নিউ ওয়েভে ডিবির অভিযান ছিল ‘অনৈতিক কাজে’

ঢাকার কাফরুলের নিউ ওয়েভ ক্লাবে ‘র‌্যাব পরিচয়ে’ অভিযানে গিয়ে মোবাইল ফোন ও টাকা কেড়ে নেওয়ার অভিযোগে সাময়িক বরখাস্ত হওয়া গোয়েন্দা পুলিশের ১১ সদস্যের ‘কারও কারও অনৈতিক কর্মকাণ্ডের’ প্রমাণ পেয়েছে তদন্ত কমিটি।

গোলাম মুজতবা ধ্রুবকামাল তালুকদার ও বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকম
Published : 28 April 2017, 05:38 PM
Updated : 28 April 2017, 05:51 PM

তিন সদস্যের ওই তদন্ত কমিটি বুধবার তাদের প্রতিবেদন ঢাকার পুলিশ কমিশনারের কাছে জমা দেন বলে উপ কমিশনার (মিডিয়া) মো. মাসুদুর রহমান বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান। 

প্রতিবেদনের বিষয়ে জানতে চাইলে পুলিশ কমিশনার মো. আছাদুজ্জামান মিয়া শুক্রবার বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, “তদন্ত কমিটি যথাযথভাবে তদন্ত করেছে। সেখানে কারো কারো অনৈতিক কর্মকাণ্ড প্রমাণিত হয়েছে। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় শাস্তির প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে।”

তবে এটি পুলিশের অভ্যন্তরীণ তদন্তের বিষয় হওয়ায় এর বেশি বলতে রাজি হননি ঢাকার পুলিশ প্রধান।

মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের অবৈধ অস্ত্র উদ্ধার দলের সহকারী কমিশনার রুহুল আমিনের নেতৃত্বে গোয়েন্দা পুলিশের ১১ জনের ওই দলটি গত ১৮ এপ্রিল রাতে সাধারণ পোশাকে ‘নিউ ওয়েভ’ ক্লাবে যায়।

সেখান থেকে চারজনকে আটক করে ফেরার পথে কাফরুলে সেনানিবাসের চেকপোস্টে  মিলিটারি পুলিশ গাড়ি থামায়। পরে ওই চারজনকে ছেড়ে দিয়ে ডিবির ১১ সদস্যকে পাঠানো হয় কাফরুল থানায়।

বিষয়টি জানাজানি হলে সহকারী কমিশনার রুহুল আমিনসহ ওই অভিযানে অংশ নেওয়া সবাইকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। বিষয়টি তদন্তের জন্য তিন সদস্যের কমিটি করে দেন পুলিশ কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া।

২০ এপ্রিল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে তিনি বলেছিলেন, “রিপোর্টের ভিত্তিতে কেউ দোষী প্রমাণিত হলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কেউ ছাড় পাবে না।”

সে অনুযায়ী তদন্ত করে গোয়েন্দা পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার জামিল আহমেদ, পুলিশ সদর দপ্তরের যুগ্ম কমিশনার কৃষ্ণপদ রায় এবং মহানগর পুলিশের মিরপুর বিভাগের উপ-কমিশনার মাসুদ আহমেদ বুধবার তাদের প্রতিবেদন দেন।

ওই প্রতিবেদনে যাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ করা হয়েছে, তাদের নাম প্রকাশ করতে চাননি কৃষ্ণপদ রায়।

তবে বিষয়টি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল একজন পুলিশ কর্মকর্তা বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে বলেন, প্রতিবেদনে ১১ জনের বিরুদ্ধেই বিভাগীয় ব্যবস্থা নেওয়ার সুপারিশ এসেছে।

সাময়িক বরখাস্ত ওই ১১ জন  হলেন- সহকারী কমিশনার রুহুল আমিন, পরিদর্শক গিয়াস উদ্দিন, এসআই জাহিদুল ইসলাম, এএসসআই লুৎফর রহমান, মাহবুবুর রহমান, তোফাজ্জল হোসেন এবং কনস্টেবল আবদুল লতিফ, আজিজুল হক, জাহাঙ্গীর আলম খান, তৌহিদুল ইসলাম ও জিল্লুর রহমান।

সেদিন যা ঘটেছিল

কাফরুলের ইব্রাহিমপুর রোডে একটি পাঁচতলা ভবনের চতুর্থ তলায় ‘নিউ ওয়েভ’ ক্লাব চালু হয় ২০০৫ সালে। সেখানে এলাকার লোকজন বিলিয়ার্ড খেলে, কেউ কেউ জিম করতে যান।

তবে ওই ক্লাবে জুয়ার আসর বসত এবং সেই সুযোগ নিয়েই গোয়েন্দা পুলিশের সদস্যরা অন্য বাহিনীর পরিচয় দিয়ে সেখানে চাঁদাবাজি করতে গিয়েছিল বলে সংবাদমাধ্যমের তথ্য।

জুয়ার আসরের অভিযোগ অস্বীকার করলেও ক্লাবের সভাপতি শফিউল আজম বলেছেন, এর আগে গত ১৬ মার্চও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর পরিচয়ে ক্লাবে এসে ২০/২৫ জনের কাছ থেকে টাকা ছিনিয়ে নেওয়া হয়েছিল এবং সে ঘটনার সিসিটিভি ফুটেজ তারা কাফরুল থানায় দিয়েছিলেন।

মার্চের ঘটনার ভিডিওতে যাদের দেখা গেছে, তাদের কয়েকজন ১৮ এপ্রিলের অভিযানেও ছিলেন বলে শফিউলের ভাষ্য।

ক্লাবের সদস্যদের বরাত দিয়ে শফিউল বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোর ডটকমকে জানান, ১৮ এপ্রিল রাতে ১০/১২ জন লোক সাধারণ পোশাকে ক্লাবে এসে পুলিশ, আর্মি ও র‌্যাবের পরিচয় দেয়। তারা হুমকি দেয়, কোনো কথা বললে গুলি করে দেবে।

“জিম করছিল, বিলিয়ার্ড খেলছিল- এমন ২০/২৫ জনকে ডেকে একটা রুমে নিয়ে তারা সবার মোবাইল, মানিব্যাগ টেবিলে রাখতে বলে। পরে সেখান থেকে টাকা নিয়ে মোবাইল ফোন একটা ব্যাগে ভরে বলে লোকজনের কাছে জেনেছি।”

সেখানে থাকা ব্যক্তিদের বরাত দিয়ে ক্লাব সভাপতি বলেন, অভিযানে আসা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা পরে সবার শরীর তল্লাশি করে কারও কাছে আর কোনো টাকা পাওয়া গেলে গুলি করে দেওয়ার হুমকি দেয়।

“সেখানে যারা দুই একজন পরিচয় জানতে চেয়েছিল, তাদের হাতকড়া পড়ায়। এরপর চারজনকে নিয়ে তারা চলে যায়।”

ওই চারজনের মধ্যে একজন ছিলেন সেনাবাহিনীর একজন মেজরের স্বামী। কাফরুলে সেনানিবাসের চেকপোস্টে তার চিৎকারে মিলিটারি পুলিশ গাড়ি থামায় এবং ঘটনা অন্যদিকে মোড় নেয়।

পরে কাফরুল থানা পুলিশ ঘটনাস্থলে আসে, খবর যায় পুলিশ কমিশনারের কাছেও। শেষ পর্যন্ত গভীর রাতে ওই চারজনকে ছেড়ে দিয়ে গোয়েন্দা পুলিশের ১১ সদস্যকে কাফরুল থানায় পাঠানো হয়।

অভিযানে থাকা পুলিশ সদস্যরা তাদের জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তাদের সে সময় বলেছিলেন, তারা গোপন সংবাদের ভিত্তিতে অভিযান চালিয়ে ওই ক্লাব থেকে ইয়াবা উদ্ধার করেন। আটক চারজনের মধ্যে একজন সেনা কর্মকর্তার স্বামী হওয়ায় তারা পরিস্থিতি ‘জটিল করে তোলে’।

অবশ্য মহানগর গোয়েন্দা পুলিশের যুগ্ম কমিশনার আবদুল বাতেন সে সময় বলেছিলেন, অবৈধ অস্ত্র উদ্ধারের দায়িত্বে থাকা ওই দলটির মাদকবিরোধী অভিযানের ‘জুরিসডিকশন’ ছিল না। এ কারণেই তাদের তাৎক্ষণিকভাবে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়।