঁটেছেন দায়িত্বশীলরা।
অভিযোগের তদন্ত চলছে বলে জানিয়েছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য অধ্যাপক আ আ ম স আরেফিন সিদ্দিক। তবে জেন্ডার বিশেষজ্ঞদের নিয়ে তদন্ত করার সুপারিশ জানিয়েছেন উইমেন অ্যান্ড জেন্ডার স্টাডিজ বিভাগের শিক্ষকরা।
‘অশ্লীল চিত্রের’ মাধ্যমে ক্লাস নেওয়ার অভিযোগে গত ২৭ ফেব্রুয়ারি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট অধ্যাপক ড. রিয়াজকে সাময়িক বরখাস্ত করে।
তবে এর বিরুদ্ধে এই শিক্ষক আদালতে গেলে হাই কোর্ট বিশ্ববিদ্যালয়ের বরখাস্তের সিদ্ধান্ত ইতোমধ্যে স্থগিত করেছে।
সাময়িক বরখাস্তর পর অভিযোগটি খতিয়ে দেখার জন্য উপ-উপাচার্য (শিক্ষা) অধ্যাপক নাসরীন আহমদকে প্রধান করে পাঁচ সদস্যের তদন্ত কমিটি গঠন করে বিশ্ববিদ্যালয় সিন্ডিকেট।
তিন শিক্ষার্থীর অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগের একাডেমিক কমিটি হয়ে বিষয়টি সিন্ডিকেটে যাওয়ার কথা জানিয়েছে বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ। তবে গত ছয় মাসে বিভাগের কোনো একাডেমিক কমিটির এজেন্ডায় এমন অভিযোগের বিষয়ে কিছু পাওয়া যায়নি।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ১৫ জন কর্মকর্তার জন্য বিভাগ থেকে একটি বিশেষ সান্ধ্যকালীন কোর্স চালু আছে। সেখানে জেন্ডার ডেভেলপমেন্ট কোর্সটি পড়ানো হয়। এই ব্যাচের কোর্সটি জুন থেকে ডিসেম্বর পর্যন্ত চলে।
এই ব্যাচের শিক্ষার্থীদের মধ্য থেকে অভিযোগটি আসে বলে খবর ছড়িয়েছে।
ওই ব্যাচের শিক্ষার্থী এবং বাংলাদেশ ব্যাংকের উপ মহাব্যবস্থাপক সিরাজুল ইসলামকে অশ্লীলতার বিষয়ে প্রশ্ন করলে তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমার কাছে কতগুলো স্লাইড আছে আপনি দেখে যান, সেগুলো অশ্লীল কি অশ্লীল নয়, সেটা আপনি বিবেচনা করবেন।”
অভিযোগ কে করেছে- জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমি কোনো অভিযোগ করিনি, কেউ করলে করতে পারে, তবে আমি করিনি।”
সান্ধ্যকালীন কোর্স ছাড়াও বিভাগের স্নাতক পর্যায়ে জেন্ডার ডেভেলপমেন্ট ও রেডিং ক্ল্যাসিক্যাল সোসিওলজি নামে দুটি কোর্স পড়ান অধ্যাপক রিয়াজুল হক। নর্থ সাউথ ইউনিভার্সিটি ও বিইউপিতেও কয়েকটি কোর্সে এমন বিষয় পড়ান তিনি।
অধ্যাপক রিয়াজুল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “জেন্ডার অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট কোর্সটি বিশ্ববিদ্যালয়ের নিয়মিত শিক্ষার্থীদের চতুর্থ সেমিস্টারে পড়াই। নিয়মিত শিক্ষার্থীদের কোর্সে যা পড়াই, তা সান্ধ্যকালীন কোর্সেও পড়াই।
“আমি যদি এই কোর্সটিতে অশ্লীল চিত্রে পড়াই, তাহলে তো সাত বছর আগে সেসব বিষয়ে প্রশ্ন উঠত। তখন তো কেউ অভিযোগ করেনি।”
যুক্তি হিসাবে তিনি বলেন, “ক্লাস কনটেন্টে তাদের আপত্তি করার মতো কিছু থাকলে কোর্স কীভাবে শেষ করলাম? কোর্স শেষ করার দিন ক্লাস পার্টি হয়। বিপুল উৎসাহের মধ্য দিয়ে শিক্ষার্থীরা সেই পার্টিতে অংশও নিয়েছে।”
তিনি বলেন, তার কোর্সের কোনো বিষয় নিয়ে যদি শিক্ষার্থীদের কোনো আপত্তি থাকত, তাহলে তা নিশ্চয়ই বিভাগের এমডিএ কোর্সের ব্যাচ কো-অর্ডিনেটর অধ্যাপক ড. তৈয়েবুর রহমানকে জানাত এবং তিনি তা তাকেও জানাতেন।
অধ্যাপক ড. তৈয়েবুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমের জিজ্ঞাসায় বলেন, “একটা কমিটি হয়েছে, এটা তদন্তাধীন বিষয়, এ বিষয়ে কথা বলতে পারব না।”
সান্ধ্যকালীন এমডিএস ব্যাচ থেকে শিক্ষার্থীরা কোনো লিখিত অভিযোগ দিয়েছে কি না- প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “এই বিষয়ে একাডেমিক কমিটিতে আলোচনার প্রেক্ষিতে অভিযোগপত্র দেওয়া হয়েছে।”
কোনো শিক্ষার্থী অভিযোগ করেছে কি না- জানতে চাইলে তিনি ফোন কেটে দেন। পরে ফোন দিলে আর তা ধরেননি তিনি।
‘আপত্তিকর কিছু নেই’
পড়ানোর সময় যে সব চিত্র দেখানোয় অধ্যাপক রিয়াজের বিরুদ্ধে অশ্লীলতার অভিযোগ আনা হয়েছে, সে সবগুলোই দেখেছেন সমাজ বিজ্ঞানের অধ্যাপক সাদেকা হালিম, যিনি নিজেও দীর্ঘদিন জেন্ডার বিষয়ক কোর্স পড়িয়ে আসছেন।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমি দেশের বাইরে দীর্ঘদিন পড়াশোনা করেছি। সেখানে বিশ্ববিদ্যালয় পর্যায়ে যেগুলো পড়ানো হয়, আমাদের দেশে সে সব পড়ালে মারামারি লেগে যেত।
“এখানে একই বিষয় পড়াতে গেলে এখানকার অবস্থা বিবেচনায় রেখেই আমরা পড়াই। অধ্যাপক রিয়াজও সেভাবেই পড়িয়েছেন। আমি তার সবগুলো স্লাইড দেখেছি, তাতে আপত্তিকর কিছু পাইনি।”
তিনি বলেন, “জেন্ডার ইস্যু পড়াতে গেলে এর সোশ্যাল কনস্ট্রাকশন যেমন পড়াতে হয়, তেমনি এর সেক্সুয়াল কনস্ট্রাকশনও পড়াতে হবে। নারীকে মানুষ না ভেবে আমরা যেভাবে পণ্য হিসাবে উপস্থাপন করি, রাস্তায় দুইজনের ঝগড়া লাগলে একজন আরেকজনের মাকে গালি দেয়া, যা বলে গালি দেয়-এগুলো ক্লাসে শিক্ষার্থীদের ধরিয়ে দিতে হয়। তিনি শিক্ষক হিসাবে সেটাই করেছেন।”
অধ্যাপক রিয়াজের পক্ষে অনলাইনেও অনেকে সক্রিয় হয়েছেন।
ওই বিভাগের সাবেক শিক্ষার্থী রাজু নুরুল তার ফেইসবুকে লেখেন, “জেন্ডার এর সংজ্ঞা বুঝতে হলে সবার আগে সেক্স, লিঙ্গ, নারী-পুরুষের শরীর, ইচ্ছা অনিচ্ছা, যৌনতা এসব বিষয় এবং এসবের সংজ্ঞা বুঝতে হয়। পুরুষ প্রধান সমাজ হওয়ার কারণে, আমাদের দেশে নারী পুরুষের বৈষম্য প্রকট, তার ধরনও বহুমাত্রিক; ফলত আলোচনাগুলোও প্রাসঙ্গিক এবং বাস্তবতার সাথে সম্পৃক্ত হওয়া জরুরি।
“আর সেজন্য দরকার খোলামেলা আলোচনার সুযোগ। অথচ সেই খোলামেলা আলোচনার ‘অপরাধে’ কোনো একজন শিক্ষককে যদি বরখাস্ত হতে হয়, এর চেয়ে দুঃখজনক ঘটনা আর কী হতে পারে?”
নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিভাগের এক শিক্ষার্থী বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “অধ্যাপক রিয়াজুল হক স্যার বিভাগের স্নাতক পর্যায়ে জেন্ডার ডেভেলপমেন্ট ও রেডিং ক্ল্যাসিক্যাল সোসিওলজি নামে দুটি কোর্স পড়ান। এরকম সেন্সেটিভ কিছু মনে হয়নি।”
‘বিভাগে ষড়যন্ত্র’
অধ্যাপক রিয়াজ মনে করছেন, তিনি বিভাগের দুই শিক্ষকের ষড়যন্ত্রের শিকার। তাদের প্রভাবে তার বিরুদ্ধে শিক্ষার্থীদের নাম করে অভিযোগ করা হতে পারে।
কী কারণে বলে মনে করেন- প্রশ্ন করা হলে তিনি বলেন, “জ্যেষ্ঠতার ক্রম অনুসারে এরপর বিভাগের চেয়ারম্যান হওয়ার কথা আমার। সেটা কারও কারও পছন্দ না হতে পারে।
“বিভাগে নানা উপলক্ষে অনেক ফান্ড আসে, আমি চেয়ারম্যান হলে সেগুলোর এতদিনকার খরচ নিয়ে প্রশ্ন উঠতে পারে। তাই তারা হয়ত আমার বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্র করছে।”
বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক আবু মোহাম্মদ ইউসুফ ও অধ্যাপক তৈয়েবুর রহমানের বিরুদ্ধে ষড়যন্ত্রের অভিযোগ করেন তিনি।
অধ্যাপক আবু মোহাম্মদ ইউসুফ নাম ধরে অধ্যাপক রিয়াজ বলেন, “ব্যক্তিগত ঝামেলার জন্যে তিনি আমার বিরুদ্ধে নানা ষড়যন্ত্র করেছেন। এবার যাতে বিভাগের চেয়্যারম্যান হতে না পারি, সেজন্য এটা করেছেন।”
অধ্যাপক রিয়াজের অভিযোগের বিষয়ে বারবার মোবাইলে কল করে এবং এসএমএস পাঠিয়েও কোনো সাড়া পাওয়া যায়নি অধ্যাপক আবু ইউসুফের। ই-মেইল পাঠালেও তার উত্তর মেলেনি।
সম্প্রতি বিভাগের করিডোরে সাক্ষাতে জানতে চাইলে তিনি এটাকে ‘তদন্তাধীন বিষয়’ বলে এড়িয়ে যেতে চান।
তিনি বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “এটা তদন্তাধীন বিষয়। আমরা যা পাঠানোর বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠিয়ে দিয়েছি। সেটা একাডেমিক কমিটিতে আলোচনার পর পাঠানো হয়েছে।”
একাডেমিক কমিটির এজেন্ডায় বিষয়টি না থাকার প্রসঙ্গে কোনো মন্তব্য করেননি বিভাগের চেয়ারম্যান অধ্যাপক ইউসুফ। ২০০৪ সালে পপুলেশন সায়েন্স বিভাগ থেকে উন্নয়ন অধ্যয়ন বিভাগে যোগ দেন তিনি।
অধ্যাপক রিয়াজুল তাকে ‘ফাঁসানোর’ যে অভিযোগ করেছেন- তার প্রতিক্রিয়া জনতে চাইলে অধ্যাপক ইউসুফ বলেন, “ফাঁসানো কোনো একাডেমিক ল্যাঙ্গুয়েজ না। আপনাকে তো বলেছি, এ বিষয়ে কারও সঙ্গে কোনো কথা বলব না। আমরা কেবল বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষের কাছে অ্যাকাউন্টেবল, তাদেরকে বলেছি।”
তদন্ত কমিটির সদস্য ও সামাজিক বিজ্ঞান অনুষদের ডিন অধ্যাপক ফরিদ উদ্দিন আহমেদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম বলেন, “যেহেতু এ বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে, আমি তদন্ত কমিটির সদস্য হিসেবে কোনো মন্তব্য করব না।”
উপাচার্য অধ্যাপক আরেফিন সিদ্দিক বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “বিভাগ থেকে অভিযোগ করা হয়েছে। সেই প্রেক্ষিতে সাময়িকভাবে বরখাস্ত করা হয়েছে। এখন বিষয়টির তদন্ত চলছে।”
কোনো শিক্ষার্থী অভিযোগ করেছে কি না- জানতে চাইলে ‘বিভাগ থেকে অভিযোগ দিয়েছে’ বলে কথা শেষ করেন তিনি।
একাডেমিক কমিটি থেকে অভিযোগ পাওয়ার পর উপ-উপাচার্য (প্রশাসন) অধ্যাপক নাসরীন আহমাদের দেওয়া প্রাথমিক তথ্যানুসন্ধান প্রতিবেদনের ভিত্তিতে সাময়িক বরখাস্তের সিদ্ধান্ত সিন্ডিকেট নিয়েছে বলে জানান তিনি।
তদন্তের সর্বশেষ অবস্থা সম্পর্কে জানতে চাইলে নাসরীন আহমাদ বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “আমরা তদন্ত করছি, সব পক্ষের সঙ্গে কথা বলা হচ্ছে। দ্রুত তদন্ত শেষ করে প্রতিবেদন দেব।”
“যার বিষয়ে তদন্ত হচ্ছে তিনিও আমাদের সহকর্মী, কারও উপর অবিচার হয়-এমন কিছু আমরা করব না,” বলেন তিনি।